যাচ্ছেতাই / নির্মল হালদার
কাক এসে বললো, পায়রার সঙ্গে দেখা হয় না আজকাল। শালিখ এসে বললো,চড়ুইয়ের সঙ্গে দেখা হয় না আজকাল।
কার সঙ্গে কার দেখা হয়?
বটের সঙ্গে অশথের দেখা হয়?
একই সঙ্গে দুটি ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দেখা হয় কি?
একই সঙ্গে দুটি লোক পাশাপাশি হাঁটছে। দেখা হয় কি?
কাক এসে আরও বললো, সে তো
অনেক অনেক ঘরেই উঁকি দেয়। এবং দেখে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
কেউ কেউ আলস্য করছে। অথবা
ঘাঁটাঘাঁটি করছে মোবাইল।
সেদিন একটা গাছের সঙ্গে দেখা হলো আমার। আমি কোনো খবর নিলাম না। সে কেমন আছে জল হাওয়া পাচ্ছে কিনা, খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না।
যেতে যেতে একটা নতুন রাস্তায় এসে পড়লাম। কত দূরে থাকো, কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।
ভুলে গেলাম নাকি এই আমার স্বভাব?
নতুনের সঙ্গেওতো নতুন করে পরিচয়ের প্রয়োজন আছে। ভালো থাকা না থাকা নিয়েও কথা বলার দরকার আছে।
যে দু'জনের সঙ্গে থাকি তাদের সঙ্গেও
কথা বলি না। মনে হয়, কথা নেই।
কোনো কথা নেই। তারাও আমার সঙ্গে
কথা বলে না। অথচ একই সঙ্গে আছি।
দুটো কুকুর সকাল থেকে এসে বসে থাকে আমাদের গলিতে। তাদের সঙ্গেও আমার কথা বলা হয় না। 
ভাবি কিইবা কথা বলবো।
কাকটা আমার মনের কাছে এসে
কা--কা করে উঠলো। অর্থাৎ বলতে চাইছে------আমিও অযোগ্য।
গাছ কথা বলে গাছের সঙ্গে। নীরবে।
আমার নীরব কথাও নেই।
 বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে মনের কথা
বলতে পারি কই? বাতাসের সঙ্গে
সব সময় দেখা হয়। একটাও কথা বলি না।
তবে  কি আমার কথা নেই?
সেদিন  হিল্লোল বলছিল, সে নাকি
এক কাপ চায়ে এক ঘণ্টা কাটাতে পারে। তার মানে, সে নিশ্চয়ই চায়ের সঙ্গে কথা বলে?
কী কথা?
আমার কথারা কী ফুরিয়ে গেল?
আমার আবেগ আমার অনুভূতি কিছুই কি নেই? আমার সংবেদনশীলতা কোথায় গেল?
অনেকদিন হয়েছে রাত্রিবেলায় আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছি।
কোনো তারার কাছে কোনো প্রশ্ন করিনি।
কথা থাকলেই তো প্রশ্ন থাকে।
কৌতুহল থাকে। আমি কি হারিয়ে ফেললাম? একদিন শুধু আকাশকে বলেছি, তুমি অনন্ত বলেই, আমি ক্ষুদ্র। শুধু এইটুকু কথা।
তারপর আকাশ কিছু বলতে চাইছিল।
আমি শুনিনি।
তালগাছের কাছেও নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। কেন মনে হয়? নিজেকে আর প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করলেই তো কথা। কথার পরে কথা।
আমার কথা নেই।
আমার সঙ্গে কারুর দেখা হবে না।
টিয়ার সঙ্গে ময়নার না দেখা হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখাই তো হচ্ছে না। 
কথাই তো হচ্ছে না।
রামানুজ বলছিল, তাকে যেন চিঠি লিখি। কিন্তু কোনো কথা নেই আমার।
একটা চিঠি লিখতে গেলে কথার দরকার পড়ে।
রামানুজকে লেখার মত বলবার মতো কথা নেই আমার।
ব্যর্থতা কিংবা সফলতা আমার নেই।
যা নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়।
শুধু অপমান আছে। যা বলতে গেলেও
অপমান সামনে দাঁড়ায়। আমি ভয় করি। তাই অপমান অবজ্ঞার কথা বলতে চাই না।
প্রেমে প্রত্যাখ্যান আমার জীবনে নেই।
যা নিয়েও সাতকাহন করা যায়। কেবল প্রেম আছে চোরা স্রোতের মতো।তা নিয়ে কি আর বলবো? চুপচাপ থাকি।
আমার জীবনে নৈঃশব্দ নেই। নীরবতা নেই। শুধু চুপচাপ থাকা। চুপচাপ থাকার সঙ্গে নৈঃশব্দের সম্পর্ক নেই। নীরবতার সম্পর্ক নেই।
এ কারণেই, নীরবতার সঙ্গেও আমার কথা হয় না।
একটা পাতা চেয়ে থাকে আরেকটা পাতার দিকে। চেয়ে চেয়ে বিনিময় করে নিজেদের সুখ-দুঃখ।
আমিতো চেয়ে থাকি না আলো অন্ধকারের দিকেও।
প্রজাপতি গাছে বসলো মানেই, ফুলের সঙ্গে কথা বলছে। মৌমাছি গাছে বসল মানেই, ফুলের মধুর সঙ্গে কথা বলছে।
কতবার যে ভেবেছি, নিজেকে হত্যা করবো। পারিনি। কেননা, নিজেকে হত্যা করার আগে নিজের সঙ্গে কথা থাকে।
আমি তো নিজের সঙ্গেও কথা বলতে পাচ্ছিনা। আমাকে চলে যেতেই হবে, সমুদ্রের কাছে।
একটার পর একটা ঢেউ আসবে
আমাকে কথা বলাবার জন্য। আমি কথা বলতে বাধ্য হবো।
নিজেকে দেখতে পাবো অনেক অনেকদিন পর।
তারপরেও একটা কিন্তু আছে, সমুদ্রের কাছে যেতে পারবো কি?  
------২৬ কার্তিক ১৪২৮
-----১৩-----১১----২০২১
-----নির্মল হালদার

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন