মাটিতে রামধনু ওঠে - ১
একটা শালিক উড়তে উড়তে গাছের ডালে। এদিক ওদিক চেয়ে থাকতে থাকতে উড়েও গেল। একটা কাক সেই ডালে এসে কাকে যেন ডাকছে।
কেউ নেই কোথাও নেই।
গাছের পাশে গাছও নেই।
আকাশ শুধু আকাশ।
তার সঙ্গে নীরবতা। অনেক দূরের এক মাঠে একটা লোক কি যেন কাজ করছে।
আবছা আবছা হলেও রোদ জোরালো। স্পষ্ট। গাছের ডালে, পাতায় পাতায় এক ফোঁটা ঘাম নেই।
কী আছে? কে আছে?
ওই তো একটা পোকা----ধীরে ধীরে মাটিতে ধূলায়। তার পায়ের দাগ দেখা যায় না। শোনা যায় না তার নিঃশ্বাস।
পোকাটির সঙ্গে তার গন্তব্য দেখতে কে যাবে? তার ভালোবাসা দেখতেও যাওয়া যায়। কে যাবে?
হাওয়া উঠছে। তার স্পর্শে পাতায় পাতায় মৃদু কম্পন। শিকড়েও কি কাঁপন জাগে?
গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার শিহরণ থাকে শিকড়ে। মাটিকে আঁকড়ে ধরার আকুতি থাকে। আনন্দ থাকে।
ভালোবাসা? ভালোবাসা থাকে?
আরো একটা শালিক গাছের ডালে বসতেই পাশে এসে বসলো আরো একজন। একটি শালিক।
কী কথা বলবে দুজনে?
যুগলের স্বর একই রাস্তায় গেলে আমিও যাব। যদি খুঁজে পাই, ঠিকানাহীন একটি ঠিকানা। আমাকে আদর না করলেও আমাকে তিন হাত জায়গা দেবে। হাত-পা ছড়িয়ে তোকেই খুঁজবো, প্রিয়।
সারাদিন আমার যে রোদ শুধু আমার যে বৃষ্টি।
------বেলা--১১--৪
------২০ চৈত্র ১৪২৯
-----৪---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ২
একটা গাছের ডালে সাঁটা আছে একটা আয়না। আয়নার নিচে লম্বা কাঠের তাক। ছুরি কাঁচি ক্ষুর চিরুনিও আছে। আরো আছে চুল ও দাড়ি কাটার এটা সেটা।
গাছের দিকে মুখ করে একটা চেয়ার।
রাস্তায় সারাদিন যানবাহনের চলাচল। তার ছবি আয়নাতে পড়ে। এবং সারাদিন আয়নাতে পড়ে থাকে অর্জুনের একটি দুটি ডালের ছবি।
অধিকাংশ সময় চেয়ার খালি।
সকাল দিকে দু চারজন চুল কাটতে আসে। বাদবাকি সময় আয়নাতে কোনো মুখ নেই।
আয়নাতে এসে পড়ে হাওয়া। মেঘ। বৃষ্টি এলে আয়না উঠে পড়ে গাছ থেকে। মালিক তাকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে।
আয়নার ঘর নেই।
মালিকের যে ঘরে আয়না থাকে, সেই ঘরও অন্ধকার। মালিকের ছোট্ট বোন এই ঘরে ভুল করে ঢুকলে অন্ধকার আয়নাতে একবার মুখ দেখে নেয়।
আয়না খুশিতে আয়না হয়ে ওঠে। সে মনেও করে, আছে আছে। আমার সঙ্গে কেউ আছে। এই তো ছোট বোন এসেছিল আমার কাছে।
আয়নার অবশ্য পছন্দ গাছের গায়ে সেঁটে থাকাটাই। কারণ একটাই, রাস্তা থেকে উঠে আসে কত রকম শব্দ। আর শব্দ আয়নার কাছে পৌঁছে যায়। তারপর তো আছেই , আয়নার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যানবাহন। উড়ন্ত পাতা। ধুলোবালি। মানুষের মুখ।
আয়নার মালিক সারাদিনে কয়েকবার আয়নার কাঁচ মুছে দেয়। সেই স্পর্শটুকুও আয়নার কাছে অনেক অনেক বেশি প্রাপ্তি। তা বাদে অন্ধকার নামার মুখে মালিকের গ্রামের বাড়ি। বন্দী হয়ে যাওয়া।
যখন সে সকালবেলায় মালিকের সঙ্গে সাইকেলে আসে তখন ফসলের ক্ষেতে নেমে দৌড়োতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু আয়নার স্বাধীনতা নেই। সে অনেকদিন ধরে চেয়েছে, আজও চাইছে----তার বুকেই উঠবে গোলপারা একটা চাঁদ। চাঁদের দুধে স্নান করলে পূর্ণতার স্বাদ আসে। অথচ সে রয়ে গেল, গাছে সেঁটে থাকা একটি আয়না।
এক সেলুনে।
----দুপুর--১--৫৪
---২০ চৈত্র ১৪২৯
----৪--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৩
লম্বা চওড়া বিছানা। বালিশও আছে কয়েকটা। কে মাথা রাখবে? কারা মাথা রাখবে?
আছে আছে আছে।
যখন তখন মেঘ আসে বৃষ্টি আসে। হাওয়া তো আসেই। রোদ এসে উঁকি দিয়ে যায়। আগে শালিক চড়ুই আসতো। এখন ওদের দেখা যায় না আর। কাঠবিড়ালি দূর থেকে ঘরটা দেখে লাফিয়ে চলে যায়।
বিছানাটা আছেই।
দিনেও আছে রাত্রেও আছে।
বিরহে আছে অভিমানেও আছে।
লম্বা চওড়া বিছানা। মেঝেতেই পাতা থাকে। বিছানার চাদর শিল্পের রেখায় শিল্পিত হলেও শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস ওঠে।
দীর্ঘশ্বাস?
ঘর থেকে নিঃশ্বাস কি শোনা যায়?
হাসি কান্না?
ঘরে দেয়ালে টাঙানো ছবি কার সঙ্গে কথা বলে? ঘরে কেউ থেকেও তো নেই। একটা পিঁপড়েরও পায়ের শব্দ নেই।
ঘুম আছে?
ঘরের জানালা থেকে মাধবীলতাকে ডাক। সে নিজের মতো করে লতিয়ে উঠতে উঠতে ঘরের দিকে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখে না, কে ডাকছে!
মন ডাকে। নিজেরই মন। নিজের সঙ্গে নিজের খেলা। হেরে যাওয়ার খেলা খেলতে খেলতে দিনরাত্রি এসে হেসে হেসে ওঠে।
এ হাসি লুফতে পারলেই, একটা রঙিণ বল।
তুই কখনো চাইলে তোকে দিয়ে দেবো। তুই কি হাত পাততে পারিস?
-----২১ চৈত্র ১৪২৯
-----৫---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৪
কাছে যাই বা না যাই, পাহাড় আমাকে ডাকে। অপেক্ষা করে না? করে। আমি কাছে গেলে কথা বলবে নীরব ভাষায়।
অনেক কথা। মন উজাড় করা কথা। সেই একদিন আমাকে বলেছিল: একটা গ্রাম ছিল, পাহাড়তলির গ্রাম। একটা নদীও ছিল। নিরাময় নদী। হঠাৎ একদিন কারা যেন এসে, নদীকে বেঁধে দিয়ে রুদ্ধ করে ফেললো নদীর গতিপথ। উচ্ছেদ হয়ে গেল গ্রাম।
পাহাড়কেও শেষ করে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল। দু চারজন মানুষের জন্য পারেনি। তারপর তো, মানুষ শুন্য চারদিক।
এই পাহাড়তলির গ্রামেই ধানের বদলে আখের চাষ ছিল প্রধান। আখের রস থেকে গুড়। গুড়ের চাষ। শহর থেকে মহাজনরা এসে গুড় নিয়ে যেতো।
কত যে মাছি। কত যে মৌমাছির আনাগোনা ছিল। এখনও ড্যামের জলে দাঁড়িয়ে আছে দু তিনটে তালগাছ। যেন বা সাক্ষী হয়ে আছে এই গ্রামের। এখানে একদিন কোলাহল ছিল। হাটবাজার ছিল। শিশুদের হাসি কান্না ছিল।
মানুষ ছিল মানুষ।
কাছে যাই বা না যাই পাহাড় আমাকে ডাকে। নতুন গল্প শোনাবে? শোনাবে বৈকি।
পাহাড়ের মাথায় উঠেছিল নিশ্চয়ই তরুণ তরুণীরা। যাদের কাছে উচ্ছেদের গল্প অজানা। যারা জানেনা, পাহাড়ের ছায়ায় পাহাড়ের কোলে গাই-গরু, ছাগল-ভেড়ার চরে বেড়ানোর শব্দ লুকিয়ে আছে আজও।
আমাকে তো বলবেই এই গল্প এই কথা। নীরব ভাষায়। পাহাড়ের এই মাথা উঁচু করা গল্পের কাছে নিজেকে ছোট লাগে। তার কাছে যেতেও ভয় করে আমার।
আমার নিজের গল্প ঘরের কোণে চুপটি করে থাকা। তাকে আর কি বলবো। ইচ্ছে তো করে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে কোনো গাছ আঁকড়ে দিন কাটাই। এজন্য সাহস লাগে। পিছুটান বর্জন করতে হয়। ভালবাসতে হয়, নীরব ভাষা।
আকাশ আর পাহাড় প্রতিদিন কথা বললেও, আমাকে ডাকে। আমি যাবো যাবো করেও একইভাবে ঘরের ভিতরে অন্ধকার।
পাহাড়তলির গ্রামে ছিল এক কবি। যার কোনো পরিচিতি ছিল না। কারণ, তার কবিতা আলোর মুখ দেখেনি কখনো। কবি শুধু পাহাড়ের কাছে এসে পাহাড়কে সকাল-সন্ধ্যে শুনিয়ে গেছে, একটার পর একটা কবিতা। সেইসব কবিতায় ছিল জনজীবনের ঝংকার। এ সমস্তই পাহাড়ের কাছে শুনেছি। একদিন।
সেই একদিন প্রতিদিন হয়ে উঠলে নতুন নতুন গল্প জীবনের স্পর্শ লাগা, মায়া লেগে থাকা ইতিহাস শোনা যেতো। সেরকমই আশা এখনও।
আমি যে আজ চৌকাঠ ডিঙিয়ে পাহাড়ের হাওয়ার কাছে যেতেই পারিনা। কেবলই, একা থাকতে থাকতে ভাতের থালার কাছে এসে স্তব্ধ হয়ে থাকি।
আমার স্তব্ধতা কার সঙ্গে ভাগ করবো? নিজের নিজের জায়গায় সবাই যে খুঁজে বেড়াচ্ছে, খেজুর রস তালের রস।
-----২২ চৈত্র ১৪২৯
-----৬---৪--২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৫
দরজাটা খোলাই আছে। খোলাই থাকে সারাদিন। শুকনো পাতা ঢুকে পড়ছে ঘরে। কখনো কখনো হাওয়ার সঙ্গে ছেঁড়া কাগজ। কুটোকাটা।
ঘরে কেউ নেই?
কোনো কোনো পাখি উঁকি দিতে এসেও ফিরে গেছে। ঘরে আছে একটি কলসি। বিবর্ণ। আর খোলা আছে ধুলো-ময়লা একটি খাতা।
কী লেখা আছে খাতায়?
আলো অন্ধকার ঘরের ভিতরে চলাচল করলেও খাতায় কি আছে জানে না। যে দু'চারটে টিকটিকি ঘুরে বেড়ায়, তারাও জানে না, কি আছে।
অনেকদিন আগে একটা পায়রা ঘরের ভিতরে এসে খুঁজে পেয়েছিল একটি মাত্র ধান। সে দেখতে পায়নি অন্য কিছু আর।
ঝড় বৃষ্টি এলে দরজার কপাট নড়েচড়ে। বন্ধ হয়েও যায়। খুলেও যায়। একবার এক পাগল এই ঘরে থাকার চেষ্টা করেও পালিয়ে গেছে। ছিঁচকে চোর ঢুকতে পারে না। যেন অলিখিত এক নিষেধ বাণী ঘুরে বেড়ায়।
দরজা খোলাই আছে। খোলাই থাকে। অনবরত। খাতার পাতা কখনো কখনো উড়তে উড়তে কিছু বলতে চায়।
কাকে বলতে চায়?
কে আছে কোথায়?
কুলঙ্গির একটা প্রদীপে আধ পোড়া সলতে। কবে জ্বলেছিল? কে জ্বালিয়েছিল? দেয়ালে কি যেন একটা নাম, স্পষ্ট নয়। আবছা হয়ে গেছে আয়নার কাঁচ।
কে মুখ দেখেছিল?
কার মুখের আলোয় আলোকিত হয়েছিল আয়না?
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গেছে। ছিঁড়ে গেছে তার। ছেঁড়া তারে ঝুল অন্ধকার। হেলে পড়ে আছে কলসি।
কোনোদিন জল ছিল।
তৃষ্ণা ছিল কোনো মানুষের।
সে তৃষ্ণা কেমন তুমি দেখেছো?
----২৩ চৈত্র ১৪২৯
----৭---৪--২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন