গাছের মাথায় তারা জ্বলে
শ্যাম ভাইয়া----
হ্যাঁ শ্যাম ভাইয়াকে যখন ইচ্ছে ডাকলে সাড়া পাবো এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
সেই নিশ্চিন্ততা থেকে আমাদের বন্ধুত্বের বয়স হয়ে গেল ৪০ বছরের বেশি।
বন্ধুত্বের বুনন সুতোয় বোনা নয়
বলে ছিঁড়ে যায়নি। ধারাবাহিক
আমাদের সম্পর্ক, নিঃশব্দ।
এমনটা নয় যে তার সঙ্গে প্রতিদিন
আড্ডা হয়। কথা হয়। ফোনাফুনি হয়। এমনটা নয় যে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নিয়মিত। তবুও বলতে পারি, একটা অদৃশ্য টান আছে আমাদের মধ্যে। এ কারণেই
হঠাৎ হঠাৎ-----
কেমন আছেন?
অনেকদিন কথা হয়নি।
লেখালিখি চলছে?
লেখালিখির সূত্রেই শ্যাম ভাইয়ার
কাছাকাছি এসেছি আমি ও সৈকত।
শ্যাম ভাইয়া -------পিতৃদত্ত নাম
শ্যাম রাজগড়িয়া। শ্যাম অবিনাশ
নামে কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন।
হিন্দি ভাষায় তার দুটি কবিতার বই আছে। দুটি গল্পের বই আছে।
বাংলাতে অনুবাদ প্রকাশিত।
কবিতার বইটির অনুবাদ করেছে
শুকতারা মিত্র।
শ্যাম ভাইয়া হিন্দি সাহিত্যের একজন কবি হলেও বাংলা সাহিত্যের খবর তার কাছে সব সময়। কালীকৃষ্ণ গুহর প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হলে তিনি আগ্রহ দেখান। গৌতম বসুর প্রবন্ধের বই তিনি সংগ্রহ করেন।
কে কোথায় কি লিখছেন এই বাংলায় তার কাছে তো খবর থাকেই তার সঙ্গে দেখা যায়
কোনো তরুণ কবির কবিতার বই তার কাছে।
বরাবর তিনি আড়ালে থাকেন।
আমাদের পুরুলিয়ার অধিকাংশ মানুষ এবং কবি-লেখকরা তাকে চেনেন না।
৭০ দশকের দু চারজন কবি
তাদের কবিতা শ্যাম ভাইয়াকে দিয়ে হিন্দিতে অনুবাদ করিয়েছেন।
এই মানুষটি আগাগোড়া সুভদ্র।
শিল্পসাহিত্য বাদেও ইতিহাস, বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়েও তার অতি উৎসাহ।
তার সঙ্গে আড্ডায় বসলে, কথায় কথায় তিনি বলে ফেলেন, কোন্ সার ফসলের ক্ষতি করে। কোন্ সারে ফসলের লাভ।
আমার লাভ হয়েছে, তার সঙ্গ পাই। মনে মনে। অবিরত। তিনি যেন গ্রীষ্ম দিনের তরমুজ। বাইরে থেকে আঁচ পাওয়া যাবে না ভেতরে কি আছে। অথচ তরমুজকে দুভাগ করলেই, শাঁসালো জল। সুমিষ্ট।
আরেকটা কথা বলা যায়, তার সঙ্গে জল--জঙ্গল--জমির আত্মীয়তা অনুভব করি। সেইসঙ্গে অবশ্যই তিনি একটি পাহাড়ও।
যার কাছে যাওয়া যায়। দাঁড়ানো যায়।
শুধু ঘরে নিয়ে আসা যায় না।
তার সঙ্গে আমার কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে অর্থনীতি নিয়ে অনেক কথা হয়। পুরুলিয়ার জল কষ্ট নিয়ে কথা হয়।
তিনি পুরুলিয়ার সন্তান।
পুরুলিয়ার প্রতি তার অমোঘ টান।
অযোধ্যা পাহাড়ে গাছ কাটা হলে
তিনি কেঁপে ওঠেন। তিলাবনি পাহাড় ভাঙ্গার চক্রান্তে তিনি কষ্ট পেয়ে থাকেন।
এই তো স্বাভাবিক।
তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ। যার বাবা দুর্গা রাজগড়িয়া
তার সন্তানদের বলেছিলেন--------ওষুধের দোকান খুললে কি মনে হয় জানো? মনে হয়, আমরা মানুষের রোগ জ্বালা খুঁজছি, ওষুধ বিক্রি করবো।
সেই দুর্গা রাজগড়িয়ার প্রথম পুত্র সন্তান আমাদের শ্যাম ভাইয়া।
শীতের সময় তাকে বললাম, অমুক নাচনি শিল্পীর জন্য একটা কম্বল দিতে হবে ভাই।
তিনি যথাসময়ে পাঠিয়ে দিলেন।
অথবা তমুক গাঁয়ে দশরথ মাহাতর মেয়ের বিয়েতে আপনাকে সাহায্য করতে হবে।
তিনি "না"করতে জানেন না।
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন।
অনেকবার অনেক সাহিত্য গোষ্ঠী
তাকে সংবর্ধিত করতে চেয়ে হতাশ হয়েছেন।
না, তিনি সামনে যাবেন না। নিজেকে সবসময় আড়ালে রেখে নিজের কাজ করে যাবেন।
তার ভাই সন্তোষ রাজ গড়িয়া
আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে খুবই বিখ্যাত। তার কথা বলতে যতটা আগ্রহী তিনি ততটাই নীরব নিজের বিষয়ে।
আমি তো সবসময় তাকে জ্বালাতন করি। আমার আঙ্গুলে ছুঁচ ফুটলেও শ্যাম ভাইয়াকে জানাই। কেননা আমি জানি, আমার যে কোনো ছোট থেকে বড় বিপদ অব্দি তিনি আমাকে উদ্ধার করবেন।
আমার বড়দি যখন বেঁচে তখন
শ্যাম ভাইয়া বড়দির প্রেসারের
ওষুধ আমাকে জোগান দিয়ে গেছেন। নিয়মিত।
সৃজনশীল অবশ্যই। আর তাই,
তিনি মনেপ্রাণে সজীব। তার সৌন্দর্যের কাছে সৌরভ পেয়ে থাকি।
তিনি জানেন, লম্ফর তেল ফুরিয়ে গেলে চাঁদ তারার আলো উস্কে দিতে হয়। এবং জ্বালাতে হয় অন্তরের আলো।
তিনি উর্দু সাহিত্য থেকেও রসদ গ্রহণ করেন। এবং ভারতীয় সাহিত্যের বাইরেও তার অবাধ যাতায়াত।
স্তব্ধতার সঙ্গে আমি দেখি।
তার ছেলে তার ভাইপো ফটোগ্রাফিতে নানান পুরস্কারে পুরস্কৃত। কিন্তু তিনি এবং তার পরিবার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বেড়ান না। তার ভাইয়ের কথা পশ্চিমবঙ্গ
ও ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সাত সাগর পার। সেই সন্তোষ রাজগড়িয়াও
নিজের বিষয়ে সব সময় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।
এদের কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন প্রকৃতির কাছ থেকে সবসময় শিক্ষা নিয়ে থাকি।
এই সুভদ্র মানুষটির জীবন যাপনে কোনো আড়ম্বর নেই। তিনি গাছের মাথায় একটি তারা।
আমি দেখতে না চাইলেও তারাটি আমাকে দেখবে।
-------১৩ বৈশাখ ১৪২৯
------২৭----৪----২০২৯
------নির্মল হালদার
ছবি : আলোক অবিনাশের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
আরও পড়ুন


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন