জন্মদিনের কথা / নির্মল হালদার
_______________________________________________
জন্মদিন এসেছিল। চলেও গেল।
আরতো মায়ের কোল নেই। এখন
ধুলোবালি মাখা ধরিত্রীর কোল। এখান থেকেই বলতে চাই, সেদিন
আমার তরুণ বন্ধুদের কাছে বলতে পারিনি, যে, আমি একজন
রক্তমাংসের মানুষ। দোষে-গুণে একজন মানুষ। আমাকে সেভাবেই সবাই দেখো। বিচার করো।
আমি আমার তরুণ বন্ধুদের চেয়ে বড় বলে আমি কোনো ভুল করতে পারি না, এমনটা নয়।
এখনো আমার ভেতরে প্রেম অপ্রেম, মান অভিমান, বিরহ এবং
ঈর্ষাও আছে।তা যত ক্ষুদ্র ই হোক
আছে। তাই আমার ভেতরে ক্রোধ আছে। রক্তচাপ আছে। এর ফলে,
আমিও উত্তেজিত হই। রেগে যাই।
প্রতি বছর জন্মদিন এলে, মনে মনে স্থির করি, মনের ভিতরে যা যা কুদোষ কু-সংস্কার আছে, এবছর থেকে কাটিয়ে উঠবো।
অনেক শান্ত হবো। ধীর।
অযথা ছটফটানি কাটিয়ে
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো। অথবা একটি গাছের রূপ কল্পনা করবো।
দেখি,
প্রায় একই রকম থেকে যাচ্ছি।
দেখি,
আমার অস্থিরতা কাটছে না।
দেখি,
দিনের-পর-দিন উদ্বেগ বাড়ছে।
অথচ হাত বাড়ালেই, কোনো না কোনো বন্ধু। বন্ধুর হাত।
আমার সহায়ক।
নির্ভরতাও কাটিয়ে উঠতে হবে।
যতই ঠিক করি নির্ভরতা এসে যায়। এবং নির্ভরতা যে ক্ষতিকর
এ জেনে-বুঝেও আমি যখন
কারোর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠি,
কোনো কিছুর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠি, তখন নিজের প্রতি রাগ হয়। আত্মগ্লানি হয়।
এ সমস্ত জানবেনা বুঝবেও না
আমার চারপাশ। আর কেনইবা বুঝবে? নিজেকে সংশোধন করতে করতে এগিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র কাজ।
তো, এ বছরের জন্মদিনে এই শ্রাবণ এসে আমাকে ভেজাতে ভেজাতে কতদূর নিয়ে যাবে, জানিনা। শুধু জানি, আকাশের মত উদার হয়ে প্রশস্ত হয়ে আমার চারপাশ দেখা দরকার।
এই জন্মদিনে এই অঙ্গীকার কি করলাম না?
চোখের জলে ধরিত্রীর কোল
ভেজাবার আগে আমি যেন
ভালোবাসায় ভিজতে পারি। যেন
ভালোবাসায় ভেজাতে পারি।
-----২৩ শ্রাবণ ১৪২৮
-----৯----৮---২০২১
-----নির্মল হালদার
কবি নির্মল নাকি একটি নির্মল কবিতা প্রবাহ...
তপন পাত্র
স্তন্যপায়ী মাত্রেরই দ্বিজত্ব আছে । একবার সে জন্মায় মাতৃগর্ভে আরেকবার এই বসুমাতার কোলে । ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষণটি দৃষ্টিগোচর কিন্তু গর্ভস্থ হওয়ার মুহূর্তটি অদেখাই থেকে যায় । এই দ্বিজত্বও মানুষের ক্ষেত্রে 'বাহ্য' । ক্ষণে ক্ষণে তার নবজন্ম এবং প্রায়শই তা ঘটে নিজের অগোচরে , অলক্ষ্যে । একটি খোলামকুচির ভুবন থেকে পরবর্তী সময়ে তিলে তিলে জন্ম নেয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কে হাতের তালুতে আনার বাসনা । তাই প্রতিমুহূর্তে মানুষের মৃত্যু , মানুষের নবজনম ।
একটি তাল গাছ একটি খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি হঠাৎ কখন ঝরে পড়লো একটি ডাল , ওদিকে ততক্ষণে গজিয়ে উঠেছে অন্য একটি নতুন শাখা । বৃদ্ধির, উত্তরণের এই তো চিরচেনা জন্ম-মৃত্যু । একটি জীবন মানে অনেকগুলি জন্ম । বেশ কতকগুলো জন্মক্ষণ ।
এত কথা কেন ? এত হেঁয়ালি কীসের ? সে কথাই খুলে বলি । এখন তো প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কানে আসে জন্মদিনের খবর । কিন্তু কারো জন্মদিনটা যখন অন্যদের কাছে পালনের প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে , একটা তাৎপর্য বাসা বাঁধে মনের নিভৃতে , তখন সেটাই হয়ে ওঠে প্রকৃত জন্ম-জয়ন্তী । ফি বছর আপনজনদের কাছে, প্রিয় মানুষজনের কাছে , কবি বন্ধু, পাঠক অনুরাগীদের কাছে কবি নির্মল হালদারের জন্মদিন একটি উদযাপনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে । অনাড়ম্বর আন্তরিক গানে, কবিতায় , গল্পে ,কথায় , হাসিতে-রসে , হাস্যরসে । একুশে শ্রাবণ বাংলার কবি নির্মল হালদারের শুভ জন্মদিন । কিন্তু আমি যতটুকু দেখেছি প্রতিদিনই তাঁর নবজন্ম । মনে প্রশ্ন জাগে -- তিনি কবি ,না কি নিজেই একটি আস্ত জীবন্ত কবিতা ?
সেই ছাতিমতলার বন্ধুসকল , সেই "ধান ও জলের ধ্বনি" থেকে শুরু করে অগণিত , অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের একটিও যত্ন করে সাজানো নেই নিজের পাঠগৃহে । বলা ভালো তাঁর গৃহের কোন শ্রেণীবিভাগই নেই , যেখানে লেখা , সেখানেই পাঠ , সেখানেই ক্ষুধার উৎপত্তি , সেখানেই ক্ষুধানিবৃত্তি , সেখানেই জাগরণ , সেখানেই আলস্যের আগমন , সেখানেই মাটিতে খেজুর পাতার তালাই বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়া । বই রাখার যেমন তাক নেই তেমনি নিজের বলতে সাড়ে তিন হাত রেখে দেওয়ার মতো একটা তক্তপোশের ওপর বিছানাও নেই । নেই কারণ তিনি চান না । এ এক মানুষের এক জীবনের মাঝেই অন্যতর নবজন্ম ।
পুরস্কারের পর পুরস্কার , মানপত্রের পর মানপত্র .....একটিও কোথাও সাজিয়ে রাখা নেই । কিছুই সঞ্চয় করেন নি তিনি । যখন যার প্রতি ভালোবাসা উপচে পড়েছে, তখন সেই তার ঘর সংসারের মালিক , সেই তাঁর স্বত্বভোগি । এগুলি তাঁর জন্মদিনের কথা নয়, এগুলি তাঁর এক জন্মে নব নবজন্মের কথা । সারাবাংলায় , বহির্বাংলায় যতো বই বেরিয়েছে বিগত ৫০ বছরে, তার অনেকটাই সৌজন্য সংখ্যা হয়ে তাঁর হাতে এসে পৌঁছেছে । কিন্তু হাতে নেই একটিও । যে যখন সামনে , তার হাতে তুলে দিয়েই নিজের রিক্ত হাত পূর্ণ করেছেন । এ আর এক নবজন্ম । সম্মানে তাঁর বিশ্বাস নেই, ভালোবাসায় পূর্ণ আস্থা । ব্যথা আছে, বেদনা আছে, শূন্যতা আছে; কিন্তু গোমড়া মুখ নেই ! তাঁর প্রত্যেকটি ছবির দিকে তাকালেই দেখি তিনি হাসছেন । এ তাঁর জন্মদিনের কথা নয়, এক একটি নবজন্মের পরিচয় । প্রতিটি ক্ষণে যাঁর নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ দৃষ্টিগোচর হয় , কেমন করে বুঝবো ঠিক কবে তাঁর জন্মদিন ! কত হলো তার তারুণ্যের বয়স !
তিনি মহাদেবের মতো উদার । মহাদেবের মতো ভিখিরি । একের কাছে চেয়ে নেন, অন্যের হাতে তুলে দেন । যার কাছে নেন, তার সাথে আত্মীয়তা আর যাকে দেন তার সাথে কুটুম্বিতা । এ এক অদ্ভুত ঘটকালি , এ এক কাব্যময় মধ্যস্থতা । যাঁর প্রেমময় মধ্যস্থতায় কাঁকর থেকে হেঁটে আসেন কবি , মাটি থেকে উঠে আসে কবিতা । তাই তাঁর জন্মদিন বড়ো কথা নয়, ক্ষণে ক্ষণে তাঁর নব জন্ম --এটাই বড়ো কথা । তিনি কতো বড়ো কবি সে প্রশ্ন নিজেকে করি না , তাঁর গোটা জীবনটাই একটা আস্ত কবিতাপ্রবাহ --এটুকু স্থির বিশ্বাস রাখি ।
জন্মদিন আসলে একটা মিলনের দিন
কল্পোত্তম
অনিকেতের পক্ষ থেকে কবি নির্মল হালদারের জন্মদিন পালন করা হয়ে থাকে প্রায় প্রতিবছর। সেও এক সর্বাঙ্গীণ রঙিন উৎসবের মধ্য দিয়ে। নাচ, গান, কবিতা পাঠ, আলোচনাচক্র, আড্ডা, সবই হয়ে থাকে এই উৎসবে। বলতে গেলে সেটা হয়ে ওঠে অনিকেতের বন্ধুদের এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদের মিলন উৎসব। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ফলে লকডাউনের সময় থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলাম আমরা। বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না কবির সাথে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগটাই চলে এলো হঠাৎ করে। প্রায় সকলেই পৌঁছে গেলাম কবির বাড়ি। তারপর হৈ-হুল্লোড়।
৭ আগস্ট জন্মদিন, ৮ আগস্ট রোববার জড়ো হলো সবাই। ছুটির দিন। না আসার বাহানা নেই।
কেক কাটার বিষয়টা ভারতীয় রীতিনীতির বাইরে হলেও আবেগ কোনো কিছুই মানে না। তাই কবির পছন্দের বাইরে গিয়েও ৮ আগস্ট সকাল থেকে পরপর কাটা হলো অনেকগুলো কেক। কখনও আলোকচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে তো কখনও কবি-সাহিত্যিক, নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই কবির।
কবি শুধু হাসতে জানেন, ভাবতে জানেন, কাঁদতে জানেন। মনের মতো মানুষ পেলে ভালোবাসায় বাঁধতে জানেন। জানেন শুধু বিলিয়ে দিতে নিজের হৃদয় জনে জনে।
সেই কবির জন্মদিনের বাহানা পেয়ে আমিও ছুটলাম চাষবাস ছেড়ে। একটাই তো দিন। কবির জন্মদিন। সেই দিনটার অপেক্ষায় অনায়াসে পেরিয়ে যায় একটা বছর। আমার বউ বলেছিল, দাদাকে একটা কিছু কিনে দিও। আমি বলেছিলাম, দূর-র-র, আমার দেওয়ার দরকার নেই। সে আবার বলেছিল, তুমি শুধু দাদার কাছ থেকে নিয়ে আসবে?
আমি আর কিছুই বলিনি। বলার মতো কিছু ছিলও না।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান অনেকেরই হয়। কিন্তু যৌথতার ভাবনা নিয়ে জন্মদিন পালন খুব সম্ভবত হয় না। তথা কথিত সেলিব্রিটি বা বিখ্যাতদের জন্মদিনেও সম্ভবত একটাই কেক কাটা হয় সে যত বড় আকারেরই হোক। যত দামিই হোক। কিন্তু কবির জন্মদিনের মতো ভালোবাসার মানুষরা দলে দলে আসছেন, কেক কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন এমনটা সম্ভবত বিরল।


































































কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন