আনন্দ-বেদনা / নির্মল হালদার
পাশের ঘরটা সব সময় বন্ধ থাকে।
সকালে একবার খুলে পরিষ্কার করে
বন্ধ করে দিই। সন্ধ্যেবেলা একবার খুলে ধুপ জ্বালাই। বাদবাকি সময়
ঘরটা বন্ধই থাকে।
হঠাৎ কখনো কোনো অতিথি এলে
শোওয়ার ব্যবস্থা করি। এছাড়া ঘরটাতে আমার কোনো কাজ থাকে না।
একেকদিন দরজা যেই খুলেছি,
মনে হয়, একটা নতুন ঘরে ঢুকছি।
সব অচেনা লাগে।
মনে আছে, একদিন ঘুমাবো ঠিক করলাম। শুয়ে পর খটমট করছে মন।
উঠে পড়লাম।
ঘরটার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ওঠা নামা হয়নি। তাই বুঝি, ঘরটার সঙ্গে
অভ্যস্ত হতে পারছি না।
এই ঘরটাতেই হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম
আমার পুরনো স্মৃতি। যেমন, আমার মনে পড়লো --------কিছু পুরোনো কাগজপত্র বই বিক্রি করে ছিলাম স্কুলে পড়াকালীন। তো একটা বইয়ের মধ্যে লুকানো ছিল একটা চিঠি।
ক্লাস নাইনের প্রেমপত্র।
মনে পড়তেই, মেয়েটির মুখ মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই মনে
পড়লোনা।
আরেকদিন দরজা খুলতেই, সেই কুকুরটা। আমি তখন ক্লাস ফাইভ।
কুকুরটা আমার খুব ন্যাওটা ছিলো।
যেখানেই গেছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে।
সেই কুকুরটা হঠাৎ হারিয়ে গেল।
আমি মুষড়ে পড়েছিলাম।
সন্ধ্যেবেলা।
কি একটা খুঁজতে ঘরটা খুলেছি।
দেখতে পেলাম মায়ের লক্ষ্মীর হাঁড়ি।
সেই লক্ষ্মীর হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে
আমি পুরনো টাকা পয়সা এবং রূপোর টাকা বের করছি।
ঘুগনি খাবো বন্ধুদের নিয়ে।
আমার মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো।
মাকে মনে পড়ছে।
ঘরের আলো জ্বালাইনি। আলো জ্বালতেই কোথাও কিছু নেই। কেবল
দেয়ালে ছবি। আলমারিতে বই।
আমার একটা ভয় তৈরি হলো। যে
ভয় থেকে ঘরটা খোলার সাহস পাই না। কিন্তু দুবেলা খুলতেই হবে। এবং আমি ভয়ে ভয়েই ঘরটা খুলি।
কাল যেমন, সকালবেলা তালা চাবি খুলে ঘরে ঢুকছি , দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে একজন। আমার শব্দ পেয়েই সে ঢাকা খুলে আমাকে বললো-------কেমন আছো হে?
আমি প্রদীপ রায়। চিনতে পারছো?
আমি থমকে দাঁড়াই।
কাল রাত্রে তো কেউ আসেনি?
আমিতো দরজা বন্ধ করেই, আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম। প্রদীপ রায় কিভাবে এলো?
প্রদীপ আমাকে চুপচাপ দেখে বলে,
তুমি ছিলে ক্লাস ফাইভ। আমি ছিলাম এক ক্লাস উপরে। মনে পড়ছে?
মনে পড়লেও মনে পড়ছে না,
কাল রাত্রে প্রদীপ কখন এলো আমার কাছে? মাঝরাত্রে কি? আমি কি তখন ঘুম ঘোরে ছিলাম?
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব।
ভাবছি------ঘরটা আর রাখবো না।
স্মৃতিরা আমাকে ক্লান্ত করছে। আমাকে বিধ্বস্ত করছে।
ভাবছি-------ঘরটাকে তুলে ফাঁকা মাঠের মধ্যে রেখে আসবো।
আজ দুপুরবেলা কি একটা বইয়ের জন্য ঘর খুলেছি। একটা ঝোড়ো হাওয়া আমাকে ধাক্কা দিলো খুব জোর। আমি পড়ে যেতে যেতে দরজাটা ধরে ফেললাম।
বন্ধ ঘরে ঝোড়ো হাওয়া?
দেখতে পাই, একটা শাড়ি।
সারা ঘরে উড়ছে।
কার শাড়ি?
আমার মনে পড়লো, রসিকা এসেছিল একদিন। সেই বোধ হয় ভুল করে শাড়িটা ফেলে গেছে।
কিন্তু আগে দেখতে পাইনি কেন?
ঘরটা আর খুলবো না।
ময়লা জমলে জমে উঠুক। যখন যেদিন অতিথি আসবে খুলবো।
দু' তিনদিন বন্ধ রাখার পরে
মনে পড়লো, ওই ঘরে টেবিল ফ্যান আছে। এই ঘরে নিয়ে আসা জরুরি।
ঘরটা খুলতেই দেখলাম, টেবিল ফ্যান নেই। একটা হাত পাখা পড়ে আছে মেঝেতে। সে বলে-------তুমি লম্ফর আলোতে বড় হয়ে উঠেছো।কোনো
ইলেকট্রিক লাইন ছিল না। তুমি আজ
টেবিল ফ্যান খুঁজছো?
এই সব স্মৃতি আমাকে আজ বিচলিত করে। স্মৃতিরা যে সততই দুঃখ-বেদনার ঘরটা ঢুকলেই আমি টের পেয়ে যাচ্ছি।
না না ঘরটাকে আর রাখতে চাই না।
সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর
বাড়িতে এসে শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন ডাকছে আমাকে।
কে?
কে?
কোনো উত্তর নেই।
বাইরে যাই।
কেউ কোথাও নেই। চারদিক অন্ধকার।
আমার মন কি ভুল শুনেছে?
আজ ঘরটা খুলতেই হবে। একটা কলমের দরকার। এই ঘরেতো কাগজ-কলম কিছুই থাকে না।
ঘর খুলে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। কোনো কারণে ইলেকট্রিক কানেকশন কাটা পড়েছে।
অন্ধকারেই আন্দাজে, আলমারি খুলে
ফেলি। হাৎড়াই, একটা কলমের জন্য।
না -----কলম পাই না। বদলে একটা ছোট কাগজের গোছা। বুঝতে পারছি না, কিসের গোছা।
ঘর থেকে বেরিয়ে এই ঘরে এসে দেখি
একটা নোটের বান্ডিল। সুতো দিয়ে বাঁধা। সঙ্গে একটা চিরকুট।
স্নেহের
গোরা
তুমি আমার কাছে কোনোদিন কিছুই
চাওনি। আমারও ক্ষমতা হয়নি তোমাকে কিছু দেবার। আজ
তোমার জন্য পাঁচ হাজার টাকা রেখে গেলাম তোমাকে না জানিয়ে। কারণ,
আজকের দিনে পাঁচ হাজার টাকা কিছুই না। আর আমারও এর বেশি ক্ষমতা নেই। অথচ তোমাকে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।
তুমি খুশিমনে গ্রহণ করলে, আমার ভালো লাগবে।
ভালো থেকো।
আশীর্বাদক
তোমার বাবা
আমার বাবা কবে এসেছিল?
আজ মনে হচ্ছে, আমারও একটা বাবা ছিল। যিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছেন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে।
যা আমি গুপ্তধনের মত আজ পেয়ে
মনে করছি, আমারও একটা শিকড় আছে। এবং এই ঘরটাও একটা শিকড়।
------৩১ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৭-----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার
ছবি : কল্পোত্তম

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন