বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৩

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৪



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৪
--------------------------------------------------------

ঘোরতর সংসারি মহিলা ছিল আমার মা। নিরক্ষর ছিল আমার মা। ভেতরে ভেতরে কবিও ছিল আমার মা।

কেমন কবি ছিল? মুখে মুখে রচনা কি করতো? না, সেরকম কিছুই না। তবে কাব্যবোধ ছিল প্রখর। আমাদের পরিবারে আমার বড়দার প্রথম পুত্র সন্তান যখন এলো, তখন আমার মা পুত্র সন্তানের নামকরণ করেছিল---নুপুর। নুপুর নামকরণের পিছনে মায়ের ব্যাখ্যা ছিল, ভগবানের পায়ে নুপুর হয়ে থাকবে।
ভগবানের পায়ে নুপুর হয়ে থাকলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না। এই ভাবনা কিম্বা শুভ বোধ থেকে আমার মায়ের এই নামকরণ, আজও আমাকে  শুভ চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। শুভকামনার দিকেও আমি যাত্রা করি।

আমার এই মা আমাকে একবার কলম উপহার দিয়েছিল। আসলে উপহার তো নয়, আশীর্বাদ। যে মা একদিন আমাকে ধমকের সুরে বলেছিল----লিখতে লিখতে ঠুঁটো হয়ে যাবি। বাক্যটি অভিশাপের মতো শোনালেও অভিশাপ ছিল না। মা কখনো সন্তানকে অভিশাপ দিতে পারে না। আমার আজ মনে হয়, মা আমাকে লেখালেখি করার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কলম দিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ মনে পড়ে-----কুসন্তান যদিও হয় কুমাতা কখনো নয়।

আমাদের এই সুজলাং সুফলাং বাংলায় যে সমস্ত প্রবাদ গুলি ছড়িয়ে আছে তা কাব্য সুষমায় জেগে আছে এখনো।

প্রবাদ আছে অনেক। মেয়েরা কথায় কথায় ব্যবহার করে। যেমন ছেলে বিয়েতে রাজি হচ্ছে না দেখে মা বলছে-----আমার ছেলে "ধনুক ভাঙ্গা পণ " করেছে। বিয়ে করবেনা। আরো একটি উদাহরণ----কোনো ঘরনী রেগে মেগে বলছে---সংসারের হাঁড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমার হলো " হাড়ে হলুদ "।

আমাদের সংসারের মেয়েরাও কবি। তাদের অন্তরেও কাব্যবোধ থাকে তার অজস্র উদাহরণ দিনরাত্রি মেয়েদের নানা কাজে শোনা যায়। সময়ে। অসময়ে।
কারোর প্রেম বিষয়ে বলতে গিয়ে সেদিন একটি মেয়ে আমাকে বললো---উয়ার পিরিত "বালির পিরিত "। উয়ার সঙে আমি নাই।

প্রবাদ প্রবচন এক রকমের কবিতা। শব্দ ব্যবহারেও কবিতার কণা দেখতে পাই।

এক সকাল বেলা আমার মা ঘর ঝাঁট দিতে দিতে যেন বা নিজেকে শুনিয়ে বলছে-----আর কি পারিরে বাবা 
গায়ের চামড়া লোল হয়ে গেল। আমার তখন জানা ছিল না "লোল "শব্দটির অর্থ। অনেক অনেক পরে জেনে  মায়ের কাছে নত হয়েছি। মনে মনে।

অনেক প্রবাদে হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ থাকে। অপমান থাকে। সেইসব প্রবাদের দিকে আমি যাচ্ছি না। "গোবরে পদ্মফুল ফোটে "এওতো এক রকমের বিদ্রুপ। অথবা "দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো "অশুভ এই প্রবাদ আমার পছন্দ নয়। আমরা কি সন্তান দুষ্টু হলে সন্তানকে বর্জন করি? 

ভাঁড়ারে খুঁজলে পাওয়া যাবে,"পেটে খিদা মুখে লাজ "। পাওয়া যাবে সমাজ জীবনের অনেক ছবি।যেমন ---"খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল এঁড়ে গরু কিনে"।

কালে কালে প্রবাদ প্রবচন লুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ প্রবাদ প্রবচন থেকেও আমরা পাই  জাতি গোষ্ঠী ধর্ম
ও সময়ের ছবি। 

ভয় করে, কাব্যশিল্প থেকেও আমরা যদি দূরে চলে যাই? আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি থেকেও যদি দূরে চলে যাই?

"পরের ধনে পোদ্দারি " করতে করতে আমাদের সময় যে চলে যাচ্ছে। আমরা ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে নিজের মাটিকে ভুলে যাচ্ছি।

----২৬ কার্তিক ১৪২৯
----১৩--১১--২০২২
----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ