আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১০
--------------------------------------------------------
"রাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে, বারেক ফিরে চাও।
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও।"
রাখাল ছেলে আমাদের পুরুলিয়াতে বাগাল ছেলে। গরু চরানো যাদের পেশা। যে জীবিকা থেকে দিনাতিপাত। ক্রমশ যে জীবিকাও অবলুপ্তির পথে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকাও পাল্টে পাল্টে যায়।জানি। প্রশ্নটা হলো এই, যাদের জীবিকা পাল্টে যাচ্ছে তাদের বিকল্প কী দিতে পাচ্ছি?
আজ যখন বাগালি পেশাও লুপ্ত হওয়ার মুখে , তখন উপরে উল্লেখিত জসীমউদ্দীনের কবিতাটি আমার মনে পড়ে। মনে হয়, কোনো নির্জন মাঠে ছুটে যাই। দেখি, কোনো বাগাল ছেলে গাছ তলায় শুয়ে আছে কিনা।
শিল্প এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, জানি। সেও পাল্টাতে পাল্টাতে অনেক রূপ ধারণ করে।
রূপ যদি বিকৃত হয়?
জীবিকা হারানো বাগাল ছেলের কাছে অভাব অনটন যদি এসে দাঁড়ায় আমরা তার সমস্যা সমাধান করতে পারবো?
শিল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা, শিল্প যদি তার নিজস্ব রূপ হারিয়ে কংকাল হয়ে ওঠে, আমরা কোন্ দিকে চেয়ে থাকবো?
কোথায় পাবো শান্তি ও স্বস্তি?
একটা সময় তো ছিল যখন মাঠে-ঘাটে ঝুমুর হাঁকাতো বাগাল ছেলেরা। মুখে মুখে রচনা করতো ঝুমুরের পদ।
সারাদিন রোদে জলে হাওয়ায় মাঠে মাঠে গরু চরানোর একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি ছিল বাঁশি বাজানোর মধ্যেও।
এই রূপ তো আমরা দেখেছি শ্রীকৃষ্ণের । তিনিও তো গরু চরানো এক যুবক ছিলেন। প্রেম করেছেন রাধার সঙ্গে।
রাধা কৃষ্ণের প্রেম পুরনো হয়ে যায়নি তো? বাতিল হয়ে যায়নি তো তাদের প্রেমলীলা?
বৈষ্ণব পদাবলী আমাদেরই এক গ্রন্থ। ভুলে গেলে , আমাদেরই ক্ষয়ক্ষতি।
জসীমউদ্দীনকে মনে পড়ে তো?
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত? কালিদাস রায়?
বিহারীলাল চক্রবর্তীকে কজন মনে রেখেছি?
কবিরা নিশ্চয়ই কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসের কাছেও আছেন। এই আশা থেকেই আমার প্রশ্ন, অদ্বৈত মল্লবর্মণের খোঁজ করেন তো? জগদীশ গুপ্তের খোঁজ আছে আপনাদের কাছে?
শিল্পের বিভিন্ন শাখায় আসা-যাওয়া করলেই ঋদ্ধ হয়ে ওঠা যায়। নন্দলালের ছবি দেখতে দেখতেই প্রকাশ কর্মকারের চিত্রকলা। অবন ঠাকুর থেকে যামিনী রায়। গগনেন্দ্র নাথ ঠাকুর থেকে বিনোদ বিহারী।
যোগেন চৌধুরীর চিত্রপটের কাছে দাঁড়িয়ে খোঁজ করবো সমীর আইচের।
অনেকদিন দেখতে পাচ্ছি না মনোজ দত্তকে। যে বাংলার লোকশিল্পের বীজ নিয়ে ছবি আঁকে।
ভাস্কর্য শিল্পে কারা আছেন?
খোঁজ করতে করতে আশা করি দেখতে পাবো নতুন উজ্জ্বল মুখ।
ভরসার জায়গা।
শুধু চমক আর অন্ত্যমিলে কবিতা কী হয়? যদি বুকের পাঁজরে ধাক্কা না মারে কবিতার বিষয়?
বিষয় তো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। নিজের ঘরের কোণে কোণে মাকড়সার ঝুল। অথবা খসে পড়ছে দেয়ালের রঙ। ইঁদুরের লাফ-ঝাঁপ। উল্টে গেছে জলের গ্লাস।
আকাশ ও মাটিতেও কত রঙ কত বিন্যাস। একটা ডালে ফুল।অন্য একটি ডালে ধরে আছে ফল।আরেকটা ডাল পত্র পল্লবহীন।
মাটি কোথাও নরম হয়ে আছে। মাটি কোথাও কঠিন হয়ে আছে। আকাশে আকাশে হাতি ঘোড়া। খরগোশ। পরীও আছে ডানা মেলে।
কিঞ্চিৎ মন খারাপও আছে। ঘরের মেঝেতে চায়ের কাপের দাগ। দু-একটা মুড়ির দানা পায়ের তলে পড়ে চ্যাপ্টা।
বাঙলা কবিতা চ্যাপ্টা হয়ে গেলে গাছে গাছে আর পাবোনা ফলের সুবাস। ফুলের বর্ণচ্ছটা।
আমাদের ছোট নদীই তো আমাদের অববাহিকা। ছোট বোনের মতোই আদুরে। তাকে ছেড়ে থাকার কথা কল্পনা করতেই পারি না। বৈশাখ মাসে তার যতই হাঁটু জল থাকুক, সেই তো আমাদের একমাত্র বোন। দিদিও। তাকে আমি "বুড়ি "বলে থাকি। যে বুড়ির মুখে শুনেছি আমার সেই ছোটবেলায়---
মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই
আমি তো দাঁড়িয়েই গেছি, ভয় করছে এগিয়ে আর রাস্তা পাবো তো? মৃদু কন্ঠের এক স্বর আমারই দিকে----
আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
যদু মাস্টার শ্বশুর বাড়ি
রেল কম্ ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম।
আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে।
যেতেই হবে।
শিকড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
আমি যাই----
আমি যে জানি----
কাননে কুসুম কলি, সকলি ফুটিল।।
----১৯ কার্তিক ১৪২৯
----৬---১১---২০২২
----নির্মল হালদার
আরও পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন