আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯১
----------------------------------------------------------
প্রভাব?
প্রভাব তো পড়ে। পারিবারিক প্রভাব। পরিবেশের প্রভাব। সামাজিক প্রভাব। কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাবও পড়ে। কমবেশি। সবার জীবনে।
প্রাকৃতিক প্রভাবও পড়ে। তবে অনুভবে ধরা পড়ে না।
প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক প্রভাব পড়বেই মানুষের উপরে।
একটা গাছ, শুধু একটা গাছ প্রভাবিত করতে পারে একটা জীবনকে। গাছ তার ডালপালা দিয়ে শিকড় দিয়ে ফুল ফল দিয়ে মানুষকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে। মানুষও গাছের নিকটে বিনত হয়। মানুষের মনেও হয়ে থাকে যে গাছের মতো ধৈর্য, উদার, সহনশীল এবং ফলবতী হতেই হবে। সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে একথা না--খাটলেও কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অবশ্যই।
যে শিশুর জন্ম পাহাড়তলির গ্রামে তার উপরে পাহাড়ের প্রভাব থাকবে না? যে শিশুর জন্ম জঙ্গলের কাছে নদীর কাছে, তার উপরে নদী ও জঙ্গলের প্রভাব থাকবে না?
আমার জন্ম তো মানুষের ঘরে। আর মানুষের ঘর বলেই, নানা রকম ক্রিয়া-কর্ম, লোকাচার, ব্রত, পুজো, পালা পার্বণ এবং বৃহস্পতিবারের আলপনা। আমাকে হ্যাঁ আমাকে, অতি অবশ্যই প্রভাবিত করেছে। এই তো
স্বাভাবিক। সহজ।
ছেলে যেমন বাবার কণ্ঠস্বর পেয়ে থাকে, তেমনি পরিবারের টানাপোড়েন থেকেও প্রভাব আসে। পরিবারের ধর্মাচরণ বা নাস্তিকতাও মানুষের জীবনকে
চালিত করে। প্রভাবিতও করে। তা কতটা সুন্দর কতটা অসুন্দর মানুষ নিজে কি বুঝতে পারে?
তুলসি খানের শান্ত স্নিগ্ধ নীরবতা আমার যে মনে পড়ে, এও তো এক রকমের প্রভাব। গোয়াল ঘরে বাছুরের ডাক আমার মনে পড়ে, এও তো আরেক প্রভাব।
মায়ের দেওয়া একটি কলম হারিয়ে গেলেও আমার জীবনে জড়িয়ে আছে তার কালির স্রোত।
পাশ্চাত্যের প্রভাব?
আমি তো লেখাপড়া করিনি। আমি তো লেখাপড়া করি না। আমার কাব্যদর্শনে কে আছে না আছে আমার জানা নেই।
তবে জানি, আমার চলার পথে আর কারোর পায়ের শব্দ নেই, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
----বেলা--৪--৩৬
-----১৮ ফাগুন ১৪২৯
------৩---৩---২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ ---৯২
---------------------------------------------------------
কখনো কোনোদিন একটা কবিতা আমাকে হয়রান করে মারে। তিনটে লাইন লেখার পর, বাকিগুলো এসে দাঁড়ায় না আমার কাছে। আমি না পারি ঘরে থাকতে, না পারি বাইরে থাকতে। অস্থির হয়ে উঠি। নিজেকে শান্ত করতে কোনো একটি কবিতা-বইয়ের পাতা উল্টাই। না, অস্থিরতা কাটে না। মনে হয়, এ জীবনে আর লিখতে পারবো না। এও ঠিক, এখনো অবধি কিছুই লিখতে পারিনি। যা লিখতে চাই যা বলতে চাই কিছুই পারিনি। কেবল মন খারাপে দিন যায়।
দিন যায় রে বিষাদে।
এই যে এই ফাগুনে পুরুলিয়ার চারদিকে পলাশের প্লাবন। তার উদ্দামতা আমি লিখে উঠতে পারি না। মহুলের গন্ধে গন্ধে যে বাতাস ছুটছে এখন তাকে ধরতে পারিনি। পারবো না। ফেটে পড়ছে শিমুল। তার যৌবন নিয়ে রঙ নিয়ে আমাদের কাছেই ফেটে পড়ছে। ধরিত্রীর কাছে নিবেদিত হয়ে জানান দিচ্ছে তার যৌবন। অথবা তার অস্তিত্ব।
আমি কাগজে কলমে আঁচড় কাটতে অসহায় বোধ করছি।
আমার অসহায়তা এই কারণে দীর্ঘ হয়ে ওঠে। আমি লিখতে পারি না। সারাদিন একটা লেখার পিছনে যদি পড়ে থাকি আহার নিদ্রা বন্ধ হয়ে যাবে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বই কাছে টেনে নিই। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই কবি দেবদূত। সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মাটিতে একদিন নেমে এসেছিলেন। আমি তো ভিখারি। প্রতিদিন আমার ভিক্ষার ঝুলিতে ভিক্ষা না পড়তেই পারে। কিন্তু ভিক্ষা করে যেতে হবে। বারো মাস।
একটি কবিতার জন্য ভিক্ষা।
কবিতার কাটাকুটিতে আমার আস্থা নেই। অন্তর থেকে আসবে কবিতা। নিজেকে প্রশ্ন করেও থাকি, অন্তর কাহাকে বলে?
অন্তরের ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে আমার যে বেলা হলো অনেক। বাবুই পাখির বাসার মতো অন্তর যদি হয়ে থাকে, তার দুয়ারে আমার প্রবেশ আছে তো? ঝুমুর বা টুসু গানের কলিতেও আমি আমার ঠাঁই পেতে পারি। যদি সুর জানা থাকে।
সুরতো সেই অন্তরেই থাকে।
অন্তর কাহাকে বলে?
কখনো কোনো দিন পুরনো কবিতা মনে পড়লে, মুখ ফিরিয়ে নিই। আমার নিজেরই কবিতা, দুর্বল লাগে। মনে হয় আগে যা লিখেছি, এখনো যা লিখছি নিবেদনের মতো হয়নি। তাহলে মিছিমিছি এত এতগুলো দিন ক্ষয় করলাম? নিজের প্রতি রাগ হয়। বিরক্তি আসে। নতুন করে আরম্ভ করবো। আবার?
----বেলা--৩--৪৮
----২৫ ফাগুন ১৪২৯
------১০--৩--২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৯৩
---------------------------------------------------------
শুধু কি মুদ্রিত কবিতার দিকেই থাকবো? তার কাঁটাছেঁড়া তার তাত্ত্বিকতা বিষয়ে আমাদের শুধু আলোচনা চলবে? পন্ডিতি সমালোচনা, কাগুজে সমালোচনা অথবা অধ্যাপকীয় সমালোচনা আর কতদিন সহ্য করবো?
ওই যে পলাশ গাছে তিনটে পাতা, একজন মা আর একজন বাবা আরেকজন একটি সন্তান। চেয়ে আছে আমাদের দিকে। এও তো এক চরাচরের কবিতা।
লক্ষ্য করতে ভুলে যাই।
গাছ তলায় ভিখারি মায়ের সংসার। উনুন জ্বলছে। ভাত ফোটার শব্দ আসছে গন্ধ আসছে।
কবিতা বলবোনা?
পাতা ঝরে পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতা উড়তে উড়তে কথা বলে। কার কথা? শুধু কি নিজেদের কথা? আমার মর্ম বেদনার কথাও তো বলছে। বলছে না?
মুদ্রিত অক্ষরের বাইরেও যে প্রাণ বয়ে যাচ্ছে অবিরত, যে প্রাণের ধারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন না সমালোচকরা, তাদের থেকে সরে আসার সময় হয়েছে কবি লেখকদের।
একটি তক্ষক ভাঙ্গা পাঁচিল থেকে দেখছে চারপাশ। আমিও তো দেখবো তাকে। একটি কুকুর খাদ্যের আশায় চেয়ে আছে মানুষের দিকে। এই কবিতার সত্য জীবন সমগ্রের কবিতা।
ছুঁয়ে দেখতে ভয় করে?
সাহসের অভাব সর্বত্র। কবি লেখকদের জগতেও ভয়। অসততা ঘিরে ধরেছে সমস্ত ক্ষেত্রে। ঝরে পড়া তারার ব্যথা কে ধরবে আঁজলায়?
প্রতিদিনের চন্দ্র সূর্য মহাকালের কবিতা। তাদের আলো গ্রহণ করতে করতে ভুলে যাই, তারা দূরে থেকেও অনেক কাছে। নিকট আত্মীয়। আত্মীয়তা আছে বলেই তো এত আলো। এই আলোর দিকে সমালোচকের দৃষ্টি যায় না। কবিদের দৃষ্টি গেলেও আংশিক। এই কারণেই, কবিতার ভেতরে আলোর কিরণ টুকু ঝাপসা লাগে।
বিষণ্ণতা হয়ে ওঠে সর্বক্ষণের সঙ্গী।
------৩/৩১
-----২৯ ফাগুন ১৪২৯
-----১৪---৩---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯৪
----------------------------------------------------------
" অমরত্ব " শব্দটির কাছে দাঁড়াতে গেলেই কবিদের বিপদ। অবিরত লিখে যাওয়া ছাড়া অথবা কবিতার সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কোনো লোভ ও চাহিদার দিকে যাওয়া যাবে না। কবি কীটপতঙ্গের কাছে যেতে পারে। যদি যেতে পারে, তাদের ভাষার সঙ্গে হয়ে উঠবে পরিচিত। তাদের সংসারের সঙ্গেও হবে পরিচয়। যদি গাছপালার কাছে কবি যায়, যদি যেতে পারে, পাতার গড়ন থেকে শিকড়ের সুর হয়তো বা জেনে যেতেও পারে।
অমরত্বের কাছে যাওয়া যাবে না।
কবি যেতে পারে মানুষের কাছে। সব সময়। কবির নিশান এখানেই।
---গোধূলি-৬/১
----৩০ ফাগুন ১৪২৯
-----১৫---৩---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৯৫
---------------------------------------------------------
দর্শন কত প্রকারের হয় এই প্রশ্নটা নিজের কাছে হলেও বোকা বোকা লাগছে। তবে কাব্য দর্শন যে একটা দর্শন, এ আমি জেনেও কুল পাইনি কাব্য দর্শনের।
কাব্য চর্চা করি অথবা কবিতা লিখি, যেমন পারি লিখে যাই। সেই কবিতারও একটা দর্শন থাকে। কি সেই দর্শন?
মনে আছে, একবার শঙ্খ বাবুর কাছে বলেছিলাম। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যায়নি। সম্ভবত বলেছিলাম, আলোক সরকারের কাব্য দর্শনের কথা।
অনেক চিন্তা করেও আমার কাছে ধরা পড়েনি, কাব্য দর্শনের রূপ। বরং হাজারো রকম প্রশ্ন এসেছে নিজের কাছে। যেমন, পাখি সব করে রব-এ, দর্শন আছে কি নেই? কুমোর পাড়ার গরুর গাড়িতে দর্শন আছে?
আমার মাথা হিজবিজ লাগে।
এখানেও প্রশ্ন, আমার মাথায় কি আছে? ছোটবেলার মাস্টারমশাইয়ের ভাষায় যদি বলি, গোবর আছে?
গোবরে তো দর্শন থাকে না। থাকে কি? জলে দর্শন থাকে না। জলের ভিতর জল বললেই, দর্শন দেখা যায়। তাইতো? দর্শন মানেই কি তত্ত্ব? আমার এতশত জিজ্ঞাসার উত্তর আমার বন্ধু রামানুজের কাছেই জানতে চাইবো। সে পড়াশোনা করা মানুষ, সবই তার জানা।
স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমার কবিতা বিশেষ কোনো মতবাদের প্রচার করেনা। আমার জীবনও তাই। কোনো মতাদর্শে আমি আজও কোনো আস্থা খুঁজে পাইনি।
যৌবনে বামপন্থার প্রতি অনুরাগ ছিল। তা কালে কালে ধুয়ে মুছে গেছে। উপলব্ধি করেছি, মানুষের দিকে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো রাস্তা নেই। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি আমার দুর্বলতা যদি আমার একমাত্র দর্শন হয়ে থাকে, কাব্য দর্শন হয়ে থাকে, তবে বলবো সেই দর্শন, শুভ বোধ থেকে সুন্দরতার দিকে।
একটি পাখি একা বসে থাকলে তার পাশে আরেকটি পাখি এসে বসে। একটি মানুষ একা থাকলে তার পাশে আরেকটি মানুষ এসে বসে না। কিন্তু আমি মানুষের পাশে মানুষকে দেখতে চাই। কেন না, মানুষের পাশে মানুষ না থাকলে নতুন নতুন সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যাবে না এ পৃথিবী।
-----দুপুর--২--৫৮
-----১ চৈত্র ১৪২৯
-----১৬---৩---২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন