আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৮৬
---------------------------------------------------------
একটা গীতবিতান থাকলে কবিতা লেখার প্রয়োজন পড়ে কি? গীতবিতানই একটি মহাকাব্য। তারপরে আমার কবিতা মানায় না।
মুরগির ডালা খুলে লাফিয়ে উঠল ভোর----এই পংক্তি আমার মেধা ও মননে আজও ঘুরঘুর করে। অথচ পংক্তিটিকে কবিতায় সার্থক করতে পারিনি।
হরিণের শিঙে লটকে গেছে চাঁদ-----তারপর তারপর কি? হরিণতো চাঁদ নিয়ে জঙ্গলে ছুটছে। শিঙে লটকে থাকা চাঁদের আলো ছুটছে। এই দৃশ্য আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি এগিয়ে যেতে পারি না। আমি একই জায়গায় ঘুরপাক খাই---হরিণের শিঙে লটকে গেছে চাঁদ।
আমার কল্পনা শক্তির প্রতি আমার সন্দেহ জাগে। আমার মনে হয়, আমি ক্ষীণ এক মানুষ। আমি দুর্বল। কল্পনাকে কবিতায় রূপ দেবার মত সমর্থ্য নেই।
স্নায়ুর চাপ পড়ে।
অস্থির লাগে। ছটফটানির সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। অশান্তি আসে। পিপাসা এলেও জলের কাছে যাই না। এরকম এক সময়ে নিজেকে শান্ত করতেই মনে পড়ে গীতবিতান। মনে হয়, আর লেখার দরকার নেই। আমি না লিখলেও বাংলা কবিতার ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
বসন্ত এলেই, রবীন্দ্রনাথের গান। বসন্তের গান। কই, অন্য কারোর কবিতার দিকে আমার মন তো ছুটে চলে না! একই রকম ভাবে গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত শীত শরৎ এলে, রবীন্দ্রনাথের গান। যা কবিতা। অম্লান।
চির নতুন।
মানুষের মন দেখতে পাই। প্রকৃতিকে দেখতে পাই।
প্রতিটি ঋতুর রূপ -রস-গন্ধ যে আলাদা তা গীতবিতানেই সত্য হয়ে আছে। এই সত্যকে ডিঙিয়ে
আমার কবিতা লেখা কোথাও কারো কাছেই যাবে না। আমি আর কেন লিখব?
নতুন কিছু কিংবা টাটকা কিছু বলার আছে কি? আঁকাড়া কবিতাও কি আমাকে ধরা দেবে?
আমার মনে হয়, সমস্তই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ গীতবিতানে। এই মহাকাব্যের কাছে আমি----দূর ছাই।
আমার স্নায়ুর চাপ থেকে অশান্তি থেকে মুক্তির এক ঠাঁই ------গীতবিতান।
অনেক অনেক সময় হয়েছে, গীতবিতানের একটি পংক্তি আমাকে স্থির করে দিয়েছে। আমি আর নড়তে চড়তে পারিনি।
আজ যেমন ক'রে গাইছে আকাশ তেমনি ক'রে গাও গো।
আমার কাছে আমার প্রশ্ন----কেমন ক'রে গাইছে আকাশ? কি আছে আকাশে? কিসের সুর? আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। মুখ নামিয়ে রাখি মাটিতেও। খুঁজে পাই না কোনো গান?
সূর্যতারা কি গান?
আকাশ কি রহস্যময় সুর? আকাশের রঙ কি কোনো ইশারা? ইঙ্গিত?
গীতবিতানে আরো অনেক আকাশ। এখানে আমার বলতে ইচ্ছে করছে----আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।
রবীন্দ্রনাথ তা পারতেন। আমার তো তেমন গান নেই। আমি দেয়ালে নখের আঁচড় কাটলেও কোনো অক্ষর ফুটবেনা। আমি কবিতার কাছে বারবার কেন যাব? কবিতা কি সহজ কোনো পাখি, ডাকলেই কাছে আসবে? আমি তো অস্থির একজন। আমি তো অসহায়। কেমন করে খুঁজতে হয় মনের মানুষ, আমি সাধনাই করলাম না। ডালপালা যে সহসাই উতলা হয়ে ওঠে, আমি লক্ষ্য করার বা চেয়ে দেখার অভ্যেসটাই করলাম না।
আমার কি কবিতা হয়?
ধানের খোসা খুললেই চাল হয়। কেমন করে খুলতে হয় খোসা?
-----বেলা---৪--১৫
----১০ ফাগুন ১৪২৯
-----২৩--২---২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮৭
----------------------------------------------------------
দুটি বক একই জলাশয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দুজন দু'জায়গায় থাকবে। একজন এপারে তো আরেকজন ওপারে। দুজন দু জায়গা থেকে জোগাড় করবে নিজেদের খাদ্য। হয় তো একই গাছে দুজনের বাসা। একই বাতাসে উড়েও এলো জলাশয়ের কাছে। খাদ্য জোগাড় করবে কিন্তু দু জায়গা থেকে। কেউ কারোর খাদ্যে ভাগ বসাবে না। এরকম এক বোঝাপড়া আছে। সেই কারণেই কারো সঙ্গে কারোর বাদ-বিবাদ নেই। কাড়াকাড়িও নেই, ধারণা করতেই পারি। বেলা শেষে ঘরে যখন ফিরছে একই সঙ্গে সবাই।
প্রকৃতি সকলের জন্যই উপকরণ সাজিয়ে রাখে। যে যার রুচি মতো পছন্দমতো সংগ্রহ করে। এই নিয়মের অঘটন ঘটলেই প্রকৃতির রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়।
কোনো কোনো কবি প্রকৃতি থেকেই নিজস্ব আহারের সন্ধান করে। কেউ ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কেউ কেউ সফল হয়ে মুঠো করে আমলকি।
ব্যর্থতা থেকেও কবিতা। সফলতা থেকেও কবিতা। দু'রকম কবিতাই পাঠকের জন্য। পাঠক বিচার করবে ব্যর্থতা নাকি সফলতা তার আহারের আলো।
কবিও খাদ্যের জোগান দেয়।
পাঠক তার রুচি মতো পছন্দমতো সংগ্রহ করবে নিজের নিজের আহার সমগ্র।
কবিতা সমগ্র।
বকের কাছে খোঁজ থাকে কোন্ জলাশয়ে কি মাছ কেমন মাছ! জলের কত গভীরে মাছের চলাফেরা বক জানে।
বক একইসঙ্গে কবি ও পাঠক এবং ধ্যানী।
তার চরণে আমার প্রণাম।
----বিকেল--৪--৪৫
----১১ ফাগুন ১৪২৯
-----২৪--২--২০২৩
----নির্মল হালদার
আমার কবিতা ----কাঠবিড়ালির লাফ --৮৮
----------------------------------------------------------
পাখিরা ডাকতেই জেগে ওঠে গাছপালা। শেষ রাতের জেগে থাকা তারা পাখির বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমন্ত ডিমের পাশে। তারার তাপে জেগে ওঠে জীবন।
কবিতা।
পুণ্য ভূমির কবিতা।
চরাচরের কবিতা।
কীট পতঙ্গের কবিতা।
জল স্থল আকাশের কবিতা।
এই কবিতার চলাচলের পাশে এক শিশু মায়ের আঁচল ধরে সকালের দিকে হেঁটে চলেছে।
হেঁটে যাওয়ার শব্দ কবিতা হয়ে ওঠে সূর্যের কিরণে। আমি পিছন ফিরে দেখতে পাই, মায়ের আঁচল ধরে হেঁটে চলেছি।
আমার দু চোখে জল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, সূর্যের কাছে চোখের জল ফেলতে নেই। তাকে দিতে হয় তিন আঁজলা জল। তাকে দিতে হয় তিনটে জবা ফুল।
রাস্তায় তো ফুলগাছ নেই।
শুধু পথচারীদের শব্দ। আর রাস্তার কুকুরদের হুটোপুটি। তাদের গায়ে লুটোপুটি করছে ফাগুন সকালের রোদ। শান্ত হাওয়া।
এইতো কবিতা। মহাজীবনের কবিতা। প্রকৃতি রচনা করছে আমাদের জন্য। আমি এই জীবনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছি। ভালোবেসেছি প্রত্যাখ্যান প্রত্যাশা। ভালোবেসেছি অভিমান অবজ্ঞা। পানা ফুলের রঙ।
ভালোবাসাবাসিতে জড়িয়ে পড়লেই একটি পলাশ গাছের জন্ম। একটি পলাশ গাছে অজস্র ফুল অজস্র কবিতা।
আমার এই টাঁড় জমিতে বেড়ে ওঠে আমার কবিতা।
----৮--১৫
----১৩ ফাগুন ১৪২৯
---২৬--২--২০২৩
----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮৯
---------------------------------------------------------
আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া
ধরণীতে,
এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।
বিষণ্ণ ছবি।
সূর্যাস্তের ছবি শুধু কি ধরণীতে? মনেও ছায়া পড়ছে। এক বিষাদের ছায়া। কালো ছায়া।
না-পাওয়ার বেদনাও বেজে বেজে ওঠে। তখনই একজন আরেকজনকে বলছে-----
এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।
মনে পড়ে যায় ছোটবেলার একটি
পংক্তি---বেলা যে গেল জলকে চলো গো।
এই জল কি শুধু জল?
আলো চলে যায়, সেই আলো ভরে নিতেও কি এই ডাক নয়?
জলধারার কলস্বরে
সন্ধ্যা-গগন আকুল করে,
ওরে, ডাকে আমায় পথের 'পরে
সেই ধ্বনিতে।
চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।
কবিতাটি কি এখানে শেষ হয়ে যায়? না। যায় না। কেন না, এখন বিজন পথে করে না কেউ আসা-যাওয়া------
বিজন পথ? বিজন পথ বলতে রবীন্দ্রনাথ কি বলতে চেয়েছেন? এখানে? এখানে তো জল ভরার ডাক। বেলা যায়, কলসিতে জল ভরে নেওয়ার ডাক। তবে কেন বিজন পথ? বেলা শেষের জল নিতে গেলেই কি বিজন পথে যেতে হবে?
তারপরেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন--
ওরে প্রেম -নদীতে উঠেছে ঢেউ,
উতল হাওয়া।
বিজন পথে যেতে যেতেই কি, প্রেম--নদী? উতল হাওয়া?
উতল হাওয়ায় কি ভয় নাকি হৃদয় কাঁপে?
এখানে আমার অস্বস্তির কথা বলতেই হচ্ছে তা হলো, প্রেম-নদী। এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার না করে অন্য কোনো শব্দের দিকে যাওয়া যেত না?
জানি নে আর ফিরব কিনা
কার সাথে আজ হবে চিনা,
ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা
তরণীতে।
চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।
অজানা বাজায় বীণা। কে অজানা? তিনি কি নৌকার মাঝি? নৌকা পারাপারের মাঝি? তিনি বীণা বাজান তরণীতে। মাঝি কি বীণা বাজান? তিনি কি সরস্বতীর বর পুত্র ? নাকি তিনি স্বয়ং ঈশ্বর? ঈশ্বরের কাছেই তো জল ভরে নিতে হয়। বেঁচে থাকার আলো ভরে নিতে হয়।
বিষণ্ণ ছবি কি মুছে যাচ্ছে? নাকি বিষণ্ণতার সঙ্গে লেপটে থাকে আনন্দ? এই আনন্দ জল ভরে নিতে যাওয়ার আনন্দ। তারপরেই তো সন্ধে নামবে।
ফুটে উঠবে অগণন তারা।
বিকেল--৫ টা--৬ মিঃ
----১৫ ফাগুন ১৪২৯
---২৮--২--২০২৩
----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯০
----------------------------------------------------------
লেখা যে সবসময় মাথায় ঘোরে এমনটা নয়। লেখা যে সব সময় আসেও এমনটা নয়। কখনো কখনো লেখার জন্য ধ্যান করতে হয়। সহজ করে বলতে গেলে বলবো, বসতে হয়। মন দিতে হয়।
মন দিলেই যে পাবো তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ হঠাৎ আবার কবিতার একটি বা দুটি পংক্তি আমার মাথায় বিঁধতে থাকে। আমি পংক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। এগিয়ে গেলেই যে চওড়া রাস্তা পাবো তারও কোনো নিশ্চয়তা পাই না। পঙক্তি থেকে কখনো কবিতা। সম্পূর্ণ হয়। কখনো হয় না।
প্রথমে তো সবটাই মাথাতে। লাইন বিন্যাস থেকে শুরু করে সংশোধন বা কাটাকুটি যেটুকু হয় মাথাতেই।
একটি শব্দ এসেও কখনো আমাকে আক্রমণ করে, আমাকে যেতে হবে কবিতার দিকে।
একটি শব্দ নিয়ে একটি কবিতা আমার পক্ষে কঠিন লাগে। কিন্তু শব্দটি তো আমার ভেতরে লেপটে গেছে। তাকে না ছাড়ালে, আমার মুক্তি নেই।
মুক্তি কি সহজে আসে?
দেখা গেল, শব্দটি রয়ে গেল। সৃষ্টি হলো অন্য একটি কবিতা। কিন্তু শব্দটি তো মাছের কাঁটার মতো খচখচ করে। তাকে তুলে ফেলতে হলে, একটি কবিতা চাই।
না, হয়ে ওঠে না।
তখন মনে হয়, শব্দটির ওজন নেই। ধার নেই। অথবা শব্দটি আত্মস্থ করতে পারিনি।
যেকোনো শব্দের ক্ষেত্রে একই কথা, আত্মস্থ করতে না পারলে শব্দটি আসবে না। আমি যদি এক্ষুনি একটা আরবি শব্দ পাই এবং আমার পছন্দ হয়, আমি কি ব্যবহার করতে পারবো আমার কবিতায়? শুধু আরবি শব্দ নয় কোনো লোকজ শব্দ আমার ভালো লাগলেই কি সঠিক ব্যবহার করতে পারবো?
সব মাটিতে যেমন ফসল ফলে না তেমনি সব শব্দ থেকেও উঠবে না ঝংকার।
গাছ একটি কবিতা হলে সমস্ত পাতাই শব্দ। কিন্তু সমস্ত শব্দ কবিতা নয়।
কুমারী নদী থেকে সোনা খোঁজে কুমারী সংলগ্ন গ্রামের মানুষ। কাঁসাই সংলগ্ন গ্রামের মানুষ কাঁসাই থেকে জল খোঁজে। কেউ কেউ জল পেতেও পারে। কেউ কেউ সোনা।
ভোরের বাতাস থেকে আবহ থেকে আমি যে কবিতা পাবো আমি কথা দিতে পারি না।
কার কাছে কথা? নিজের কাছে?
সেও তো এক জটিলতা। নিজের কাছে কথা দিলে নিজেকে রাখতেই হবে।
সব সময় কথা রাখাও যায় না।
আমি আজ চাইছিলাম ডুমুরের বীজ। তার বদলে পেলাম, গাছের গায়ে গাছের পাতায় ধুলো আর ধুলো।
কীভাবে মুছবো এই ধুলো?
অভিমানী এক মুখ দেখতেও পেলাম। মুছবো বললেও মুছতে পারিনি অভিমানের কালো রঙ।
রঙও কবিতা। কবিতা হয়ে ওঠে। সর্ষে ক্ষেতের হলুদ ওড়াতে চাইলেও আমি পদিনার ক্ষেত থেকে গন্ধ নিতে নিতে সবুজ হয়ে যাই।
আমার বাসনা বা আমার ইচ্ছেয় সবকিছু ঘটবে না। আমার মন প্রাণ চাইলেও আমার মুঠোয় ধরা পড়বে না আমলকি। মুঠো খুললেই দেখতে পাই, জাম।
আমার করতল কালো হয়ে গেছে।
আমি কৃষ্ণকে পাবো?
আমার চারপাশে রাধার মতো কত যে অভিমানী মুখ।
কবিও তো রাধা। রাতের পর রাত জেগেও শব্দ পায় না। শব্দ পেলেও শব্দ করে না টুংটাং।
প্রায় প্রতিটি রাত বাদুড় ঝোলার মতো ঝুলে থাকে।
কবির ঘুম নেই।
কালীকৃষ্ণ গুহর একটি কাব্যগ্রন্থ "হে নিদ্রাহীন "।
নিদ্রাহীনের পাশে এক গ্লাস জল তৃষ্ণাকে আরো দীর্ঘ করে। কবি কলম দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ওল খুঁজে পায়। সে খুঁজছিল আলু। বাদাম। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁজে পায় এলোমেলো শিকড়।
এইবার সে দেখবে কোন্ শিকড়ে লেগে আছে মাতৃপুরুষ পিতৃপুরুষের ঘাম।
রক্ত ঘামই তো কবিতা।
----দুপুর --৩--৪
---১৬ ফাগুন ১৪২৯
----১--৩--২০২৩
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন