আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭১
--------------------------------------------------------
লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি খুব মসৃণ? খুব প্রশস্ত? লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কি সুশিক্ষিত? সুসম্পাদক? বাংলা ভাষায় দক্ষতা আছে? বাংলা ব্যাকরণেও শিক্ষিত? বাংলা বানানে সম্যক জ্ঞান আছে? বদলে যাওয়া বানানের দিকে নজর আছে?
লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক আবিষ্কার কি করেন গ্রামেগঞ্জে কে কোথায় কবিতা লিখছেন? গল্প লিখছেন? শুধু কি গল্প কবিতা? কারা ছবি আঁকছেন? কারা ছড়া লিখছেন? লোকজীবন বিষয়ে কারা কাজ করছেন মাঠে ঘাটে?
শুধু কি পাঁচটা কবিতা দুটো গদ্য ছাপলেই একটা ম্যাগাজিন হয়ে যায়? প্রচ্ছদে মনোহরণ একটা ছবি ছাপলেই, চমৎকার হয়ে যায়? পাতা ওল্টালেই যদি ভুল বানান চোখে পড়ে? পাতায় পাতায় যদি ভুল বানান চোখে পড়ে? কাগজ মুদ্রণ ও বাঁধাই যদি এলোমেলো লাগে?
প্রশ্ন তো এই, উত্তর কোথায়?
প্রশ্ন তো এই, বিগ ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশ চলে, লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে চলে না?
সম্পাদক কি, নাম দেখে লেখা ছাপেন না ভালো লেখা ছাপেন? সম্পাদক কি, আঙ্গিক ও ছন্দের বিষয়ে জোর দেন নাকি বিষয়ের উপরে? সম্পাদক কি, বিনিময় প্রথাতে বিশ্বাস করেন? অর্থাৎ, আপনি আমার লেখাটা ছাপলে, আপনার লেখা আমি ছাপবো।
কোথায় রাখবো পা?
লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক লেখক কপি কি পাঠিয়ে থাকেন? লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক লেখককে কি আর্থিক সম্মান দিয়ে থাকেন?
প্রযুক্তির কল্যাণে শত শত কবি। সম্পাদক কি ঝাড়াই-বাছাই সর্বদাই করেন? সম্পাদক কি লেখা ছাপানোর পরেই, লেখককে ভুলে যান?
কবি লেখক সামাজিক মানুষ। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকও সামাজিক মানুষ। সম্পাদক সামাজিক সত্ত্বাকে গুরুত্ব দেন নাকি কবি সত্ত্বাকে?
প্রশ্ন এই, লিটল ম্যাগাজিন কি শুধুই একটি সাহিত্য পত্র নাকি সামাজিক বন্ধন? সামাজিক কর্ম? প্রশ্ন এই, লিটল ম্যাগাজিন কি পথ চলার একটি রাস্তা নয় নাকি মুখ দেখাবার পরিচিত হওয়ার একটি মঞ্চ?
লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে নাকি চন্দন ছোঁড়াছুঁড়ি করে? লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি আরেকটি লিটল ম্যাগাজিনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়?
লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্ব কতদূর কোথায়? লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্ব কি, কবি লেখক তৈরি?
প্রশ্নেরা ঠোক্কর খেলে, ধাক্কা খেলে আমি চুপ করবো না। প্রশ্ন করেই যাব, করেই যাব। আমার ধারাবাহিক প্রশ্ন থেকে আমি উত্তর চাইছি আরো-----
সম্পাদক মানেই কি, একটি উপাধি? এই উপাধি কে বা কারা প্রদান করেছে? যদি এই উপাধি নিজেই নিয়ে থাকেন, তবে এই উপাধির গুরুদায়িত্ব সম্পাদকের কাঁধে।
লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এইটে মানবেন তো?
আরও একটি প্রশ্ন, লিটল ম্যাগাজিনের শিরদাঁড়া কি সোজা? নাকি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাথা নত করবে?
-----১৮ মাঘ ১৪২৯
-----২---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৭২
-------------------------------------------------------
সকালবেলা পাড়ার দোকানে চা খেতে গেলেই, এক পাল কুকুর। চা প্রেমিরা চা খাচ্ছে। কেউ কেউ চায়ের সঙ্গে বিস্কুট।
কুকুরের দল চেয়ে থাকে।
প্রতিদিনই মনে হয়, পকেটে আরো কিছু পয়সা থাকলে, বিস্কুট কিনে কুকুরকে দেওয়া যেতো।
আজও সেই একই ছবি।
আমি আমার বিস্কুট থেকে খানিকটা ভেঙ্গে ছুঁড়ে দিলাম। প্রথম কথা, কোনো খাবার কখনো ছুঁড়তে নেই। ছুঁড়ে দিলে খাবারকে অসম্মান করা হয়। যাকে ছুঁড়ে দিচ্ছি, তাকেও ছোট করা হয়। কোনো কিছুকে অসম্মান করার অধিকার আমার নেই। কাউকে ছোট করার অধিকার আমার নেই। এ আমি জানলেও আজ আবার সেই একই কাজ করলাম। ভুল কাজ। দ্বিতীয় কথা, একগাদা কুকুরের কাছে এক টুকরো বিস্কুট দেওয়া উচিত নয়। কে পাবে আর কে পাবে না, আমার তো জানা নেই। যদিও জানি, একজন পাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাকিজন বঞ্চিত।
তার চেয়ে ভালো, না দেওয়া।
এক টুকরো বিস্কুটে একজনেরও পেট ভরবে না।
আমারও পেট ভরে না।
কুকুরগুলো চেয়ে থাকে সবার দিকে। আসলে তো, খিদে চেয়ে থাকে। খিদেও তো এক দেবতা। তার মুখ প্রসন্ন করতে হলে দু' চার প্যাকেট বিস্কুট সঙ্গে রাখা জরুরী।
কখনো কখনো লক্ষ্য করেছি, কোনো যুবক সাইকেল কিংবা বাইকে এসে কুকুরদের কাছে বিলি করছে বিস্কুট।
চা খেতে খেতে মনে পড়লো, ঘরে আছে এক প্যাকেট বিস্কুট। কুকুরটা এলে (যে কুকুরটা আমাদের ঘরকে মনে করছে নিজের ঘর) বিস্কুট দিতে হবে। আমি ভুলেও যাই। দেখি, বিস্কুটের প্যাকেট জমে উঠছে।
তিনটে কুকুর নিয়মিত আমাদের ঘরের গলিতে (যা আমাদের উঠোন) আসা-যাওয়া করে। সন্ধে হলেই বড় কুকুরটা দরজার কাছে চুপচাপ বসে থাকে। চোখ মুদে। কেবল পায়ের শব্দ শোনে।
আমার বন্ধু পুষ্পেন সরকার কুকুরদের জন্য একটা আশ্রম খুলেছে। তাদের খাওয়া দাওয়া তাদের চিকিৎসা সমস্তই তার দায়িত্বে। সঙ্গে আরো লোকজন থাকলেও সে প্রধান। আমার আরেক বন্ধু স্বপন চক্রবর্তী চায়ের দোকানে গেলেই, কুকুরদের জন্য আলাদা বিস্কুট কিনে তাদের দিয়ে থাকেন।
আমার দুই বন্ধুই হৃদয়ের জায়গা থেকে অনেক উঁচু।সেই তুলনায় আমি কিচ্ছু না। আমার মায়া হয়। কষ্ট পাই, এটুকুই।
রাস্তার গাই--গরুদের দেখলেও আমার মায়া জাগে।বাজারের শাকসবজিতে মুখ দিতে গেলে, তারা গালমন্দ খায়। লাঠি খায়।
কখনো কখনো চেষ্টা করেছি, বাজার থেকে শাকপাত কিনে গরুর মুখের কাছে ধরতে। তাতেই বা কি হবে!অনেকটা পরিমাণে খাবার না দিলে তাদের পেট ভরবে না।
অনাথ গাই-গরু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেই থাকে। তাদের করুণ চোখে আকাশ ও মেঘ ভেসে উঠলেও, আমার চোখে ভেসে ওঠে অসহায়তা।
আমি নিজেও যে অসহায়।
আমার অসহায়তা কাকেই বা দেখাবো! কেইবা দেখতে পায়? নাকি দেখাতে নেই? কোনো কিছুই দেখাতে নেই। শুধু আড়াল রাখো। যে দেখার দেখবে।
গাই-গরু কুকুরের দল আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে।
----১৯ মাঘ ১৪২৯
----৩---২---২০২৩
----নির্মল হালদার
আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৭৩
-----------------------------------------------------------
------পালক, তুমি কটা সিঁড়ি ভেঙ্গে এলে আমার কাছে?
-----২১ টা।
-----২১ টা!
আমি তো মনে রাখতেই পারি না, আমার ঘরে আসতে হলে কটা ভাঙতে হয়। আচ্ছা, এবার তাহলে বলো-----ছাদে যেতে হলে কটা সিঁড়ি?
-----১৭ টা।
------ও বাবা, তুমি তো দেখছি সবই জানো। এবার তাহলে তোমাকে বলতে হবে, তুমি আর কোথায় সিঁড়ি দেখেছো?
------পেখমদের বাড়িতে।
------আমি তো পেখমদের বাড়ি যাইনি।
------তুমি মিথ্যে কথা বলছো।
আমাকে নিয়েই তো তুমি পেখমদের বাড়ি গেছলে।
------ও ভুলে গেছি ভুলে গেছি।
পালক হাসে।
আমার হাত থেকে কলমটা কেড়ে নেয়। জানতে চায়, এই কলমের কালি কি রঙের! আমি তাকে জানাই, নীল রঙের। পালক আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ব্লু? আমি বলি হ্যাঁ।
পালক শোনো এবার, আরো প্রশ্ন করবো তোমাকে। সিঁড়ি ক প্রকার বলো তো?
-----ম্যাম তো আমাকে শেখায়নি।
পালকের উত্তরে আমি হেসে উঠি। তাকে বলতে হয়, সিঁড়ি অনেক প্রকার, তার মধ্যে আমার একটা কাঁধ।
-----কাঁধ?
পালককে জানাতেই হবে, হ্যাঁ আমার কাঁধ। সেই যে তুমি একদিন আমার কাঁধে উঠে পেয়ারা পাড়লে। মনে নেই?
------হ্যাঁ হ্যাঁ।
------তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আর কারোর কাঁধে উঠবেনা কখনো। তুমি বড় হলে নিজের নিয়মেই বড় হবে। নিজেই পাড়তে পারবে কুল। আতা। চানাচুরের কৌটো পাড়তে হলে মাকে আর বলতে হবে না। কিংবা মায়ের কোলে উঠে পাড়তে হবেনা বিস্কুটের কৌটো। কোল ছাড়া কাঁধ ছাড়াই নিজে নিজেই সব পারবে। দেখো।
পালক ভুলে যায়নি। সে আবার জানতে চায়-----সিঁড়ি ক প্রকারের? আমি তাকে বলি, বলবো বলবো দাঁড়াও। কী আর বলবো, তার কাছে জানতে চাই----পালক বলোতো, চাঁদের কাছে উঠতে হলে, তুমি কোথায় সিঁড়ি পাবে?
------জানি জানি, জেঠুনদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো। ছাদে রঙ করার সময় গৌরাঙ্গ দাদু নিয়ে এসেছিল।
------কবে যাব আমরা চাঁদে?
-----চাঁদ উঠলেই যাব।
পালক আকাশের দিকে তাকায়। শীতের সূর্য ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে। পালকের কপালে কাজলের টিপ। তার উপরে একটি শাদা চিহ্ন।
কীসের ইঙ্গিত বহন করছে?
আমি এবার পালককে জিজ্ঞেস করি----তুমি যখন ঘুমোতে যাও খাটে কে উঠিয়ে দেয় তোমাকে? সে বলে----আমি নিজেই উঠি।
------বাহ বাহ
তুমি তো পারো দেখছি নিজে নিজে উঠতে। তাহলে আর সিঁড়িও লাগবে না।
------লাগবে লাগবে।
মা যখন বলে, বিট্টু ট্যাংকে জল আছে কিনা দেখে আয়-----তখন তো সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হয়। তুমি তখন বলো, সাবধানে উঠবে পালক---লোহার সিঁড়ি। লোহার সিঁড়ি কেন?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকতে থাকতে বলে উঠি, তুমি স্বপ্ন দেখো? আমার এই প্রশ্নে আমাকেই প্রশ্ন করে পালক-----স্বপ্ন কী?
-----ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তুমি ছবি দেখতে পাও না? এই ধরো হাতি ঘোড়ার ছবি। আরো ধরো, ফুলের ছবি। আর তুমি যে হরিণ হরিণ করো, তার ছবি দেখতে পাও না?
----না না।
----যখন দেখতে পাবে তখন না ঘুমিয়েও দেখতে পাবে। আর দেখার জন্য একটাও সিঁড়ি লাগবে না। এই যে তুমি আমাকে দেখছো এখনো, সিঁড়ি লাগছে?
----আমি নিচে যাচ্ছি।
-----দাঁড়াও দাঁড়াও-----একটু পরে যাবে। তোমাকে যে আমি খুব ভালোবাসি, তার জন্য সিঁড়ি লাগে না। বুঝলে? পালক নীরব থাকে। সে কলমের ঢাকা খুলে বাঁ হাতের পাতায় আঁকিবুকি করে। তাকে জানাতে ইচ্ছে করে-----কোথাও কোনো সিঁড়ি নেই। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি মাটিতে। যারা সিঁড়ি ব্যবহার করে, তারা একটা সময় আর উঠতে পারে না। পালককে বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পারি না, মাটিতেই পা রাখতে হয়। তবেই মাটি তোমাকে দেখবে। তুমি ভালো থাকবে অবশ্যই। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলে পালককে প্রশ্ন করি, ২+২ সমান কত বলো তো? সে বলে-----৪
আমি বললাম-----হলো না হলো না। ২+২=২
তুমি জিরো জিরো জিরো-----পালক বলতে বলতে সিঁড়ি ভেঙ্গে চলে যায়।
-----২০ মাঘ১৪২৯
-----৪---২---২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৭৪
-----------------------------------------------------------
মাঘ শেষের শীত। সন্ধেবেলা। কাঁসাই পারে। একটি দুটি করে তারা উঠছে। তার ছায়া পড়ছে কাঁসাইয়ের গোড়ালি ভেজা জলে।
শীত শীত অন্ধকার।
একটু কাঁপুনি। গায়ে জড়াতে ইচ্ছে করলো চাদর। জানতে ইচ্ছে করলো তারাদের তাপে উষ্ণতা আসবে না?
না, আসবে না------অবিনের অন্তর থেকে উত্তরটা পেলাম। সে শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বাললো।
আমিও জড়ো করছি একটি দুটি পাতা। কবে থেকে ঝরে পড়ে আছে কে বলবে? গাছে যখন ছিল কে লক্ষ্য করেছে তাদের নবীনতা?
আমাদের পাশেই সরষে ক্ষেত। সরষে ফুলের হলুদ রঙ ছিটকে পড়লেও অন্ধকারে ঠাওর হয় না।
বসন্ত আসছে। পলাশের কুঁড়িও কি আসছে গাছে গাছে? নদীর ওপারেই পলাশের ঘন সারি।
ডেকে উঠলো একটা পাখি।
বেলা ফুরিয়েছে অনেক আগেই। তবে কি পথ হারিয়ে গেছলো পাখিটা? পাখিটার পিছনে পিছনে যেতে পারলে ভালো লাগতো আমার। যদি সে পথ হারিয়ে গেছে , তাহলে তাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।
আগে কী কী নিয়ে এসেছি? কাদের নিয়ে এসেছি? ভালোবাসা আমার সঙ্গে এসেছে?
কে একজন নদীর জলে ও বালিতে হাঁটতে হাঁটতে এপারে আসছে। মুখের সামনে ধরা আছে একটি আলো।
মোবাইলের আলো?
চরাচর জুড়ে স্তব্ধতা। নির্জনতাও খাঁ খাঁ করছে। একটা ডাক। কার ডাক? শেয়ালের? কাকে ডাকছে?
কে দেবে সাড়া?
শুকনো পাতার আগুন জ্বলছে। বাপিও আগুনে ফেলছে একটার পর একটা পাতা। এইবার একটা পাতা আমার গায়েও পড়লো।
আমরা আছি শিমুল তলায়।
নির্জনতা আরো গভীর হয়ে উঠছে। গম্ভীরও। আমার ভয় ভয় করে। পর মুহূর্তেই অবিন ও বাপির মুখ। আবছা হলেও তাদের যৌবনের মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। তাদের তারুণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতেই, অনেকক্ষণ আগেই উঠেছে চাঁদ। আমি এই লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হলো, লাফিয়ে লাফিয়ে ধরতে হবে এই চাঁদ।
মাঘী পূর্ণিমার চাঁদ।
-----২২ মাঘ ১৪২৯
-----৬---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ----৭৫
------------------------------------------------------------
নিম্নবর্গের মানুষ মাটি কেটে কাজ করে। শ্রমিকের কাজ করেও পেট ভাতায়। দুবেলা। নিম্নবিত্ত মানুষ খেটে খেতেও পারে না। তাদের খেটে খাওয়ার জায়গা পরের দোকান। মাস শেষ হলে যেটুকু পাওয়া যায়, তা থেকেই দিনাতিপাত।
অনেক অনেক সঙ্কট মুহূর্তে ঘরের মেয়েরা ঘরের কর্তা ব্যক্তিদের কিছু না বলে, ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে সঙ্কট থেকে উদ্ধার পায়। যা ঘরের পুরুষরা জানতেই পারে না। যেমন ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন চালের খরচ থেকে একমুঠো চাল আলাদা করে রাখে। এক দশন তেলও আলাদা করে রাখে। বিপদের সময় এই চাল এই তেল রক্ষা করবে । উপোস থেকে।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত থেকে আরম্ভ করে নিম্নবর্গের মেয়েরা পরিবারের উদ্ধারময়ী এক একটি লক্ষ্মী। অথবা লড়াকু। যে লড়াইয়ের জন্য তারা সব সময় বুক বেঁধে থাকে।
স্বামী হারা একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে আজীবন লড়াই করে গেছে ননীবালা হালদার। লোকের ঘরে ঘরে জল দিয়ে, বড়ি দিয়ে, ঠোঙ্গা করে সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে।
লেখাপড়ায় এগিয়ে যেতে পারেনি তার একটি মাত্র সন্তান। আত্মীয়দের দোকানে কাজ করে সংসার চালিয়েছে। তাকে যেতেও হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার সীমান্ত গ্রামে। আত্মীয়ের দোকানে কাজ করতে।
আত্মীয়র কাছে থাকা মানে সম্মানের সঙ্গে থাকা। সম্মান যেন ক্ষুন্ন না হয় এজন্যেই বাড়ি থেকে দূরে থাকা।
এখনো ছিটেফোঁটা মূল্যবোধ মধ্যবিত্তদের আছে। তার সঙ্গে নিম্নবিত্তরাও মূল্যবোধ আর কৌলিন্যের কারণে শ্রমিকের সঙ্গে শ্রমিক হয়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করতে পারে না।
আমাদের পরিবারের কেউ কোনোদিন লোকের ঘরে কাজ করে না, লোকের কাছে হাত পাতে না----এই মনোভাব বেশিরভাগ সময় নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তদের সঙ্কট থেকে সঙ্কটে অভাব থেকে অভাবের দিকে নিয়ে যায়।
তো বিধবার একমাত্র পুত্র সন্তান বটু কৃষ্ণ হালদার পুরুলিয়ার সীমান্ত গ্রামের আরেক হালদার পরিবারের সদস্য হয়ে গেলেও সেও তো পরের ঘর।
স্বাধীনতা হীনতায় বেঁচে থাকা।
পুরুলিয়ার জল কষ্ট সেই অতীত থেকে আজও বর্তমান। সেই অতীতের একটি ছবি, বটু কৃষ্ণ হালদার যে বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে অথবা তার অন্ন সংস্থান হয়েছে, সেই বাড়ির মহিলারা বসতি ছাড়িয়ে ধান জমির কাছাকাছি এক কুয়ো থেকে রাত্রি বেলায় কলসি বালতি নিয়ে জলের জন্য যাওয়া আসা।
সারাদিন জল মিলতো না কুয়ো থেকে। রোদের কারণে। সূর্য ডুবে গেলেই সেই কুয়োতে জমে উঠতো জল। এই কুয়োর জলে ভাত সেদ্ধ ডাল সেদ্ধ হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে এই কুয়োর জলের চাহিদা খুব।
বিভিন্ন পরিবার থেকেই রাত্রিবেলার নির্জনে কুয়ো থেকে জল তুলছে মহিলা বৃন্দ।
তার আগে বটু কৃষ্ণ হালদার মহিলাদের আগে আগে লন্ঠন হাতে এগিয়ে চলেছে। যেন সেই আলোক বর্তিকা।
তার পিছনে পিছনে সারি সারি পিপাসা।
শেষ নেই এই পিপাসার।
বটু কৃষ্ণ হালদারও ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। আজও এগিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র।
কাঁখে কলসি হাতে বালতি ভরে উঠবে নক্ষত্রের আলোয়।
----২৩ মাঘ ১৪২৯
----৭--২--২০২৩
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন