আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৬
--------------------------------------------------------
১.
নারকেল কুলের গাছ। দত্তদের ছিল না হালদারদের? সেই ছোটবেলায় জানার আগ্রহ অথবা কৌতূহল ছিল না আমার। গাছটা যে আমাদের ছোটদের কাছে খেলার সঙ্গী ছিল। প্রায় সারাদিন। এটুকুই সত্যি। এই সঙ্গী সরস্বতী পুজোর আগেই ডালে ডালে ছোটদের লোভ দেখায়।
কাঁচা কুল। ডাঁশা কুল। পাকা কুল।
কেউ আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। কেউ পাতার আড়াল থেকে আমাদের দেখে। আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করি।
কাঁটার ভয় না করেই, কোনোভাবে উঠে পড়ি। কোনো কোনো দিন হাত-পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়ে। তবুও ফুটে ওঠা রক্ত আমাদের দমাতে পারে না।
কুল যে খেতেই হবে।
নিষেধ শুনেছি অনেক, সরস্বতী পুজোর আগে খেলে বিদ্যা হবে না। বারণ করেছে আরো, কুল খেলে কাশি হবে খুব।
কে শোনে কার কথা!
বাজারেও কুল বিক্রি হচ্ছে। পয়সা তো আর নেই, কিনবো কোত্থেকে! আমাদের সঙ্গী গাছটা যতটুকু ভালবেসে দেবে ততটুকুতেই আমরা খুশি।
পুজোর দিন পুরোহিত কিংবা বাড়ির কেউ ছোটদের কাছে জানতে চাইতো----কে কে নারকেল কুল খেয়েছিস? সত্যি করে বললে, মা-সরস্বতী কিছু মনে করবে না।
আমরা ছোটরা একে অপরের দিকে চেয়ে থেকেছি।
চেয়ে থাকতে থাকতেই, হঠাৎ করে বড় হয়ে গেলাম। কত বড়? মানুষ হতে পেরেছি কি?
সরস্বতী হাসছে।
আমার সঙ্গী কুল গাছটা কোথায়?
আমার ছোটবেলাটা কোথায়?
আমার শৈশবের কবিতা কোথায়?
২.
সে বছর হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবো। তার আগেই তো সরস্বতী পুজো। আমার ইচ্ছে হলো, আমরাও পুজো করবো। স্কুলের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই, হইচই করবো কোথায়! আমাদের কোনো ক্লাবও ছিল না। অবনী লাল্টু আর বাবলুকে আমার ভাবনার কথা বললাম। রাজি হয়ে গেল তারাও।তোড়জোড় করে টাকা পয়সা জোগাড়। জায়গা নির্বাচন।
বাবলুদের একটা ফাঁকা বাড়ি পড়েছিল, স্থির হলো আমাদের পুজোটা সেখানেই হবে।
আমার উদ্যোগে সাড়া দিলো সবাই। ভেতরে ভেতরে আমি খুশি। সরস্বতী পুজো করতে পাচ্ছি। তারপর মাথায় এলো, পুজোটা কারা করছে, কী জানবে তুলিনের ছেলেপুলেরা? লোকজন?
সুভাষ সংঘ বিবেকানন্দ ক্লাব অথবা রবীন্দ্র অগ্রণী এ ধরনের নামকরণে আমি নেই। আমি নামকরণ করলাম---আমরা সবাই।
সরস্বতী পুজোর দিন বেলার দিকে বাবলুর বাবা এসে নাম দেখে বললেন----আমরা সবাই ফেল।
না, বাবলু ফেল করেনি। অবনী লাল্টুও ফেল করেনি। আমি বরাবরই ফেলু।
অথচ আজও বাংলা কবিতার কাছে বাসক ফুল আম মুকুল রক্ত পলাশ দু'হাতে নিয়ে অঞ্জলি দিতে যাই।
------১১ মাঘ ১৪২৯
সরস্বতী পুজো
-----২৬---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৭
---------------------------------------------------------
শালুকের লাল রঙ ছিটকে পড়ছে জলে। স্থির হয়ে আছে পদ্মফুল। একটি পাপড়িও নিজেকে মেলে ধরলো না।
শালুকের সঙ্গে পদ্মের ভাব নেই?
বাঁশ ঝাড়ের পাশেই একটা মহুল গাছ। দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ গাছের মন মহুলের গন্ধে গন্ধে পুলকিত হয়? কাছে আসে?
হাঁসগুলি কোলাহল করলে কে শোনে? লাফিয়ে ওঠে মুরগি? আগাছা থেকে উঁকি মারে পোকামাকড়?
গাছে রস এলে মৌমাছি ছাড়া আর কে খবর পায়? তালগাছ খেজুর গাছ পাশাপাশি থেকেও কেউ কারোর দুঃখ শুনতে পায় না। শুনতে পায় না আনন্দধ্বনি।
ভাব নেই?
একটি তারা খ'সে পড়লে কেঁপে ওঠে না একটি পাতাও।
সম্পর্ক নেই?
একটি কাক ডাকতে ডাকতে কোথায় যে গেল! তার পিছনে পিছনে কোকিল কি যায়?
সম্পর্ক নেই?
একটি মেঘ এসে উড়ে গেল। খোঁজ করবে না আরেকটি মেঘ?
ভাব নেই?
বক এসেও উড়ে গেল, পুকুরে জল নেই। তার খিদের কাছে দাঁড়াবে না কেউ? বকের সঙ্গেই তো একটা গাছে থাকে শালিকের বাসা।
ভাব নেই?
একই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না।
হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাওয়ার তরঙ্গে তরঙ্গে বেজে উঠছে বিষণ্ণতা।
----১২ মাঘ ১৪২৯
----২৮---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৬৮
-----------------------------------------------------------
ভোর নিজেই একটি কাব্য। ভোর নিজেই একটি কাব্যগীত। ভোরের কাছে দাঁড়ালেই, সুর আর সুর। ঝর্ণাধারা।
মায়ের কোল থেকেই আমার ভোর দেখা শুরু। আলো ফোটার আগেই আমি কেঁদে উঠতাম। আমার কান্না শুনতে শুনতে ফর্সা হয়ে উঠতো আকাশ। আরেকটা কথাও বলতে পারি, আমার কান্নার সুর নিয়ে রাতের তারারা নিজের নিজের ঘরে চলে যেতো।
ভোরে যে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের সুর, আমি আঁজলা করি। আঁজলা থেকে দুচোখেও ধরে রাখি। সূর যে শুনতেই হবে। সুরে সুরে গান।
আমার ভোর।
ভোরের পাতায় পাতায় লেখা থাকে গানের পরে গান। গাছের কাছে দাঁড়ালেও গান। পাতা থেকে বিন্দু বিন্দু ঝরে।
আমি গান ভালবাসি।
ইভাদির কাছে গান। রবীন্দ্রনাথের গান। স্কুলে। তখনো ভোর যে একটি কাব্য আমার উপলব্ধিতে ছিল না । অনেক অনেক পরে দেখলাম, শৈশব তো থেকেই ভোর আমার সঙ্গে আমি চিনতে পারিনি।
একেকটা পাখির ডাক ভোরের গান। ঘাসের মুখেও থাকে ভোর। ভোরের আলাপ। এই আলাপের কাছে না দাঁড়ালে একটা দিন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। এই আলাপের কাছেই, প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি।
স্কুল বেলায় আমার এক বান্ধবী ছিল, সে আমার কাছে শুনতে চাইতো গান। আমি শুরু করলেই, হেসে উঠতো খুব। সেই হাসির শব্দটাওতো আজও আমার কাছে গান।
আমি শুনতে পাই।
প্রতিটি ঋতুতেই গানের কলি ঘুরে বেড়ায়। উড়ে বেড়াতে বেড়াতে বাসা বাঁধে মৌমাছিদের মত। সুর ঝরাতে ঝরাতে পরিপূর্ণ করে রসের ভান্ডার।
রাত থেকে তাই আমার পথ চলা। ভান্ডারে ডুবতে হবে।ভোরের সঙ্গে উঠতেও হবে।
ভোর ভালোবাসা।
ভোর বন্ধন।
-----১৪ মাঘ ১৪২৯
-----৩০---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬৯
----------------------------------------------------------
চায়ের গাছ আমি দেখিনি।
চা হয়ে যাওয়ার পর চায়ের- গুঁড়ো শুকাতে দেখেছি। শুকিয়ে গেলেই আরেকবার চা। আরেকবার চা-পান।
আরেকবার দারিদ্র্য পান।
দারিদ্র্য শুকিয়ে শুকিয়ে যতবার পান করা যায়, ততবার ভাবতে হবে না চা কেনার কথা।
চিনিও কিনতে হয়। চিনির বদলে তাই শক্ত গুড়। গুড়ের গন্ধ যেন না আসে, তার জন্য চায়ে একটা তেজপাতা।
সেই চায়ের অনন্য স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে।
এই স্বাদ আমার কবিতাও।
আমার জীবনে লেপ্টে থাকা অনেক কবিতার মধ্যে একটি কবিতা। কবিতাতো সেও, ঠোঙ্গা করার সময় আঠার দরকার হয়। এবং সেই আঠা ঠোঙাতে লাগানোর পর শুকিয়ে গেলেই, অভাব মোচন।
ঠোঙ্গা বিক্রি করে দুটো পয়সা।
বিউলির ডালের বড়ি টিনের পাতে দেবার পর রোদে শুকানো।
দারিদ্র্য শুকানো।
শুকিয়ে গেলেই বড়ি বিক্রি। দু'চারটে পয়সায় তেল নুন। ঢাকা পড়বে দারিদ্র রেখা।
দেয়ালে ঘরের মেঝেয় ফাটাফুটি রেখা। চাপা পড়েনা। ঢাকা পড়ে না। হীরার মায়ের ধুতিতে কোনো ভাবেই ঢাকা পড়ে না। হীরার মা বরং গ্রীষ্মকালে পরনের ধুতির আঁচল মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। একটি মাত্র পুত্র সন্তানের মা, বাপ-মরা বেটাকে মানুষ করার জন্য, বাঁচার জন্য লড়াই করে গেছে দিনের পর দিন। ঘরে ঘরে কলসি কলসি জল দিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, যদি সুসময় আসে। যদি একটি মাত্র বেটার মুখে হাসি ফোটানো যায়, তবে ভোরের সূর্যকেও সুন্দর লাগবে। সেই একটি মাত্র বেটা বটু কৃষ্ণ হালদারও মারা গেল। এই এতকাল পরেও হীরার মা বটুর হয়ে যাবে কি?
হীরার মাকে কেউ কোনোদিন বটুর মা বলেনি। বড় মেয়ে হীরার নামেই, হীরার মা হিসেবে পরিবার থেকে পাড়ায় পরিচিতি। এবার স্বর্গের দেব-দেবীরা নিশ্চয়ই হীরার মাকে বটুর মা-ই বলবে, মনে হয়। হীরার মায়েরও আফসোস ঘুচবে, বটুর মা শুনতে শুনতে।
----১৬ মাঘ ১৪২৯
-----৩১---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭০
---------------------------------------------------------
মাথার উপরে আকাশ। পায়ের তলায় মাটি। আমাদের জীবনের অঙ্গ। আমরা মাটি ও আকাশের উপরে নির্ভর করেই বাঁচি।
আমি তো বেশি বেশি করে বাঁচি।
মাটি ও আকাশে নানা রকম প্রাণ খেলে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে আমিও আমার খেলায়। দুঃখ-বেদনা আনন্দে।
আমার লেখাতে তাই, মাটির প্রভাব। আকাশের ছায়া। আমার লেখাতে তাই, পায়ের শব্দ।
মানুষের পায়ের শব্দ।
আমার লেখাতে তাই, পোকামাকড়ের পায়ের ছাপ। ব্যাঙের ডাক। পানকৌড়ির ডুব। গেঁড়ি-গুগলিও উঁকি মারে। থাকে হাঁসের কোলাহল। মুরগির ডাক। পায়রাও আসে।
মানুষের আঁকি-বুকি মুখ। শ্রম। বিনোদন। সেই সঙ্গে হাঁড়ির গায়ে লেগে থাকা ফ্যানের দাগ।
আমার লেখাতে, ঘুরেফিরে আমার অভিমান। আমার আর্তি। আমার ভালোবাসা।
এসবের বাইরে কেমন করে যাবো অন্য কোথাও? অন্য কোনোখানে?
বাঁশ ঝাড়ের সরসরানি হাওয়া এসে আমার গায়ে লাগে। পলাশ বনের ফুরফুরে হাওয়া এসে আমাকে বিষণ্ণ করে। আমি ভেতরে ভেতরে কাঁপি। আমি ছুটে যাই, জলহারা নদীর দিকে। পুকুরের দিকে। শুকনো কুয়োতলার দিকে।
আমি কবি নই। কবিতা লেখার চেষ্টা করি মাত্র। সেই সব লেখাতে ভাঙ্গা পথের রাঙা ধুলো উড়ে বেড়ায়।
রঙিণ হই। রসরাজও হয়ে উঠি। ধুলোর ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্যের বীজ। অনেক জনপদের ইতিহাস। কান পাতলেই, রক্ত ঘামের শব্দ। কান্নার শব্দ।
আনন্দ ধ্বনি।
এ সমস্ত আমার লেখা। আমার অনুভূতি। এ যদি কারো কারো কাছে কবিতা হয়ে ওঠে আমার বলার কিছু নেই। আমি এসবের বাইরে যেতে পারি না আর কোথাও।
এক ধীবর মাথার উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জাল ফেলছে পুকুরে। নদীতে। শিকার করবে মাছ। তা যে আমাকেও শিকার করছে, কাকেই বা বলবো?
সব সময় তো বলা যায় না, এ কারণেই দু এক পংক্তি বলার চেষ্টা করি মাত্র। সব সময় তো বলা যায় না, অভুক্ত অসহায় কুকুরের কথা। গাই-গরুর কথা। যারা রাস্তাতে রাস্তাতে। সারাদিন। বলার চেষ্টা করলেও বলা যায় না, শতশত পাখি গাছের অভাবে ফুল ফলের অভাবে, হাহাকার করছে।
এই হাহাকারের আওয়াজ কে পৌঁছে দেবে সবার কাছে?
আমার মন খারাপ করে। আমি একলা হয়ে পড়ি।
নীতি নৈতিকতা, আদর্শবোধ, মূল্যবোধের অভাবে আমি রেগে যাই। আমি একা হয়ে যাই।
আমার এই একাকীত্ব আমার লেখাতে। কারোর কারোর সহ্য না হলে, আমি আর কি করবো!
আমি রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথও করি, এ আমার দোষ।আমাকে বললেন বিখ্যাত এক কবি। তাঁর বক্তব্য------ আমি তো রবীন্দ্রনাথ পড়িনি।
আমি তো পড়িনি। আমি তো পড়ি না কিছুই।
কবিতা লেখার চেষ্টা করি মাত্র। আমার লেখাতে ফুল পাখি আসবেই। খিদে আসবেই। ফসল, না-ফসল আসবেই।
ঝুমুর-টুসু-ভাদু-ছো আমাকে প্রভাবিত করে। আমাকে প্রভাবিত করে গরু চরানো বাগাল ছেলে। রাস্তায় ধান শুকানো বুড়ি।
এই বুড়ির কাছেই তো আমি চাইবো এক আঁজলা জল। আমার যে প্রাচীন তৃষ্ণা। আমি যে পিপাসা থেকে পিপাসায় পথ হাঁটি। আমি যে কাকের সঙ্গেই ফাগুন চৈত্রে পলাশের মধু খুঁটে খাবো। আমাকে হ্যাংলা বললেও আমি শুনতে রাজি। কারণ, আমি তো
হ্যাংলাই। আমি পেয়ারার দিকে চেয়ে থাকি। আমি কুলের দিকে চেয়ে থাকি।
আমি মানুষের দিকে চেয়ে থাকি।
আমি কাঙালও।
আমি ভিখারি।
দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াই।
একমুঠো ভিক্ষে মানে এক মুঠো লেখা। এক মুঠো ভিক্ষে মানে কোথাও কোথাও অপমান।
একমুঠো অপমান একমুঠো লেখা।
লিখন আমার ধূলায় হয়েছে ধুলি।
----১৮ মাঘ ১৪২৯
----১--২--২০২৩
------নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন