বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩

আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ



আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৬
----------------------------------------------------------

দুপুরে একবার ভাত না খেলে তৃপ্তি হয় না। সারাদিন মনে হয়, কিছুই খাওয়া হয়নি।

আবার এও ঠিক, একা খেতে ইচ্ছে করে না। পাশাপাশি এটাও ঠিক, কার সঙ্গেই বা খাবো! তারপরেই ভাবি, আছে আছে আছে। অনেকেই আছে অনেকের সঙ্গে খাবো। সবাইকে খাইয়ে খাবো।

আমি কি খাই?

আমার হয়ে পালক খায়।

আমার সামনে ভাত এসে গেলেই, আমি পালককে হাঁ করতে বলি-------এবং সে হাঁ করলেই, আমার দু আঙুলের ভাত প্রথমে হাতি খায়। তারপরেই পালকের কাছে জানতে চাই এবার কে খাবে? সে বলে, ঘোড়া।

এবার কে খাবে?
বাঘ।
এবার?
সিংহ।
এবার কে খাবে?
হরিণ।
তারপর?
জিরাফ।
পালক কখনো কখনো কোনোদিন নিজেই বলে, এবার খাবে গরু। তারপরেই আমি বলি, এবার খাবে গাধা। সে বলে, ছাগল খাবে, ছাগল খাবে। পায়রাও খাবে।

এদের সবার খাওয়া হয়ে গেলে, পালক খায়। পালকের পরেই, ডোডো দাদু।

এই আমার একলা খাওয়া দোকলা খাওয়া। অথবা বলতে পারি, একলা--ফেকলা দুজন পাখি সবার সঙ্গে খায়।

আমার চারদিক থেকে বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়া কীটপতঙ্গ পাখিরাও আমাকে ভালো থাকতে বলে।

আমিও কুশলে থাকি।

সকালে তুলসি গাছে জল দিয়ে সমস্ত গাছের গোড়ায় জল দিতে দিতে সূর্যের দুয়ারে জল দিয়েছি।

এই জল অনন্ত।

আমাদের আহারও অনন্ত।

পালক আছে রাতেও। আমাকে ন'টা হামি দেবেই। তারপর আমার শুতে যাওয়া।

আমি দেখতে পাই, আমার পালক আমার পিতা আমাকে জোগান দিয়ে যাচ্ছে, নিটোল একটি ঘুম।

------২৮ মাঘ ১৪২৯
-----১২---২---২০২৩
----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৭
----------------------------------------------------------

সম্পর্ক কাকে বলে?

সম্পর্কের সরলতা সম্পর্কের জটিলতা কাকে বলে?

সম্পর্কে খালডোব থাকে?
হ্যাঁ থাকে।
সম্পর্কে মসৃণতা থাকে?
হ্যাঁ থাকে।

সম্পর্ক নিয়ে যে যাই বলুক, আমি সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাসী। আমি সম্পর্ক লালনে বিশ্বাসী। সম্পর্ক আমার ঘর। আমার পরিবার।

অনেক অনেক দিন বাদে কলকাতা যাব। বইমেলা উদ্দেশ্য হলেও বন্ধুদের কাছে যাব। কত কতদিন দেখা হয়নি, দেখা হবে কথা হবে। নিঃশব্দে উষ্ণতা বিনিময়।

কোথাও কোথাও খবর দিয়েছিলাম----আমি যাচ্ছি। যেমন হাতিবাগান। বাগবাজার। সল্ট লেক। অজস্র ঘর, সবাইকে খবর দিতে হলে কলকাতায় থাকতে হবে অনেকদিন। তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, শুধুমাত্র একটা রাত দুটো দিনের জন্য যাওয়া। তবে খবর দিতেই হয়েছিল, সুরজিৎ পোদ্দারকে। খুব আশ্চর্য রকমের ছেলে। কবিতা চর্চার পাশাপাশি সমাজ চর্চাও করে। তার বন্ধুরাও খুব চমৎকার। বলেছিলাম, কালীদা, একরাম, স্বপন চক্রবর্তী দুর্গা দত্ত এবং বিভাস রায়চৌধুরী ইত্যাদি ইত্যাদিকে।

কবি কালী কৃষ্ণ গুহ সবার কাছেই কালীদা। তিনি আমাদের অগ্রজ বন্ধু। আমার কাছে এক আশ্রয়। এক অনন্য আশা। আমি বলেছিলাম, আপনার কাছে বেলা ১১ টায় পৌঁছে যাবো। এগারোটা বাজতে বাজতেই, তাঁর ফোন। আমরা তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে তাঁর আস্তানায়। কালীদা আমার সারা জীবনের কাছে এক পরম প্রাপ্তি। কত কিছু যে তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছি। সাহস পেয়েছি, লেখালেখি করার। আমরা কোথায় খাবো, না-খাবো এও ছিল তাঁর জিজ্ঞাসা। এও এক রকমের পেট ভরে গেল আমাদের। মন ভরে গেল আমাদের।

সাতসকালে একরামের ফোন। কখন যাবো তার কাছে তারও ছিল এই প্রশ্ন। আমি বললাম নটার মধ্যে। সে জানালো, আমরা যেন ন'টাতেই যাই।

একরাম, একরাম আলি ৭০ দশকের একজন প্রধান কবি। সেই কবে থেকে যোগাযোগ। বন্ধুত্ব। সুখ দুঃখ। আনন্দ বেদনা। তার বীরভূমের গ্রামের বাড়িতেও
হঠাৎ হঠাৎ আমার চলে যাওয়া। দিনভর রাতভর তুমুল কাব্য-কবিতা। প্রভাতদা বাবলিদির সিউড়ির বাড়িতে। রাত্রিকেও বেঁধে রাখার এক অপচেষ্টা ছিল আমাদের। মনে হয়েছে, রাত ফুরালেই শেষ হয়ে যাবে আড্ডা। সেই একরাম আমার কাছে জানতে চাইলো, আমরা কজন আছি, কী খাবো।

বারান্দায় মাঘ শেষের রোদ্দুর মেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল একরাম। বীরভূমের লাল মাটির মতোই, তার রক্তিম অভিবাদন ও অভ্যর্থনায় মুহূর্তের জন্য আমি দেখতে পেলাম, সারি সারি তাল গাছের ছায়া।

এই ছায়াইতো রসিকের ছায়া।

হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ধ্যানী এক কবি। কথা দিয়েছিল, দেখা হবে। আমিও স্থির বিশ্বাসে ছিলাম, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হবেই। দেখা তো হয়েছে, দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন ও আলোতে রসদ পেয়েছি বেঁচে থাকার।

কবিতা আশ্রমে বিভাস আমাকে জানালো, আমি খুব জ্যান্ত আছি। অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জ্যান্ত আছি। কতটা জ্যান্ত আছি আমার জানা নেই। আমি জানি, আমার জিয়নকাঠি আমার ভালোবাসা। বিভাসের মতো তরুণ বন্ধুর ভালবাসাও আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে। অমিত সাহা কনক মন্ডলদের মুখের আলোয় চলার পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে সব সময়।

আন্তরিক আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম " ঐহিক " সম্পাদক ও গদ্যকার তমাল রায়ের কাছ থেকে।

আমার কথা হলো, পরিবার থাকলেই একটা টান থাকে। আত্মিক টান। যে আত্মা থেকে আত্মায় আমিও ঘুরতে থাকি। ভালোবাসা নিতেও থাকি তা যতই ক্ষুদ্র হোক, তুচ্ছ হোক আমি নিতে ভালবাসি। যেমন, ঝুপ্পিকে বলেছিলাম----- সজনে ডাঁটার তরকারি খাওয়াবি। সে আমার অনেক আব্দার ও অত্যাচার সহ্য করে আসছে অনেক যুগ। তার ঘরেই তো সঙ্গী সাথী নিয়ে আমার ভালোবাসার সময় কেটেছে।

সঙ্গী সাথী ছাড়া আমি তো এক পাও হাঁটতে পারি না। এই যে আমার নির্ভরশীলতা, আমাকে বড় দুর্বল করে দিয়েছে। এবারের কলকাতা বইমেলা অথবা কলকাতা  ভ্রমণে উত্তম তো ছিলই, সে কাব্য চর্চা করে। ছবি আঁকে। সঙ্গে আরও ছিল অবিন ও বাপি। এই দু'জন কবিতা থেকে অনেক দূরে থাকলেও আমি তাদের কাছে পাই। অন্যভাবে বলা যায়, ওরা কবিতার কাছেই থাকে।

দূরে থেকেও কাছে থাকে অনেক বন্ধু। অনেক বান্ধবী। তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আমার অস্তিত্ব। আমাকে জাগিয়ে রাখে।

কলকাতা যাচ্ছি বলেই, একদিন নন্দিনীর ফোন। তাদের বাড়ি কবে যাবো, কী খাবো এইসব খবর নিয়েছিল।

আমি একটি বটবৃক্ষের ছবি দেখতে পেলাম। বট বৃক্ষ না বৃক্ষ মাতা?

নিঃশর্ত প্রেমের এক সজীবতায় আমি সবুজ হয়ে উঠেছি। মনে হয়েছে, আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আরো কয়েকটা বসন্ত।

পলাশ গাছের তলায় নন্দিনী গাইবে রবীন্দ্রনাথের গান। তার গানে গানে আবেগে ও আনন্দে ঝরে পড়বে পলাশ ফুল।

এই সেই বসন্ত আমাদের দুয়ারে।

আড়াল থেকে এসে নন্দিনীর খোঁপায় রঞ্জন গুঁজে দিচ্ছে পলাশের শুভেচ্ছা।

-------২৯ মাঘ ১৪২৯
------১৩---২---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৮
----------------------------------------------------------

হাসি
এই ফাগুনে আকাশে বাতাসে।
হাসি
এই ফাগুনে গাছে গাছে।

এই হাসি ফাগুন থেকে বৈশাখ।
এই হাসি বর্ষা থেকে হেমন্তে।
এই হাসি কাশফুলে। শিউলি শাখায়।

এই হাসি বন্ধুর মুখেও।

এই হাসি ভালোবাসার মুখেও।

আমি অবাক হয়ে দেখি।

এই হাসির শব্দ শোনা যায় না।
এই হাসি নিঃশব্দ। চন্দ্র সূর্যের আলো।

আমি নিকটে দাঁড়াই। স্পর্শ করতে গিয়ে  ঝরে পড়ে আমার আঁজলায়।

আমার আঁজলায় কবিতা সংগ্রহ। শ্রেষ্ঠ কবিতা। আমার আঁজলায় তৃষ্ণা।

প্রসূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃষ্ণা।

তৃষ্ণা নিবারণ করতে প্রসূণ এগিয়ে চলেছে রাস্তা থেকে রাস্তায়। ভিড় থেকে নির্জনে। ভালোবাসা থেকে আলো বাসার দিকে। প্রসুণের মুঠোয় ধরা পড়বে জল থেকে জলের কণা।

জোনাকির উড়াল।

হৃদয়ের তাপ।

হৃদয়ের তাপ পাই  প্রসূণের কথা থেকে কবিতা থেকে। ব্যথা থেকে আনন্দ থেকে।

তার কবিতা সংগ্রহ তার শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে উদযাপন করি আমাদের বন্ধুত্ব।

-----১ লা ফাগুন ১৪২৯
-----১৪---২---২০২৩
------নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭৯
---------------------------------------------------------

যেখানেই যাব উজ্জ্বলের সাইকেল। সাহেব বাঁধ বা সুভাষ পার্কে ছিল মনোরম আড্ডা। উজ্জ্বলের স্কুল ছুটির পর কিংবা ছুটির দিনে তার সাইকেলে উঠে পড়েছি।

সাইকেলের সামনে বসে থাকাও বেশ বিপদের। দেখতে হয়, গাড়ি ঘোড়া। আর উজ্জ্বল যা গতিতে গাড়ি চালাতো, ভয় করতো আমার। যদি পড়ে যাই!
একবার তো ট্রাকের তলায়। চাকার নিচে। ইউনিয়ন ক্লাবের কাছে। সামনের স্ট্যাড থেকে রিক্সাওয়ালারা দেখতে পেয়ে, চিৎকার। জ্যাম থাকার জন্য ট্রাক চলছিল ধীরগতিতে। কেউ কেউ দূর থেকেই, ট্রাক থামাতে বলছিল। রাজুর চায়ের দোকান থেকেও রব উঠেছিল---গেল গেল গেল।

সে যাত্রায় বেঁচে গেছলাম। আর তাই, উজ্জ্বলের সেই সাইকেলটা মনে পড়ছে।

ময়ূখের সাইকেলে আমি কি উঠেছি? তার সঙ্গে সিনেমা হল। সে তো আমাদের বাড়ির কাছেই। ময়ূখ সাইকেলে থাকলেও আমার মনে হচ্ছে, তার সাইকেলে
আমি উঠিনি। হয়তো বা সঠিক তথ্য দিতে পারে ময়ূখ নিজেই।

রামাশিসের সাইকেলে যে উঠিনি স্পষ্ট মনে আছে। তখন সেই ৮৫--৮৬ সালে উজ্জ্বল ময়ূখ রামাশিস ১১/১২ তে। পুরুলিয়া জিলা স্কুল। সায়েন্স। সাইকেলেই স্কুল।

ওরা অনেকবার আমাকে বলেছে, চলুন---আপনাকে সাইকেলটা শিখিয়ে দিই। দুদিন সাহেব বাঁধ গেলেই হবে।

তখন সাহেব বাঁধের চারপাশে এত বাড়ির ভিড় ছিল না। দোকানপাট নার্সিং হোম ছিল না। মুক্ত আবহাওয়ার নান্দনিক পরিবেশ। সেই জায়গাতে এক স্কুল বালক ৪০ ঊর্ধ্বের এক লোককে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছে, কারোর চোখে পড়লেও লজ্জায় ফেলবে না। বোধ হয় এই মনোভাব, বিশেষ করে উজ্জ্বলের ছিল। সেইতো আমাকে সাইকেল চালানোর কথা বারবার বলেছে। কারণও ছিল, বেশিরভাগ সময়েই তাকেই টানতে হতো আমাকে।

আমার প্রতি টান ভালবাসাও ছিল তীব্র। সাধারণত, উজ্জ্বল ও ময়ূখ যে কোনো আড্ডাতে থাকলে আমি ময়ূখের সঙ্গেই কথাবার্তা। গভীর। অগভীর। সেই তখন উজ্জ্বলের মনে হয়েছিল, তার ভালোবাসাতে কম পড়ছে। লক্ষ্য করা গেল, সে চুপচাপ হয়ে যেত। অথবা চলে যেত বাড়ির দিকে মুখ কালো করে।

ময়ূখ আমাকে একদিন বললো---উজ্জ্বল থাকলে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

ময়ূখ বুদ্ধিমান। তার টোটকাতে কাজ হয়েছিল। উজ্জ্বলেরও মনে হয়েছিল, নির্মলদা তাকেই বেশি ভালোবাসে।

আমার সেই ভালোবাসা কতটুকু আছে, আমি বলতে অক্ষম। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু চাপা পড়ে গেলেও বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কোনো কোনো স্মৃতি এখনো জ্যান্ত হয়ে আছে। সজীব হয়ে আমার কাছে চলাফেরা করে। আমি আজও ভালোবাসার ধর্মে বাঁচি। আমি আজও উজ্জ্বল ময়ূখ রামাশিসের নিকটেই আছি। কেবল ভালোবাসা নিয়ে দড়ি টানাটানি নেই।

ভাবতেও ভালো লাগে, রাঁচি রোড থেকে ময়ূখ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে, সাইকেল নিয়ে ছাতিমতলার দিকে। আস্তে আস্তে বাকিরা এসেও সাইকেল রেখে বসে পড়ছে। রামাশিস তো এসেই বাবলুর দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে চারমিনারে টান।

সেই সিগারেটের ধোঁয়ায় অনেক অনেক কিছু আবছা হয়ে গেলেও অস্পষ্ট হয়ে যায়নি অমলিন ভালোবাসার সেই দিনগুলি।

-----দুপুর---২--২
-----২ ফাগুন ১৪২৯
-----১৫---২---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮০
---------------------------------------------------------

আমি সুখী
সুখ কাকে বলে জানো?
সুখ সেই বিষণ্ণতা 
যে আমার কোলে বসে থাকে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার আংশিক উদ্ধৃতি করে বলতে চাইছি----শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই এখনো আমাকে জড়িয়ে আছেন। আরো অসংখ্য পংক্তি আমার রক্তের ভেতরে সব সময় গুনগুন করে।

প্রশ্ন আসতে পারে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কি আমাকে প্রভাবিত করেছেন?

এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে 
আমার জন্মের কোন শেষ নেই।

শঙ্খ ঘোষের কবিতার এই পংক্তি আমাকে শান্ত করে। তাঁর অনেক পরের বই "লাইনেই ছিলাম বাবা "পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, এইরকম একটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আমি পেলে  মনের জোর বাড়তো।

তবে কি প্রভাবের কথা বলতে চাইছি? না, আমি শঙ্খ ঘোষ দ্বারা প্রভাবিত নই। আমি তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকেই গ্রহণ করতে চেয়েছি।

কখনো কখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তারাপদ রায় উৎপল কুমার বসু বিনয় মজুমদার পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এঁরা বাংলা কবিতার রত্ন। কিন্তু কেউই আমাকে প্রভাবিত করেননি। এঁদের কবিতা আমাকে বাজিয়ে দেয় কখনো সেতারের মতো। কখনো ঘুঙুরের মত। কালীকৃষ্ণ গুহ দেবারতি মিত্র ভাস্কর চক্রবর্তী মানিক চক্রবর্তী আরো কেউ কেউ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন।

আমি পছন্দ করি।

মনে হয় এ সমস্ত আমারই কবিতা। এঁদের কবিতা বাংলা কবিতাকে জাগিয়ে রেখেছে।

রণজিৎ দাশ আমাদের কিছু আগে শুরু করছিলেন লেখালেখি। আমি নিজে লেখালেখি করতে এসে রণজিৎদার কবিতার স্মার্টনেস আমাকে প্রভাবিত করেছিল। পরে দেখলাম, এই জায়গাটা আমার নয়। আমাকে থাকতে হবে আমারই জায়গায়। অমিতাভ গুপ্তর "মাতা ও মৃত্তিকা" ও "খরা ও যমুনা" আমাকে আলোড়িত করেছিল। প্রভাবিত করেনি। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালও তাই। তাঁর প্রথম কবিতার বই "দেবী" পাঠের পর অনেক বন্ধুকেই বলেছি, এই হলো কবিতা।আবার এও বলেছি, এ কবিতা থেকে কেউ প্রভাবিত হলে ডুবে যাবে।

আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে লোক জীবন।ঝুমুর টুসু ভাদু অহিরা। এ সমস্ত গান হলেও সব সময়ের জ্যান্ত কবিতা। জীবন থেকে উঠে আসা মহাজীবনের কবিতা। ছন্দ ও শৈলির মারকাটারি দেখানেপনা নেই, যা আছে তা হলো অনুভূতি অভিজ্ঞতা উপলব্ধির প্রকাশ। সহজ ভাষায় সরল করে। এক কথায়, প্রাণের প্রকাশ। রক্ত ঘাম ধুলোমাটি লেগে থাকা জীবনের প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান নকল করতে ইচ্ছে করে। মনে মনে হাসিও। ওই উচ্চতার কাছে আমি ধুলো নই। ধুলো বললে তো এক অস্তিত্বের কথা বলা হয়, আমি এক বিন্দু ধুলো নই।

প্রাচীন কবিতাও আমাকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু সেই প্রাচীন কবিদের মতো আমার কব্জির জোর নেই। আমি সেই প্রাচীন কবিতা থেকেও সরে দাঁড়াই।

ব্যক্তি মানুষও আমাকে প্রভাবিত করেছে। নারী হোক পুরুষ হোক এখনো আমাকে প্রভাবিত করে। শিশু আমাকে উজ্জীবিত করে। আমাকে কবিতার দিকে নিয়ে যায়। এইসঙ্গে আছে আমাকে ঘিরে থাকা নিসর্গ প্রকৃতি। তার সৌন্দর্য। তার আলো ছায়া। তার উজ্জীবন আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে। তার রহস্য আমাকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। যদিও প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে আমি নেই। আমি শুধু নতজানু হয়ে থাকি প্রকৃতির কাছে।

আমার সময় আমাকে উত্তেজিত করে। আবেগী করে।আমি সময়ের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। এই সময় এই দেশ এই রাজনীতির কদর্যতা আমাকে বিচলিত করে।আমি আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে দু এক কথা বলার চেষ্টা করি। আমার ভাষায় প্রতিবাদ।

চারপাশের শিক্ষা সংস্কৃতির যা হাল যেকোনো সংবেদনশীল মানুষকে বিচলিত করবেই। সেই বিচলন থেকে যারা রাস্তায় নামে তাদের রুখে দাঁড়ানো একরকম, আর কবি লেখকদের প্রতিবাদ কাগজে কলমে। দেখা যাচ্ছে যদিও আজকাল অধিকাংশ কলমের শিরদাঁড়া নেই। কলম থেকে যে কালি বাইরে আসে তার রঙ শাদা।

অসহায় লাগে নিজেকে।

আমার অসহায়তা আমাকে প্রভাবিত করে। আমি শব্দ খুঁজি। ভাষা খুঁজি। কখনো কিছু না পেলে আমি কেঁপে উঠি। আমি কাঁদি।

চোখের জলের মতো অস্ত্র আমাকেই আঘাত করে।তখন আরো আরো আমি অসহায়। আমি তাল গাছের দিকে তাকিয়ে শান্ত হই। শাল গাছের দিকে তাকিয়েও নিজের শক্তি অর্জন করি। মনোবল খুঁজি, অজস্র মানুষের দিকে তাকিয়ে।

মানুষই তো হুঁশ।

মানুষই কবিতা। আবহমান।

-----৩ ফাগুন ১৪২৯
-----১৬--২--২০২৩
-----দুপুর--১--৫০
-----নির্মল হালদার





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ