আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬১
----------------------------------------------------------
কাক এসে ঘরের চালায় বসলো। উঠোনে পড়ে নেই এঁঠোকাঁটা। বিফলে গেল প্রত্যাশা।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
পায়রা এসেও ঘরের চালায়। উঠোনে ছড়ানো নেই চালের খুদ। প্রত্যাশা বিফলে গেল।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
কুকুর এসেও ফিরে গেল। কোনো খাবারই নেই। সকালের প্রত্যাশা হতাশার দিকে।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
মৌমাছিরা উড়ে উড়ে গাছে গাছে ফুল দেখতে পায় না। আর কোথায় খুঁজবে মধু? প্রত্যাশার এই সকালবেলায় মন মরে গেল মৌমাছিদের।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
পাখি গাছের ফল ঠুকরে খেতে যাবে যেই পড়ে গেল মাটিতে।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
নদী ও পুকুরে জল শুকিয়ে গেলে কোথায় যাবে মাছেরা? জলের জন্য তাদের প্রার্থনা কে শুনবে?
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
জঙ্গলের ঝর্ণায় জল খেতে গিয়ে হাতিরা দেখতে পায়, কেবল পাথর আর পাথর। তাদের দৈনন্দিন জীবনে, একটা বড় আঘাত।
প্রত্যাশায় ভুল আছে কি?
শুঁড়ে তুলে কাকেই বা মারবে আছাড়?
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
স্বপ্নের দিকে যেতে যেতেও শুঁয়োপোকা রয়ে গেল শুঁয়োপোকা হয়েই।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
গাই--গরুর দল মাঠে গিয়েও পেল না একটিও ঘাস। চরে বেড়ানোর ফুর্তিটুকু প্রত্যাশাটুকু এক নিমেষে অন্ধকার।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
চাষিরা শীত কালেও দু একটা বৃষ্টির আশা করে। কাজে লাগে শাক সবজির। চাষিরা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে, মেঘ এসেও চলে গেছে।
অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?
পানের সঙ্গে চুন খয়ের না থাকলে কে কার প্রতি অভিমান করবে? ডালের সঙ্গে নুন হলুদ না থাকলে
কে কার প্রতি অভিমান করবে?
ও আমাকে পাহাড় দিলো না। প্রেম দিলো না। অভিমান করবো?
" অভিমান তো সেই কোকিল যে কেবল নিজেকে লুকায় ।"
-----৩ মাঘ ১৪২৯
-----১৮---১---২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৬২
-----------------------------------------------------------
যে মহিলা সবজির ঝুড়ি মাথায় হেঁটে আসছে দশ কিলোমিটার দূর থেকে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে মহিলা ধানক্ষেতের আলে শিশুর সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে ধান কাটছে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে মহিলা ভোরের অন্ধকারে গুগলি-শামুক কাড়ছে পুকুরের শীতল জলে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি।
যে বালকের মাথায় ইটের বোঝা আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে বালক হোটেলের থালা-বাসন ধুচ্ছে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে বালক মটর মেকানিকের সঙ্গে কালি ঝুলি মাখে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি।
লাঙ্গল নেই। ট্রাক্টরের ভাড়া দিয়ে আবাদ ফলানো যাবে না। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা। ঘরে ধান চাল নেই, কাজ নেই শহরে। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা। পণের অভাবে বিয়ে দিতে পারছে না মেয়ের। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা।
এই যে জীবন, প্রাণ প্রবাহ আলো অন্ধকার, এই যে টানাপোড়েন, হোঁচটের পর হোঁচট এখান থেকেই শিল্পের জন্ম। এখানে ছন্দ বিশারদ এসে দাঁড়ালে, আঙ্গিক কুশলী এসে দাঁড়ালে জীবন জীবনের কাছেই থাকবে। সহজ সরল। নিদ্রা অনিদ্রায়। ঘামের গন্ধে। রক্তের চলাচলে।
এখানে কাব্য সমালোচক, তাত্ত্বিক ও পন্ডিত এসে দাঁড়ালেও ছিটকে পড়বেন।
আমার চেয়ে থাকাই আমার কবিতা। তা যদি শিল্প না হয়ে ওঠে না হোক, আমি চেয়ে থাকবো ছেঁড়া খোঁড়া জীবনের দিকে। যে জীবনের কাছে জল নেই। মাথার ছাদ নেই। শিক্ষা নেই চিকিৎসা নেই। চারদিকে শুধু আত্ম অহমিকার প্রকাশ। চারদিকে আত্ম সর্বস্ব প্রচার। অগণিত মানুষকে ছোট করার বড় প্রয়াস।
আমি চেয়ে থাকি।
আমি রচনা করি আমার প্রতিবাদ। আমার প্রতিরোধ। আমার সঙ্গে থাকে অজস্র পায়ের শব্দ। হাতে হাত। আড়ালে থেকেও থাকে। সব সময় এই সাহস আমাকে লেখায় আমার কবিতা।
কেন না, জন্মের পরেই মানুষ ধ্রুপদী হয়ে ওঠে। শিল্প তার অনেক অনেক পরের কথা।
-----৪ মাঘ ১৪২৯
----১৯---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা-----কাঠবিড়ালির লাফ---৬৩
-------------------------------------------------------------
ব্যর্থতা কাকে বলে? আর কাকে বলে সাফল্য? এরকমই একটি প্রশ্ন করেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী তার বন্ধু সুব্রত চক্রবর্তীকে।
দুজনেই কবি ছিলেন।
ব্যর্থতা কি ভাস্কর চক্রবর্তীকে জড়িয়ে ধরেছিল?সাফল্য কি জড়িয়ে ধরেছিল সুব্রত চক্রবর্তীকে?
আমার জানা নেই।
যে সব সময় প্রচারের আলোয় ও বাজারে বিপণনে, সেই কি কবি? শিল্পী? নাট্যকার? অভিনেতৃ? সেই কি সফল?
যে রচনা করে নিভৃতে নিরালায় যার সৃষ্টির কাছে আলো পড়েনি, সেই কি ব্যর্থ?
বিচার করবে কে? বাজার?
যার যত প্রচার সে তত বিখ্যাত, সেই কবি লেখক, শিল্পী কোন্ মানদণ্ডে?
আমাদের এই বাংলায় অনেক কবি শিল্পী আছেন, যারা নিজের মতো করে নিজের জায়গায় প্রচারের বাইরে সৃষ্টিতে মগ্ন, যাদের কোনো সমাদর নেই, তাদের ব্যর্থ বলবো?
কলকাতা শহরেই অনেকেই আছেন একা একা নিজের সৃজন কাজে, যাদের সৃষ্টি অথবা কবিতা গল্প ছবি ভাস্কর্যের কাজ অনন্য অসাধারণ। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে গল্পকার ঔপন্যাসিক স্বপন চক্রবর্তীর কথা। দুর্গা দত্তর কথা। মনে পড়ছে সিউড়ির গৌতম দাসকে। যে যুবক চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিল অফিসে ঘুষ নিতে পারবে না বলেই। সে শুধু কবিতা লিখতেই চেয়েছিল।
মারা গেল অকালে।
তার আপসহীনতার কাছে আমি দন্ডবৎ।
বোলপুর শান্তিনিকেতনে সংঘমিত্রা ঘোষ নিয়মিত কবিতাচর্চা করেও নিজে আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। তাকে কবি বলবো না? বোলপুরের আরেকজন রামানুজ মুখোপাধ্যায় কলেজ বয়সে রচনা করেছে কবিতার পরে কবিতা। আজ সেই পথ ফেলে দিয়ে সে গদ্য ও প্রবন্ধের দিকে। তাকে ব্যর্থ বলবো নাকি সফল?
যদি বলি, কোথাও ব্যর্থতা নেই কোথাও সফলতা নেই, শুধু নিজের কাজ করে যাওয়া।
অমিতাভ মন্ডল কলকাতায় থাকলেও তার বন্ধুরা ছাড়া তাকে চেনেনা আজকের সাহিত্য সমাজ।
অমিতাভকে ব্যর্থ বলবো?
হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কি তরুণ কবি সমাজে খুব পরিচিত নাম? সে মঞ্চ থেকে ক্যামেরা থেকে দূরত্বে থাকে। প্রভাত সাহার কবিতা ক'জন পড়েছে?
পুরুলিয়ার অজ গাঁয়ে থাকে অনিল মাহাত। সেই বাহাত্তর সাল থেকে কবিতাচর্চা করে নীরব থেকে নীরবতায়। পশ্চিমবঙ্গ কেন, তার খোঁজ রাখে না পুরুলিয়ার শিল্প সংস্কৃতি জগত। ২১ বছরের যুবক মুকেশ কুমার মাহাত মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে দেখতে পেয়েছে কীটপতঙ্গের চলাফেরা। সে কোনো ফটোগ্রাফারের কাছে ন্যাড়া বাঁধেনি। সে ছবি তুলতে তুলতেই জেনেছে মোবাইল ক্যামেরাতেও একটা চোখ আছে। এবং নিজের দুটো চোখ। অর্থাৎ তিনটে চোখ এক করে এই চরাচরকে পর্যবেক্ষণ। উত্তম মাহাতর ভাষায় মুকেশ হলো একলব্য।
কবিতা লিখতে লিখতে সরে দাঁড়ালো দেবমাল্য মাহাত।
ব্যর্থতা বলবো?
হিমালয়ের চূড়াতে অনেকে ওঠে। শৃঙ্গ বিজয় করছে অনেকে। গজাবুরুতেও অসংখ্য তরুণ উঠছে।
কে সফল আর কে সফল নয় বিচার করবে কে?
লাল রঙ গাঢ় হলে এক রকমের সৌন্দর্য। লাল রঙ একটু হালকা হলে আরেক রকমের সুন্দরতা। দুটি রঙই প্রধান। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজন নয়।
চিত্রকলার জগতে চিত্রকরদের আসা যাওয়া চলছেই।এক -একজন একেক রকম চিহ্ন রেখে যায়। আর আদিবাসীরা নিজেদের ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকে।
ছবিগুলি কে আঁকে?
আশিস নন্দীর ছবি দেখতে ক'জন ছুটে যায়? সে পুরুলিয়া শহরে আঁকার স্কুল খুলে যেমন জীবিকা অর্জন করে, তেমনি ছবি আঁকে নিজেও নিয়মিত। ধারাবাহিক।
দীপংকর রায়ের কবিতার বই কার কাছে? তিনি কবিতা বাদেও গল্প উপন্যাস লেখেন।
"স্লো পয়জনের ফাইল" প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরেই অজ্ঞাতবাসে চলে গেল মন্থন মোদক। আমরা তার পাঠকেরা তার কাছে আরো নতুন কিছু আশা করছিলাম।
কিছুই কিছু নয় এই বোধ কি তাকে অস্থির করে তুলছিল?
"থিরবিজুরি" শুধু সম্পাদনা করে না। বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রবন্ধ লেখালেখি করে অপূর্ব সাহা। নীরবে। আমরা তার কতটুকু খবর রাখি?
কীসের অভিমান? কবিতা থেকে মাইল মাইল কিলোমিটার দূরে অনির্বাণ দাস? নবাবই দশকের এই কবির কবিতা আমাদের এক সময় আলোড়িত করেছে খুব।
জগন্নাথ দত্তের কবিতা চর্চাও নির্জনে। সে কবি অনেকে জানলেও তার কবিতার কাছে কজন ঝুঁকে পড়েছে?
বাজার ও বিপণন থেকে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ আড়ালে থাকে। প্রবীর ভট্টাচার্যের নাম নিঃশব্দ থেকে যায়। সেও তো কলকাতার ভিড়ে একা। তার কবিতাও নির্জন।
আমার মনে হয়, অনেক পাঠকের কাছেই নির্জনতা প্রিয়। কোনো কোনো পাঠক আছে নীরবতা থেকেই সংগ্রহ করে নীরব শিল্প।
ওর বাজারদর আছে বলে ও কবি। ওর বাজারদর নেই ও কবি নয়, এই সহজ অঙ্ক মান্য করা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে অনেক গুণী মানুষ আছেন যারা আলোকবর্তিকা নিয়েই হেঁটে চলেছে ধুলামাটির রাস্তায়। তাদের পায়ের শব্দ সকলের কানে পৌঁছবে না কোনোদিন।
আমি নিজেও কবিতা লিখতে আসিনি। নিজের অনুভব গুলি লেখার চেষ্টা করি মাত্র। থাকিও ঘরের এক কোণে। চন্দ্র সূর্যের আলোটুকু সম্বল করে। বেদনা একটাই, অভিমন্যু মাহাত একটা অজ গাঁ থেকে উঠে এসেও সে আজ নগরে। কর্মসূত্রে নগরবাসী হতেই পারে তা বলে সে ভুলে যাবে নিজের শিকড়? উত্তম মাহাত শিল্পের জন্য এখনো লড়াই করেই চলেছে।
মাটি পাথর সিমেন্ট বালি নিয়ে ভাস্কর্যের দিকে রাজীব মন্ডল। কোলকাতার কোলাহল থেকে দূরে নিজের কাজে বুঁদ হয়ে থাকে সব সময়।
আমার শহরে ব্রততী পরামানিক টিউশনি করেও কবিতা চর্চায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, সময়ের সঙ্গে সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে জানে।
ভাস্কর চক্রবর্তীর অমোঘ পংক্তিটি আরেকবার উচ্চারণ করে আমার নমস্কার জানাই----
ব্যর্থতা কাকে বলে? আর কাকে বলে সাফল্য?
------৫ মাঘ ১৪২৯
-----২০---১---২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬৪
---------------------------------------------------------
বিশু কবিতা লিখত।
বিশু মানে বিশ্বনাথ বাউরি। গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল লেখাপড়া করতে। প্রথমে বিএসসি। পরে বদলে গিয়ে ইতিহাস অনার্স। মাস্টার ডিগ্রীও করেছে। তাদের গ্রামে সেই প্রথম এমএ। স্কুল বয়সে তবলাও শিখেছে বিশু। এক আধটু গান বাজনা। পুরুলিয়া শহরে " লৌকিক "ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবলা বাজাতো। কিবোর্ড বাজাতো। সেই বিশু, বিশ্বনাথ বাউরি কবিতা থেকে গান বাজনা থেকে অনেক দূরে। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি এবং সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন ব্যস্ত।
আমার একটা স্বপ্ন ছিল, মুখার্জি ব্যানার্জি চ্যাটার্জি ঘোষ বোস মিত্তিরদের পাশাপাশি বাউরি সম্প্রদায় শিল্প সাহিত্যে এগিয়ে আসবে। শুধু শিল্প সাহিত্য নয়, রাজনীতি থেকে প্রশাসনেও দেখতে পাবো পিছিয়ে পড়া অবদমিত শ্রেণীকে।
বাস্তব অন্য কথা বলে, বিশুরা ঘর সংসার সমাজের চাপে দুমুঠো জোগাড় করার চাপে শিল্প ও সাহিত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। বিশুতো তবু স্কুল কলেজ গেছে, তাদের সম্প্রদায়ের বাকি সব ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যেতেই পারে না। অনেকটাই দারিদ্র্যের কারণে। চেতনার অভাবে। ফলে, বিশ্বনাথ বাউরির একটি কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে মুখোমুখি হতে পারলো না আজকের বাংলা কবিতা। আমি অবশ্যই আরেকজন কবিকে চিনি, সে হলো জয়দেব বাউরি। ধারাবাহিকভাবে কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসে আছে সে। বিশ্বনাথ বাউরি এলে এবং কবিতার সঙ্গে থাকলে বাংলা কবিতা দু'জন বাউরিকে পেতো।
মাহাতরা আসছে। সমাজের নানান স্তরে দেখতে পাই মাহাতদের মুখ। আদিবাসীরাও নিজেদের ভাষায় সৃষ্টি করে যাচ্ছে গল্প কবিতা নাটক। খুব আনন্দের বিষয় আদিবাসীরা রক্ষা করছে নিজেদের ভাষা। সাঁওতালি ভাষার হরফ তৈরি করেছেন রঘুনাথ মুর্মু। কুড়মালি ভাষা রক্ষা করতে অথবা সংরক্ষণের জন্য সাম্প্রতিককালে উদ্যোগ দেখতে পাই। সাঁওতালি ভাষায় শিশু সাহিত্যে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পেয়েছে গণেশ মারান্ডি।গণেশ আমাদেরই ঘরের ছেলে। পুরুলিয়া বর্ধমান সীমান্তে তাদের গ্রাম মহেশ নদী।
আরো অনেক অনুন্নত শ্রেণী এই দেশে এই বাংলায়।
ডোম বা কালিন্দীরাও শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনেক পিছিয়ে আজও। অনাময় কালিন্দী কবিতা লিখলেও চর্চাতে খুবই মন্থর। তার কাছ থেকে আশা করতে পারি, সে কালিন্দী সম্প্রদায়ের ভেতরে আলো ফেলবে। তার চেষ্টাও থাকবে বৈকি, সে অন্তত সম্প্রদায় থেকে সবাইকে না হলেও দু চারজন যুবককে আলোকপ্রাপ্ত করে তুলবে।
এদেশে এই বাংলায় শিক্ষা ব্যবস্থার যা হাল, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরাও নিজের নামের বানান ভুল লেখে। শিক্ষক মহাশয়রা স্কুলে পড়াতে যান না চাকরি করতে যান?
রাসু হাঁড়ি ছো--নাচে ধুলো উড়িয়েছিলেন এক সময়। আজ ধুলো ওড়ায় নৃপেন সহিস।
সহিস বা হাঁড়ি সম্প্রদায় থেকে মেয়েরাও উঠে আসছে ছো-শিল্পে। মাহাত সম্প্রদায় থেকেও ঝুমুর নাচে গানে ও ছো-নাচে স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে মেয়েরা।
শিক্ষার অন্যান্য দিকে?
মাহাতরা শুধু কি ভোট ব্যাংকের পুঁজি? মিছিলের মুখ? বাউরি সম্প্রদায় ভোট ব্যাংকের পুঁজি? জ্যোৎস্না মান্ডিকে মন্ত্রীর পদ দিয়ে আদিবাসী সমাজের কতটুকু উন্নতি হলো? সন্ধ্যা রানী টুডুকে ক্ষমতা দান করে আদিবাসীরা ক্ষমতা পেয়েছে কি?
বেনে তামলি ময়রাদের মত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সম্প্রদায় বাণিজ্যের দিকে চলে যায়। কারো কারো ছোট পুঁজি বড় পুঁজির কাছে হারিয়ে গেলে ছোট পুঁজিকে রাস্তায় বসতে হয়।
মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের ভিতরে কেবল শ্যাম অবিনাশ একা কবিতা গল্পে উপন্যাসে। আর যদি কেউ লেখালেখি করছেন আমার কাছে খবর নেই।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা পেয়েছি মুজিবর আনসারীকে। ইতিমধ্যে মুজিবর বাংলা কবিতায় নিজের ছাপ রেখেছে। এছাড়াও মহঃ খুরশিদ আলম কবিতা বাদেও লোকসংস্কৃতিমূলক প্রবন্ধে জাগিয়ে তুলছে নিজের প্রতিভাকে।
নিরাময় মুদি গন্ধবনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন। একটি কাব্যগ্ৰন্থ প্রকাশের পর নিজেকে গুটিয়ে ফেললো।
নাপিত বা পরামানিক সমাজ থেকে লিখতে এসেছিল সুবোধ পরামানিক। ধারাবাহিকভাবে না থাকার জন্য ক্ষুরধার হয়ে উঠলো না তার কবিতার ভুবন। বিদ্যুৎ পরামানিককে মাঝে মাঝে দেখতে পাই।
দুঃখ হয় সঞ্জীব বাউরি চিত্রকলায় মনোনিবেশ করলো না। আমরা খোঁজ পেলাম না তার মগ্ন চৈতন্যের। সাবান ফেনার মতো হেসে উঠেছিল ব্রজ কিশোর রজক। তার অক্ষর ও শব্দ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ওঠে না।
আমরা কি তবে ভট্টাচার্য গাঙ্গুলী রায়দের লেখালেখি পড়বো শুধু? আমরা কি শুধু সরকার মল্লিক সেনগুপ্ত দাশগুপ্তদের শিল্প সাহিত্যের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে উঠবো?
গরু চরাতে চরাতে একটি বাগাল ছেলেও গাছের পাতায় মাঠের ধুলোয় তার অন্তর ধ্বনি রেখে যায়। বেলা শেষে। সেই লেখার খোঁজ কে করবে?
কে এগিয়ে দেবে? কারা এগিয়ে দেবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে? ধীবর কী শুধু জাল ফেলে মাছ ধরবে? রুহিদাস কী শুধু মাথা নিচু করে জুতোয় পেরেক ঠুঁকবে? চেতনার দ্বার বন্ধ করতে কে বা কারা প্রয়াসী হয়েছে, খোঁজ করতে করতে চলো যাই, সদর দুয়ারে কামান দাগি।
-----৮ মাঘ ১৪২৯
-----২৩---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৫
---------------------------------------------------------
গাছপালায় ঢাকা আঁধার এবং রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলেছে সে। কতদূর হেঁটে হেঁটে যাওয়া, সে জানে না। কোথায় যাবে সে জানে না।
আঁধারে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে যাওয়া।
ঝিঁঝিঁ পোকা শব্দ করছে না একবারও। পা পড়লেও শুকনো পাতা থেকে শব্দ ওঠে না।
জোনাকি নেই।
হেঁটে যাওয়া হেঁটে যাওয়া।
কোথাও কোনো জায়গায় দমকা হাওয়া এসে জড়ো হয়ে আর শব্দ করে না।
চারদিক নিশ্চুপ।
যেন বা ছুঁচের ছিদ্রেও শব্দের আসা-যাওয়া নেই। যেন বা জন্ম নেই মৃত্যু নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে কার কাছে যেতে হবে, সে জানে না।
তৃষ্ণা এসে আটকে গেছে গলায়।
গাছের গায়ে একবার ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো, গাছটা উপড়ে উঠে পালিয়ে যাবে কোথাও। সে আতঙ্কে আঁতকে উঠলো।
বসে পড়তেই মনে হলো একটা পাথরে বসেছে।কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলতেই, পাথরটা নড়ে চড়ে উঠলো। কেঁপে উঠলো সেও।
হেঁটে তো যেতেই হবে।
সে আঙুলের রেখা গুনতে গুনতে এগিয়ে গেলেও ভুল হয়ে যায় কররেখা। সে কামড়ে ফেলে দু'হাতের দশটা আঙুল। দেখতে চায়, ঠিক ঠিক জায়গায় ঠিক ঠিক আঙুলগুলি আছে তো!
সে হোঁচট খেয়ে পড়ে। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারে রক্ত নয়, জল বইছে সারা শরীর থেকে।
সে চিৎকার করে ওঠে------
প্রতিধ্বনি নেই।
তার জুতো ছিঁড়ে গেছে। প্যান্ট শার্ট ফালা ফালা। তার মনে পড়ছে না কাউকেই। যন্ত্রণাও কি মনে আসছে?
হেঁটে তো যেতেই হবে।
হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ একটা ঘর। গাছপালা ঢাকা।অন্ধকারে অন্ধকারে শব্দহীন। সে ঢুকে পড়লো ঘরের ভিতরে।
দুটো জানালা। ভাঙ্গা। দরজায় কপাট নেই। মাটির দেয়ালে উইপোকা। চামচিকে উড়ে বেড়ায়।
একটাই মাত্র ঘর। তার মাঝে একটা প্রদীপ।কোনোদিন শিখা ছিল। কার ফুঁয়ে নিভে গেছে?
সে পকেটে দেশলাই খুঁজলো। যদি পুরনো সলতে জ্বালানো যায়। যদি নিজের সঙ্গে জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা বলা যায়!
-----১০ মাঘ ১৪২৯
----২৫---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন