মাটিতে রামধনু ওঠে - ৬
মাঠের পর মাঠ। টাঁড় জমিও বলা যায়। ফসল ফলে না। যতদূর দৃষ্টি যায় একটিও গাছ নেই। কেবল মাঠের পর মাঠ। ঝাঁ ঝাঁ করছে চৈত্র শেষের রোদ।
মধ্য গগনে সূর্য।
রাস্তার পরে রাস্তা ধূ ধূ করছে ডাইনে বাঁয়ে। পথ চলতি মানুষের ছায়া পড়ছে না একবারও। একটি সাইকেলও দুম্ করে পাশ দিয়ে চলে যায় না।
দূরে কত দূরে ছায়া?
ছায়ার আনন্দ?
রাস্তা থেকে নেমে ঢালুর দিকে গেলেও কোথাও জমে নেই এক বিন্দু জল। দু ফাঁক মাটি। জ্বলে গেছে ঘাস। গরু ছাগল ভেড়া চলে গেছে নিজেদের ঘর। বেলা পড়ার আগে হয় তো আরেকবার আসতে পারে মাঠে। যদিও মাঠে নেই শস্য বীজ।
অচেনা অজানা কোনো পাখিও তার ডাকার সঙ্গে নতুন কোনো পথ দেখায় না।
কার হাত ধরবো আমি?
হঠাৎ করে মনে হলো, এক একটা অফলা জমি আমার এক একটা অতীত। আমার দিকে চেয়ে রোদের মতো হাসছে। যে হাসি চিরে ফেলছে আমাকে।
রক্ত নেই।
আছে শুধু রোদের মতো ঘাম।
হঠাৎ মাথায় ফিনকি দিয়ে কে যেন বললো---রাকাব জঙ্গলে আছে সিঁয়া কুল। শুকনো মহুল।
সঞ্চিতা আছে সুকুমার আছে। ওরা জল দেবে। ওরা সারাদিন সকলের তৃষ্ণা নিবারণ করে।
সঞ্চিতা কই? সুকুমার কই? দূরে বহু দূরে দেখতে পাই, একটি খড়ের চালা। কাছে গেলে দেখা পাবো? কার দেখা পাবো? কাদের দেখা পাবো?
চটির ভেতরে গরম বালি। শুকনো। হেঁটে যেতে হবে। যদি না যাই? যদি আমার এই মাঝ রাস্তাতেই ডাকি: ও বাপি বাপি--অবিন অবিন----কোথায় গেলি রঞ্জন?
রক্তকরবী না দেখতে পাই আমি দেখতে চাইছি আকন ফুল। আমি ডমরু বাজাবো।
ডমরু।
-----২৩ চৈত্র ১৪২৯
----৮---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৭
দরজার বাইরে পড়ে আছে চটি জোড়া। কে কবে খুলে গেছলো চটি? কার চটি? চৈত্রের দিন চলে যাচ্ছে। তার আগে চলে গেছে ফাল্গুন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ আসছে। চটি জোড়া কি পড়ে থাকবে এখানেই?
কার্নিশে একটা পায়রা এসে এদিক-ওদিক চাইছে। কাকে খুঁজছে এই দুপুরে? তুলসি গাছের নিকটে নেই একটা বড় গাছ। কে আসবে ছায়া দিতে? জল দিতে কে আসবে?
তুলসি গাছ সঙ্গ চাইবে কার?
সঙ্গ এক সহযোগিতাও।
সহযোগিতা ছাড়া একটা ইঁটের সঙ্গে একটা ইঁট জুড়তে পারে না। দেয়াল উঠতে পারে না। গড়ে উঠবে না ঘর।
দিকে দিকে ঘর গড়ে উঠছে। ক'জনের ঘর কতজনের ঘর? ঘর কি আশ্রয়?
ঘরের বাইরে পড়ে আছে এক জোড়া চটি। অসহায় লাগছে। কেননা, চটির তলায় রাস্তা নেই। চটি শব্দ করে কোথাও যে যাবে, কোনো সুযোগ নেই।
একটা হাওয়া এলো। জোরালো। চটি জোড়া এক ফোঁটা নড়াচড়া করে একই জায়গায়।
চটিতে পাঁচ আঙুলের দাগ। আঙুল গুলি কেমন ছিল? নারী না পুরুষের আঙুল? আঙুল গুলি স্পর্শ করেছিল আরো কোনো আঙুল? আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ছড়িয়ে ছিল উত্তাপ?
আজকের রোদ মনমরা লাগছে।
চটি জোড়া পড়েই আছে দরজার বাইরে। ভেতরে ঢুকবে না?
কেউ নেই ভেতরেও।
ট্রেনের শব্দ আসছে। কোত্থেকে আসছে? মধ্যপ্রদেশ? ছত্রিশগড়? ঝাড়খন্ড? বিহার?
আমি তো জানি আমার দেশের রাজ্যগুলি হেঁটে হেঁটেই আসে নিজের নিজের ঘর। তবে ট্রেন আসছে কেন? কাকে নিয়ে আসছে?
চটিজুতোয় পা গলাবে কে?
তুই?
তোর পা তো অনেক ছোট।
----২৫ চৈত্র ১৪২৯
----৯---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৮
আলমারিতে বই। সারি সারি। কতদিনের বই? কতকাল আগের বই? সংগ্রহ করেছিল কে? কতকাল স্পর্শ করেনি কি কেউ?
ধূলায় ধূলায় ধূসর।
ধূসরতা ঝেড়ে কে পড়বে গল্প উপন্যাস কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি বই?
ঘরের এক কোণে আলমারি। আলমারিতে মুখ বন্ধ বই। মুখ খুলবে না? গল্প উপন্যাসে কত চরিত্র, নায়ক নায়িকা, পরিবেশ, নাটকীয়তা, কত আনন্দ বেদনা উন্মোচন করবে না?
উন্মোচন করবে তো পাঠক। আলমারির কাছে এগিয়ে আসবে কবে কোন্ পাঠক?
আলমারি দাঁড়িয়ে আছে। রোদ জল আলো অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝড় এলেও ধাক্কা দিতে পারে না গল্প উপন্যাসের চরিত্রকে। তারা যেন হাজার হাজার বছর ধরে মূক। তাদের মুখে কথা ফোটাতে কোনো পাঠক নেই।
পাঠক কোথায় থাকে?
বইয়ের আলমারি তো ঘরেই আছে। ঘরের লোক খেয়াল করে কি?
আলমারির দিকে এগিয়ে যায় ইঁদুর আরশোলা। তাদের পক্ষে সম্ভব নয় চরিত্রদের কাছে টানতে। তাদের মনেও হয়, চরিত্ররা যদি পোকা হয়ে থাকে, কী আর হবে দাঁত ফুটিয়ে!
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ঘরের বাইরে থেকে জানলায় উঁকি দেয়, যদি দেখতে পাওয়া যায় বইয়ের মলাট।
না। কেউ আসে না। চরিত্ররা বইয়ের ভিতরেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন কাটায়। বইয়ের মলাটে চরিত্রদের ঘাম ও হাসি কান্না ফুটে ওঠে না।
এক ছ বছরের শিশু খুলে ফেলেছিল আলমারির দরজা। ঝুর ঝুর করে পড়েছিল বইয়ের পাতা।
ঝুরঝুর করে পড়েছিল কান্না।
বইয়ের ভেতরে যে শিশুরাও আছে। শিশুদের খেলাও আছে।
আমার খেলা কার সঙ্গে?
বই তো আমার দিকেও তাকিয়ে থাকে। পুরনো বই পুরনো বন্ধুত্ব আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কি বইয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে ভালোবাসা খুঁজবো না আর? নাকি বই থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। দূরে থাকাই ভালো?
জীবনকেও যে পড়তে হয়। পড়তে পড়তে শাক বেচুনি মাসির সঙ্গে যে দেখা হয় আমার।
তার শিরা ওঠা মুখের ম্লান আলোতে আমি যে পেয়ে থাকি ঠাঁই।
-----২৬ চৈত্র ১৪২৯
-----১০---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ৯
কবিতার কোনো কোনো পংক্তি একা হয়ে থাকে। তার জীবন ধরে তার সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারে না আরো একটি পংক্তি। তাকে ভালবাসতে অক্ষর বা শব্দে সাজানো আরো একটি পংক্তি এগিয়ে এসে ছড়ায় না তার সৌরভ।
সেই একাকী পংক্তি জলে হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায় বিষণ্ণতার সঙ্গে। কখনো কখনো একটি সম্পূর্ণ কবিতা থেকে কোনো পংক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে একা হয়ে পড়ে। সে তো তার দোষ নয়, পাঠক তাকে একা করে নিজের কাছে যত্ন করে।
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই পঙক্তিটি একা একা থাকে। সুখে থাকে কি? অথবা, মেলাবেন তিনি মেলাবেন পোড়ো বাড়ি ভাঙা দরজাটা তারপর? তারপর কি? অমিয় চক্রবর্তী আড়াল থেকে হেসে উঠবেন।
গীতবিতানের কবিতা থেকেও ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক পঙক্তি। কোনো কবিতার শেষ পংক্তি আছে। অথবা প্রথম ও শেষ নেই মধ্যিখানের পংক্তি আছে।
বেদনার ভার নিয়ে এভাবেই চলছে অনেকে। ভার নামানো যায় না। ভার ভারাক্রান্ত হয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে কোথাও কোথাও।
প্রায় ছোটবেলায় আমি একটি পংক্তি পেয়েছিলাম তা হলো-------মুরগির ডালা খুলে লাফিয়ে উঠলো ভোর---
এই পংক্তি টি আমার সঙ্গেই আছে। আজও। সে যে কোনো সেতু দিয়ে আসবে আরো একজনের কাছে তার ব্যবস্থা আমি করতে পারিনি। নিজেকে অসহায় লাগে।
একা লাগে।
ওই পংক্তিটির ভরণ পোষণের দায়িত্ব আমাকে বহন করতে হয়। কেন না, তাকে যোগ্য করে তোলার জন্য আমি কাউকে আর খুঁজে পাইনি।
অনেক অনেক বছর ধরে একা হয়ে আছে----
মুরগির ডালা খুলে লাফিয়ে উঠলো ভোর----
---- ২৭ চৈত্র ১৪২৯
----১১---৪---২০২৩
----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ১০
যেকোনো প্রদীপ মায়ের মত একা। সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ জ্বলে উঠলেও প্রদীপ একা।
প্রদীপের সঙ্গে সলতে কতটুকু থাকে? সন্ধ্যে কতটুকু থাকে? আলো নিভে গেলে প্রদীপের একাকীত্ব মায়ের একাকিত্বের মতো। সংসারে সব থেকেও সবার সঙ্গে থেকেও মা একা।
প্রদীপ যতই পেতলের হোক যতই ঝকঝকে হোক, সারাদিন চুপচাপ। মায়ের বয়স তো বাড়ে। প্রদীপের বয়স তো বাড়ে না। তারপরেও প্রদীপ একা। তার এই একলা থাকা, ব্যাথার আলো, কে দেখে?
তুলসি থান দেখে? দেব দেবীরা দেখে?
দূর থেকে হাওয়া দেখে।
মাটির প্রদীপও রূপে গুণে লক্ষ্মী।
চেয়ে থাকে। সকলের দিকে চেয়ে চেয়ে আলো জ্বালায়। সেই আলো যেন করুণ অঞ্জলি।
চরাচরের কাছে অঞ্জলি।
অথচ প্রদীপ থাকে একা একা। নিঃশব্দ। প্রায় আড়ালে। অন্ধকারে। তার ভূমিকা তো সন্ধ্যেবেলা। দিনেও প্রদীপ জ্বলে কোথাও কোথাও। তার ভূমিকা তো যৌথতার।
তুমি যদি বলো, সারারাত জ্বলে চাঁদের আলো। অজস্র তারার রূপেও প্রকৃতি আলোকিত। সেখানে প্রদীপ তো একটি কণাও নয়। আমি বলবো, কণা শুধু নয় প্রদীপ তো কথাও। মাটি থেকে আকাশে ঊর্ধ্বমুখী কথা।
তুমি কান পেতে শোনো।
----২৮ চৈত্র ১৪২৯
-----১২--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন