মাটিতে রামধনু ওঠে - ১১
মাঠটা পড়ে আছে।
পাখি এসে ফেলে যায়না বীজ। প্রজাপতি ফেলে যায়না ফুলের রেণু। মেঘ এসে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলেও যায়। রেখে যায় না মন।
খাঁ খাঁ করছে মাঠ।
এই একলা মাঠের সঙ্গী নেই।
মাঠের পাশ দিয়ে চলে যায় গ্রামের মানুষ। মাঠের উপর দিয়ে চলে যায় বাতাস। কেউ একটিও কথা বলে না।
একবার এক বুড়ো গানওয়ালা মাঠের কাছে এসে বলেছিল : আমি এখানেই গান বাঁধবো। একটা রাত কাটানোর পর সে বললো : এখানে কথা ও সুর হারিয়ে যাচ্ছে আমার----এ যেন আমার নির্বাসন।
মাঠ পড়ে থাকে একা।
এই মাঠে মেলাও বসে না। ছোট বড় পাথরে পাথরে ভরা এই মাঠকে একটি গাছও ভালোবাসে না। এই মাঠে গুনগুন করে না মৌমাছি। মাঠ কথা বলতে চাইলেও আকাশ গম্ভীর হয়ে থাকে।
সন্ধ্যাতারা এসে দাঁড়ালেও নীরব থাকে। শুকতারা চেয়ে থাকলেও কথা বলে না একটিও।
কে জানে কোত্থেকে একটা কুকুর এসে পড়েছিল মাঠে। শুঁকতে শুঁকতে চলেও গেছে। শুকনো পাতারা ওড়ে। স্পর্শ রাখে না মাঠের গায়ে।
মাঠটা পড়ে আছে।
অন্ধকারে নিঃশব্দ। আলোতেও নিশ্চুপ। আমি যদি ভালবাসি, আমাকে ভালবাসবে তো একলা মাঠ?
একাকী মাঠ?
মাঠ তো এদেশেরই মাঠ। আমাদের স্বজন। খুঁজে পেতেও পারি, এই মাঠের অনেক অনেক নিচে পোঁতা আছে সমস্ত মানুষের নাড়ি।
----২৯ চৈত্র ১৪২৯
----১৩--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ১২
সমস্ত মানুষই একা। এই পৃথিবীতে। এ কথাই শোনা যায়। কেমন একা? সংসার জীবন সমাজ জীবনে থেকেও একা?
"একা"-ও তো নানারকম।
কতরকম?
সেই ব্যাখ্যার দিকে না গিয়ে বলতে পারি, বস্তু সামগ্রীও একা। যেমন, কাঁসার একটি থালা। ব্যবহৃত না হয়ে বাক্সবন্দী। বাতিলও বলা যায়।পেতলের কলসির ক্ষেত্রেও একই কথা।
পুরনো দিনের কাঁসা-পিতল আজকের দিনে ব্রাত্য হয়ে একা। কাঁসা-পিতলের দাম যতই বাড়ুক, আজকের আধুনিক জীবনে প্রাত্যহিক জীবনে কোনো মূল্য নেই।
পিসি-মাসিদের দিনও চলে যাচ্ছে।
সম্পর্ক তো প্রশস্ত হয়ে থাকে কিন্তু আজ ছোট সংসার। সুখী গৃহকোণ। দাদু ঠাকুমা থেকেও নেই। পুরনো বাসনপত্রের মতোই তারাও একা হয়ে পড়ছে।
জেঠিমা কাকে বলে? জেঠু কাকে বলে? কাকু কাকিমা কাদের বলে? এই প্রশ্ন এসে গেছে। সবাই আছে শুধু সম্পর্ক গুলো নেই।
"সম্পর্ক" আজ একা।
যখনই আমি নতুন করে চিনিয়ে দিচ্ছি, এইটে জবা গাছ। তখন বুঝতে হবে, জবা গাছটি একা একা বড় হয়েছে। এবং থেকেও গেছে একা।
"গাড়ু" চলে গেছে। এখন হাতে মগ। খাবার জলের জন্য জাগ। তাহলে একা হলো কে?
অনেকে থেকেও নেই। এই আধুনিক জীবনে একাকীত্ব সম্পর্ক থেকে বস্তু সামগ্রীর কাছেও।
যে গাছ লতাগুল্ম, যে পাখি পোকামাকড়, আমাদের অলক্ষে বেড়ে বেড়ে উঠছে, তাদেরও নিঃসঙ্গতা আছে। আমরা খেয়াল করি না ।
আমার পুরনো বন্ধুকে আমি যদি চিনতে না পারি, বন্ধুও যে একা হয়ে যায়। কোনোদিন চিন্তা করেছি?
ঘরে থাকা অনেক জিনিসপত্রকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফেলে দি। যাদের ব্যবহার ছিল একদিন, আজ নেই তাই ফেলে দাও। এ কেমন বিচার?
যে ছিল একদিন আদরের সে হয়ে গেল জঞ্জাল। আমাদের গড়ে ওঠা আমাদের স্বভাব আমাদের আচরণ আমাদের যে কি দিয়েছে আর কি দেয়নি, হিসাব করিনি কখনো। সমাজবিদদের ব্যাখ্যা সব সময় মেনে নিতে পারি না। আরেকটা কথাও সঠিক, একাকীত্ব বোধের কাছে সমাজবিদরা কি যেতে পারেন? যে বোধ থেকে আকাশের জন্ম হয় মৃত্যু হয়। পাহাড় নদী জঙ্গল কাছে এসে চলে যায়। মানুষের সমগ্রতা যে বোধের কাছে----ফুঁ।
আমি মনে করি, একাকীত্ব বিষয়ে আলোচনা করাও এক রকমের বোকামি।
একাকীত্ব যে ভয়ংকর ভয়ের এক জায়গা, নিজে না দাঁড়ালে টের পাবে না কখনো। ওই যে একটা ছাতা, বৃদ্ধ বাবার মত পুরনো। ঘরের এক কোণে।
একাকীত্ব বলবে না?
------চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২৯
------১৪---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ১৩
একটা পুকুরের পাশে আরেকটা পুকুর। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না। একটা পুকুরের পাশে আরেকটা পুকুর। দুজনেই দুজনের দুঃখ-বেদনায় চুপচাপ থাকে।
একটা পুকুরে শালুক -পদ্ম ফোটে। আর একটা পুকুরে পানা ফুলও নেই। একটা পুকুরে মৌমাছির গুনগুন। আরেকটা পুকুরে কখনো কোনোদিন একটা বক এসে বসে থাকে।
দুজনের সঙ্গে দুজনের অনেক অমিল। পাশাপাশি থাকলেও একজনের জল শুকিয়ে গেলে, আরেকজন এগিয়ে দেয় না জল।
একজনের জলে গরু -কাড়া ধোওয়াধুয়ি হয়ে থাকে। আরেকজনের জলে স্নান করতে নামে মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো। বালক বালিকারাও।
দুটি পুকুরের মাঝখানে একটা রাস্তা চলে গেছে শিয়াল ডাঙ্গার দিকে। এই রাস্তাতে আমিও। কখনো কখনো জলের কম বেশি দেখতে দেখতে হেঁটে যাই।
পুকুরের দুঃখ পুকুরের খুশি আমাকে পীড়িত না করলেও আমি দুটি পুকুর দেখি। পাড়ে দাঁড়িয়ে।
১০০ বছর আগের যেন বা দুই বোন। দুজন দুজনকে চিনতে পারে না আর। যেন বা দুজনের জীবনে কোনো ভালোবাসা নেই। কেবল মানুষের সেবা করে যাও। আর লালন করো পোকামাকড়। মাছ। লতাগুল্ম।
দুটি পুকুরের মাঝখানের রাস্তাতে একটি ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। অনেকেই স্নান করে তেঁতুল তলাতে খানিক জিরিয়ে নেয়। কিংবা অপেক্ষা করে আরেকজনের জন্য।
দুটি পুকুরেই আমি কখনো হাতমুখ ধুতে নামিনি। দুটি পুকুরই আমাকে চেনে।
দুটি পুকুরে ডুব দিয়ে আমি একদিন নিয়ে এসেছি দুই বোনের কান্না।
----১ লা বৈশাখ ১৪৩০
----১৫--৪--২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ১৪
কোনো অপেক্ষা নেই।
গতকাল একটা অপেক্ষা ছিল। আজ নেই। আজ রোদের তীব্রতা। ভয়। এক কবি বলেছিলেন, বাঘের মতো রোদ। হাঁ করলেই গিলে ফেলবে।
ভালোবাসাও গিলে ফেলে।
ভালোবাসাকে ভয় করি?
ভয় তো করি। সব সময় ভয় করি, আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বাঁচবো তো!
ভালোবাসা কি বাঁচিয়ে রাখে?
বাঁচিয়ে রাখে। মেরেও ফেলে।
বাঁচিয়ে রেখে মেরে ফেলা ভয়ঙ্কর। তিল তিল করে দগ্ধ হতে হতে অবসাদে চলে যাওয়া।
অবসাদ এলে তাল খেজুরের রসও নিম নিম। আখের ক্ষেত হয়ে ওঠে বাঁশবন। শেয়ালের সঙ্গে দেখা হবে। তখন অবসাদগ্রস্তের কাছে সে রাজা। হামলে উঠে দাঁত দেখাতে পারে।
ভয়।
নদী বা পুকুরে ঝাঁপ দিতে গেলেও দেখা যায় সবই মরীচিকা।
কাঁপতে কাঁপতে অথবা জড়োসড়ো হয়ে নতুন করে ভালবাসার জন্য অপেক্ষা।
আজ কোনো অপেক্ষা নেই আমার। সত্যি কি নেই? একটা অপেক্ষার পরেই তো আরেক অপেক্ষার শুরু।
অপেক্ষাও একটি রোগ।
আমি জানি রঞ্জন আসবে না। আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে তিলাবনি পাহাড়ের নিচে। সেও আসবেনা।
আমার চেয়ে অনেক অনেক আকর্ষণীয় একটা পাহাড়। তার অনেক খাঁজ। মসৃণতাও আছে। গাছও আছে আঁকড়ে ধরার মত।
আমাকে আঁকড়ে ধরলে এক বিন্দু ছায়া পড়বে না গায়ে। কেন আসবে আমার কাছে। আমার অপেক্ষা চেয়েও দেখবে না কোনো হাওয়া।
বাতাসে উষ্ণতা বাড়ছে। লু বইবে। আঁচল উড়িয়ে আসবে না দুলিয়া। ওই তো অবিন আর অঙ্গনা। সারা পৃথিবীর সমস্ত ছাদে পায়চারি করতে করতে গল্প করছে।
আমার গল্প কার সঙ্গে?
আমার বিছানায় আরেকটা বালিশ বাড়তি থাকলেও তার সঙ্গে আমার কথা নেই।
কার সঙ্গেই বা কথা থাকে আমার? নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও হাঁপিয়ে উঠছি।
এক গ্লাস জল দেবে?
চেয়ে খাওয়ার অভ্যেসটা আমার আজও গেল না। মা বলতো দিদিরা বলতো, হাত জোড়া---তুই নিজে নিয়ে খেয়ে নে----।
আমি জল গড়িয়ে খেলে জলের স্বাদ পাই না। ভাত বেড়ে খেলেও তৃপ্তি নেই।
কীসে তৃপ্তি পাই অপেক্ষা করে?
কার জন্য অপেক্ষা কে আসবে?
আসবে আসবে। রোদে ঝাঁজ থাকলেও কচি পাতার নুপুর বাজতে বাজতে আসবে। নুপুর পরা পা দেখতে না পেলেও নুপুরের ধ্বনি আমাকে শোনাবে, বর্ষার গান।
হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, আমার হাতে পড়বেই, দু চার ফোঁটা বৃষ্টি।
-----২ বোশেখ ১৪৩০
-----১৬--৪--২০২৩
-----নির্মল হালদার
মাটিতে রামধনু ওঠে - ১৫
কার জন্য বাঁচি?
উত্তর তো হবে এই, প্রথমে নিজের জন্য বাঁচি তারপর অন্যের জন্য। সেই অন্যেরা কে? উত্তর হবে এই, গাছপালা কীটপতঙ্গ নদী পাহাড় আকাশ এবং মানুষের জন্যও বাঁচি।
এই বাঁচা যদি নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে? সকলের সঙ্গে বাঁচতে বাঁচতেও যদি একা হয়ে যাই?
উত্তর হবে এই, তবুতো বাঁচা। বেঁচে থাকাই যে আনন্দের। এই আনন্দ আমার সঙ্গী। আমার নির্ভরতাও।
অনেকে বলে, নির্ভরতা ভালো নয়। দুর্বল করে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমরা তো আকাশ ও মাটির উপরে নির্ভর করি। রোদ বৃষ্টির প্রতিও নির্ভর করি। সেই নির্ভরতা কি দুর্বল করে?
আমার চারপাশে কেউ নেই। কিন্তু মনে মনে সবাই আছে। এও তো নির্ভরতা। তাই নিঃসঙ্গতা আসুক। আমি ভয় পাইনে। যখনই খুব একা লাগে, তখনই ছোটবেলার কুল গাছটাকে ডাকি। দুজন মিলে অনেক কথা।
কুল গাছের ছোট ছোট পাতায় কতবার যে ধুলোর ভাত বেড়েছি, এ কথা মনে হতেই, দুজনের কি উল্লাস।
এও তো আমার বাঁচা।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাও সঙ্গী হয়ে ওঠে আমার কাছে। আমি প্রতিমুহূর্তে আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিনিময় করি আমার ভালোবাসা।
আমি গন্ধ চুরি করি তোর শরীরের। তোর মনের সুবাস আমি সঞ্চয় করছি নিজের জন্য।
আমি কি আর একলা হতে পারি?
একলা হয়ে যাওয়া এতই সহজ?
আমি হতে চাইলেও আমাকে হতে দেবে না আমার দিন রাত্রি। আমার সূর্য তারা।
আমার তো খুব ছোটখাটো চেহারা তার জন্য যারা খুব লম্বা, দীর্ঘদেহী তাদের খুব ভালোবাসি। যেমন, তালগাছ আমার খুব প্রিয়। শাল--সেগুন আমার পছন্দের খুব।
ভালোবাসাও এক রকমের নির্ভরতা। যেকোনো কিছুকে ভালবাসলে সঙ্গ পাই। যদিও জানি, ভালো বাসতে বাসতেও একা হয়ে যাই।
একাকীত্ব মধুর। কেননা, একাকীত্ব থেকে দেখতে পেয়েছি, আমার পায়ের কাছে একটি পিঁপড়ে উঠছে। মনেও হয়েছে, এ আমাকে কামড়াবে না। আমার শুকনো নজরকে ভিজিয়ে ফেলবে ভালোবাসায়।
আমার সারাদিনের নিঃশব্দ চিৎকার : এসো এসো এসো। আমার কাছে এসে দাঁড়ায় সারি সারি রঙ।
আমি হাত ডোবাই। রঙ দিই, আমার দূরের বন্ধুদের। আমার কাছের বন্ধুদের।
আমার না-বন্ধুও অনেক। হ্যাঁ -বন্ধুও অনেক। সবার সঙ্গে থাকতে থাকতে গাছের পাতা সবুজ, দেখতে পাই। আম মুকুল থেকে সজনে ফুল দেখতে পাই।
তোর পায়ের পাতার ঘাম তুই দেখাতে না চাইলেও আমার খুব চেনা। ওই ঘামের ফুটে ওঠার সঙ্গে আমিও ফুটে উঠি।
গোপনে একা।
-----৩ বোশেখ ১৪৩০
----১৭--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন