৪৬:
মাটিতে রামধনু ওঠে
কুয়োতলার চাতালে মধ্য বয়স্ক কয়েকজন তাস খেলছে। বিকেল বেলা। এখানেই একটা অশ্বত্থ গাছ। পাখিরা আসা-যাওয়া করে। বাসা বাঁধে। অশ্বত্থ ফল মাটিতে পড়ে টুপটাপ। গরু এসে খায়।
কুয়োতলার সামনে হনুমান মন্দির। সময় অসময় নেই ঘন্টা বাজে। মন্দিরের ভেতর থেকে ফুল বেল পাতার গন্ধ আসে। ধূপের গন্ধ আসে।
এ সমস্তর মাঝেও একটি কুয়ো। অল্প জল আছে। ব্যবহারযোগ্য নয়। আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়ে উঠছে।
সচেতন কিংবা অচেতন হয়ে তাসুড়েরা খালি সিগারেটের প্যাকেট খালি দেশলাই বাক্স কুয়োতে ফেলে দেয়। সেই সঙ্গে সারাদিন গাছের পাতা পড়ছে তো পড়ছেই।
কুয়োতে উঁকি দিলেও দেখা যাবে না মুখ। কুয়ো নিজেও কষ্ট পায়। মনে হয়, তার দুঃখ থেকেই আজও একটু-আধটু জল জমে।
প্রতিদিন বিকেলে তাস খেলা জমে। কুয়োটি একা থাকে। অন্তরে। বাহিরে। সারাদিন।
আজও কোনো কোনো গ্রামের মুখে পুরনো দিনের ইঁদারা কুয়ো। বারো মাস জল থাকে। গ্রামের দু' একজন ইঁদারার জল ব্যবহার করলেও অধিকাংশই করে না। তারা বলে, কে কষ্ট করে দড়ি টানাটানি করবে! আমাদের টিউকলেই ভালো ।
কুয়োতলার সার্বজনীনতায় ঝুলকালি পড়তে পড়তে অন্ধকার হয়ে গেল। কুয়োতলা একা এবং একা।
কুয়োতলায় মহিলা মহল চলে না আর। হাসি দুঃখ কান্নার বাতাস চলাচল করে না।
কুয়ো অন্ধকার।
কুয়োর প্রতি উপেক্ষা ও উদাসীনতা কুয়োকে আজ করেছে একা।
কুয়োতলাও সমাজ জীবনের এক জ্যান্ত ছবি ছিল একসময়। যেখানে বালতি ওঠানামার মত আনন্দ বেদনা ওঠানামা করতো।
আজ দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায় সকালে সন্ধ্যায়।
-----১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৩১---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার
৪৭:
মাটিতে রামধনু ওঠে
দৃশ্য কল্প--১
নিম দাঁতন শাল দাঁতনের খোঁজ আমাকে দেবে? নিম গাছের তলায় দাঁড়ালে দাঁতন পাবো? শাল গাছের তলায় দাঁড়ালে দাঁতন পাবো?
ঘরে বাইরে কত রকম পেস্ট। কত কত কোম্পানি আমার দাঁতের কাছে আমাকে ইশারা করে। সেই ইশারাতে মজে গিয়ে অনেককাল কেটে গেল। এবার নিম ও শাল দাঁতনে মন দিতে চাই।
অরণ্য প্রকৃতি আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমি ছুটতে ছুটতে ঘরে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলি।
দৃশ্য কল্প--২
আমার ঘুমের কাছে এসে দাঁড়ায় একটি জাম গাছ। আমি হাত পাতি। টুপটুপ করে পড়বে চোখের মনির মত কালো কালো জাম।
আমি দাঁড়িয়ে। স্থির।
হঠাৎ শুকনো পাতা ঝরে। এবং তার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। দেখি, আমি ঢাকা পড়েছি শুকনো পাতায়। আমি উঠে দাঁড়াতে পারিনা। ছটফট করি।
দৃশ্য কল্প--৩
আমি ঝাঁপ দিয়ে তোলপাড় করছি জল। আমি সাঁতার কাটছি। বন্ধুদের সঙ্গে জলকেলি করতে করতে এপার ওপার।
গ্রীষ্ম দিনের রোদে তেতে উঠেছে জল। কুছ পরোয়া নেহি----জল ছুঁড়তে ছুঁড়তে দেখতে পেলাম একটা ডাক----উঠে আয় উঠে আয়।
কোথায় আর উঠবো? আমি তো এক ধুলো উড়ানি মাঠে সাঁতার কাটছি। আমার সারা গায়ে ধুলো। আমার মাথায় ধুলো।
দৃশ্য কল্প--৪
কোথায় যে মাঠ কোথায় যে ধুলো! চারদিকে বহুতল বাড়ির ছায়া আমাকে গিলে ফেলছে। আমি কাতরাতে কাতরাতে মা মা করছি। বহুতলের দরজা জানলা হাততালি দেবার মত শব্দ করছে।
আমি বলার চেষ্টা করছি পারছি না, এ যে আমাদের খেলার মাঠ ছিল। এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতেও দেখতে পেয়েছিলাম, একটি মেয়ের কাজল কালো দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টির ভেতরে প্রবেশ করতে কখনো পারিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্ষয়ে গেল অনেক অনেক দেয়ালের ইঁট। আমার পা ঝিমঝিম করছে।
দৃশ্য কল্প---৫
দর্জি দোকানের ছিট কাপড় কুড়িয়ে কুড়িয়ে আমার পুতুল। সেই পুতুলের সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল। সে আমার কাছে জানতে চাইছিল----আজকে আমার খেলার সঙ্গী কারা? আমি থতমত খেয়ে পালিয়ে গেলাম।
সেই পুতুল পিছন থেকে চিৎকার ক'রে আমার দিকে প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে দিলো-----তোমার সঙ্গে মানুষ আছে তো ? মানুষ?
তীরে বেঁধা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়।
দৃশ্য কল্প---৬
একটা কাঁচের মার্বেল গড়াতে গড়াতে আমার পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার মুখোমুখি। আমি জানতে চাইলাম--আমার কাছে কী চাইছো? সে বললো----কি আর চাইবো, চাইছি তোমার খেলার জমিয়ে রাখা মার্বেলগুলি। ছোটদের দেবো। তারা যদি খেলতে পারে।
আমি হেসে উঠলাম।
আমার হাসি শুনে শিশুরা আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার কাছে জানতে চায়---মার্বেল কেমন ছিল বলতে পারবে? মার্বেলের রঙ কত রকমের ছিল বলতে পারবে?
আমি আবার পালাতে থাকি। পালাতে পালাতে ধাক্কা খাই রাস্তার মাইল পোস্টে। কিন্তু লেখা নেই আমার বাড়ি কত কিলোমিটার।
দৃশ্য কল্প---৭
হাঁসুয়ার সঙ্গে রচনা করতে চাই একটি ধান জমি। হাঁসুয়া জানতে চাইলো---খাতা আছে? ডাইরি? আমি বললাম----আমার হাতের তেলোতেই আমি লিখব আমার রচনা। তুমি বুকে তুলে নিও। দেখবে, সারি সারি ধান গাছ মাথা দোলাচ্ছে শরতের হাওয়ায়।
------১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার
৪৮:
মাটিতে রামধনু ওঠে
উৎসর্গ : প্রতাপ দত্ত
চিরুডি একটি গ্রাম।
চিরুডি হয়েই যেতে হবে ঝিলিমিলি। ঝাড়গ্রাম। বান্দোয়ান ছাড়িয়ে চিরুডির দিকে যাওয়া।
কোনো পাহাড় থেকে নামতে হয় না চিরুডিতে। চিরুডি একটি গ্রাম। বাসে যাওয়া যায়। যেকোনো বাহনে যাওয়া যায়। এবং যেতে হবেই। চিরুডিতেই আছে ফুল ফলের মত আত্মীয়তা।
কত যে ফুল ফল। আত্মীয়তার সাত রঙ। আমি ছুঁতে পারি না। আমার ক্ষমতাও নেই। যেমন করে ছুঁতে পারলাম না বিল্টুকে। অথবা, সে আমাকে নতুন সেতু গড়ার অধিকার দিলোনা।
দোষ কারো নয় গো মা-----।
সম্পর্ক স্থাপনে কেউ আগ্রহী না হলে, সেতু রচনা করেও যাতায়াত করা যাবে না।
চিরুডি যেতে হলে কোনো সেতু নেই। একটাই রাস্তা। সহজ সরল। মসৃণ। কোনো নদীও নেই। লাফ দিয়ে যেতে হবে না। অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় আছে, আত্মীয়-স্বজনের মতই। দেখতে দেখতে, হঠাৎ করে দাঁড়িয়েও হাত বাড়িয়ে কাছে চলে যাওয়া যায়।
চিরুডিতে কার কাছে যাবো?
প্রতাপ নেই। চিরুডি নিজেই একা হয়ে গেছে। তার একাকীত্ব দীর্ঘ করতে আমি কি আর যাবো?
অনেক গ্রাম একা থাকে। যেমন রামানুজ ছাড়া তাদের গ্রাম খুব একা। ভীষণ একা। অবনী নেই লাল্টু নেই তুলিল একা হয়ে গেছে।
গ্রামের হৃদপিণ্ড প্রেম ও ভালবাসা। তা যদি দূরে চলে যায় কিংবা দূরত্ব রচনা করে গ্রাম একা হয়ে যাবেই।
যুবক ও যুবতীদের তারুণ্য গ্রামের শোভা। চেয়ে থাকে চন্দ্র সূর্য।
অনেক সময় ঘরও একা হয়ে পড়ে। পালক ছাড়া আমার ঘর নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে।
বাপি ছাড়া বাথান বেমানান।
অবিনকে না পেলে কাঁসাই তো গোপনে গোপনে অশ্রু ঝরায়।
এ সমস্ত এই এক জীবনের সঞ্চয়
দিন রাত্রির আলো বাতাস জানে। পেঁচাও জানে। চেয়ে থাকে।
আমিও চেয়ে থাকি চিরুডির দিকে।
আমি কি যাব না তার কাছে?
-----১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২--৬--২০২৩
----নির্মল হালদার
৪৯:
মাটিতে রামধনু ওঠে
ভাল্ লাগছে না --- ধুর্ ভাল্ লাগছে না ---এই ছিল আমার ছোটবেলার রোগ। কারণে অকারণে সব সময় বলে উঠতাম। আমার বন্ধু ছোটন রেগে উঠতো। সেই ছোটনের একথা মনে পড়বে কি? আমাকে ছাড়াই ছোটন তো দিব্যি আছে। আমার থেকে অনেক অনেক দূরে। সে ছুঁতেই পারবে না আমার বিষণ্ণতা।
সে কি জানে একাকীত্ব কাকে বলে?
তুলিনকে মনে আছে তার? মনে পড়ে সুবর্ণরেখা? ওর গল্পের খাতা আমার কাছে দীর্ঘদিন ছিল। ওর একটা উপন্যাস আমার কাছে ছিল।
ওর কাছে কি আছে স্বপন কুমারের ডিটেকটিভ বইগুলো, যা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম? বইয়ের দাম ছিল আট আনা।
ছোটনের মনে আছে?
মনে পড়বে কি, আমার ভাইজি বুলিকে সে পড়াতো? শেখরকে মনে আছে? লাল্টু অবনীকে মনে আছে?
আমলাপাড়া স্কুলেই তো আমাদের প্রথম পাঠ। ছোটনরে, তোর মনে পড়ে? নাকি মনে পড়লে পিছিয়ে যেতে হয়? আর পিছিয়ে পড়লে খালডোব। অন্ধকার।
কে আর চায় হোঁচট খেতে!
ছোটন বরাবর তুখোড় ছাত্র। সে যখন আই আই টিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, পড়াশোনা করছে খুব, তখন তাকে ডাকতে গেলে রেগে যেতো। আমি মুখ চুন করে ফিরে এসেছি।
ছোটবেলা থেকেই আমার দোষ আমি কারোর প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে গেলে, তাকে এক দন্ড ছেড়ে থাকতে পারিনা। এখনো এই শেষ বয়সেও আমি যদি একটি গাছের প্রতি আচ্ছন্ন হই, একদম ছেড়ে থাকতে পারবো না।
আচ্ছন্নতা আমাকে জিইয়ে রাখে। আমাকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়।
সেই ছোটবেলায় ছোটনও ছিল আমার আচ্ছন্ন এক বিষয়। তার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল। অনেক বিষয়ে অমিল। তারপরও বন্ধুত্ব ছিল অটুট।
আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও দু'চারটে চিঠি লিখেছে আমাকে। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আমি বিচ্ছিন্ন হইনি। এখনো ছোটন। ছোটবেলার অমলিন সম্পর্ককে জিইয়ে রাখতে চাই। আজও।
একবার কি দেখা হবে না? অন্তত একবার? ছোটনকে জড়িয়ে একবার যদি কেঁদে উঠতে পারি? একবার অন্তত?
কী চমৎকার চিঠি লিখতো আমাকে। নিয়মিত। আর ছোটনের চিঠি মানেই, দিদিকে পড়ে শোনাতে হবে। কখনো দিদি নিজেই পড়তো।
আমার তুলিনের দিদি সেজদি ছোটনকে খুবই ভালোবাসতো। ছোটনও সুযোগ পেলেই পুরুলিয়া থেকে তুলিন। আমার কাছে। সেজদির বাড়ি।
তখন দিদি বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না। হ্যারিকেনের আলো। সারা বছর। গরমের দিনে তালপাতার পাখা। ছোটনের কোনো অসুবিধে হয়নি।
ছোটনদের পারিবারিক মান ছিল উঁচুতে। আমাদের ছিল না। কিন্তু আমাদের মেলামেশায়, সম্পর্কে সহজ বাতাসের আসা যাওয়া ছিল।
সেই সহজ বাতাস কি আমার কাছে আরেকবার আসবে? আমি জানি আমার চেয়ে অনেক লম্বা ছোটন। আমি তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা না করে, দেখতে তো পারি। যেমন মাটিতে দাঁড়িয়ে মাটির আরেক সন্তান তাল গাছের দিকে চেয়ে থাকতে পারে।
ছোটন রে, আমার ক্ষমতা নেই তোর কাছে ছুটে যাওয়ার। তুই তো আসতে পারিস। আমরা দুজন আমলা পাড়া প্রাইমারিতে আরেকবার ভর্তি হয়ে ছুটোছুটি করবো। করবো না? শুধু আমরা না, বাকি বন্ধুদেরও ভর্তি করে হৈ হৈ করতে পারি।
তুই তো আমাকে দিবি তোর গল্পের খাতাটা। আজকের খাতাটা। যেখানে সমুদ্র আছে। আমি শুধু নেই।
------১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৩---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার
৫০.
মাটিতে রামধনু ওঠে
( উৎসর্গ: রামানুজ মুখোপাধ্যায় )
বাক্সটা খুলতেই একটা ব্লাউজ। গরম কাপড়ের ব্লাউজ। হ্যাঁ, আমি রেখেছিলাম। মনে পড়ছে। মনে পড়ছে না শুধু, মা কি একদিনের জন্যেও ব্লাউজটা পরেছিল?
আমি কোনোদিনই মাকে ব্লাউজ পরতে দেখিনি। সারা বছর একই পোশাক। একটি নরুণ পাড় শাড়ি। পায়ে কোনোদিন জুতো ছিল না।
চৌকাঠের বাইরে পৃথিবীকে চেনেনি। নাকি চিনতে চায়নি? কেবল সংসারের সুখ-দুঃখে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে মুড়ি ভেজেছে। উনুনে চড়িয়েছে হাঁড়ি।
সবার মুখে অন্ন জোগাতে হবে।
তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়ে মেয়েদের বলতে হবে : শাঁখটা বাজা রে। বাজা।
ব্লাউজটা ছাড়াও আরো কত স্মৃতি পেয়ে গেলাম। ধনরত্ন পেয়ে গেলাম। এবং সমস্ত স্মৃতি একদম একা। নির্জন নিঃসঙ্গ।
নির্জনতা বলতে যদি ধূ ধূ প্রান্তরকে দেখানো হয় শুধু, তাহলে ভুল হবে। আমার কাছে নির্জনতা একটি গাছের ডালে একটি কাক। আমার কাছে নির্জনতা একটি মাঠে একটি শুকনো পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে।
ন্যাপথলিনের গন্ধেও নির্জনতা থাকে। একাকীত্ব থাকে। এই একাকীত্ব থেকেই আমি পেয়েছি মন খারাপের গন্ধ।
ন্যাপথলিনের গন্ধ।
আমি মায়ের গা থেকে রান্নাঘরের গন্ধ পেয়েছি। বিশেষ করে হলুদের গন্ধ। এবং এই গন্ধটা আজও আমার কাছে ঘুরে বেড়ায়। আজ অবশ্য গন্ধটার মধ্যে চোখের জলের গন্ধ পাই।
আমি ছাড়া আর তো কেউ পাবে না। আমার দাদা দিদিরা কেউ নেই আজ আর।
গন্ধটা পাঠাতে চাইলেও পাঠানো যাবে না কারো কাছেই। গন্ধটা শুধু আমাকেই আক্রমণ করে।
আমি মায়ের শেষ বয়সের সন্তান।
আমার মাকে দেখে বন্ধুরা বলতো, আমার ঠাকুমা। তখন তাদের বলতে পারিনি, মা কখনো কোনোদিন বৃদ্ধ হয় না।
-----২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৫---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার
৫১.
মাটিতে রামধনু ওঠে
বগলাকে কেউ চেনে না। বগলা হালদারকে কেউ চেনে না। আমি চিনি। সে আমার ছোটবেলার বৃন্দা দূতি।
আমি রাধা নই। তবুও বৃন্দা দূতি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গে সঙ্গে আছে। তখন যে আমার কাছে ছিল কৃষ্ণ যাত্রার পালাগুলি। তার মধ্যে মানভঞ্জন আমার খুব প্রিয়। সেই পালাতেই বগলা, বগলা হালদার বৃন্দার ভূমিকায়। কৃষ্ণের সঙ্গে রসিকতা। গানে গানে কৃষ্ণের উত্তর।
সেই বগলা হালদার কোথায় যে গেল! কোথায় আছে কোনো খবর পাই না। আজকাল খবর বলতে, রাজনীতি খুন ধর্ষণ। এবং ঘটনা দুর্ঘটনা হয়ে প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে সব সময়।
আমার ভয় করে।
এসময় আমি খুঁজে বেড়াই, রাধা কৃষ্ণ ও বৃন্দাকে।
রাত্রির রঙ অভিনয়ের বেশভূষা ছেড়ে দেওয়ার পরেও বগলার কাছে কত সকাল এসেছে। আমিও গেছি তার সামনে। মনে হয়নি কখনো, গতকাল রাতে হ্যাজাকের আলোতে আমার ভারতবর্ষের এক রূপ, এই যে বগলা অভিনয় করছিল। এই বগলা আমার চেয়ে বড় হয়েও বন্ধু হয়ে গেছলো আমার।
বগলা কোথায়?
মোহন ? মোহন দে-কেও চেনে না আজকের লোকজন। সেই তো ছিল কৃষ্ণ। তার বাঁশি কে লুকালো? নাকি তার বাঁশি একলা অন্ধকারে নীরব হয়ে আছে?
সেই কৃষ্ণকেও আমার চাই।
এই ভর দুপুরেও আমাকে শোনাবে মান ভাঙ্গানো গান। সেই গান আমার অন্তরে জাগিয়ে রাখতেই হবে। আমার সামনে পিছনে যে অনেক অভিমান। আমিও শোনাবো মান ভাঙ্গানো গানের
করুণ সুর।
একটা পান দোকান ছিল। সেইখানে কৃষ্ণ বৃন্দা ও রাধার সকাল বেলার কুঞ্জবন। ওদের দেখতে পাবো, এই লোভে চলেও গেছি নিকটে।
তমাল তরুর ছায়া না থাকলেও হাসি মস্করার শব্দ ছিল। এ ওকে বলছে---কাল তুই যা পাট করেছিস, মেডেল তো পাবারই কথা। তখন রাধা কৃষ্ণকে বলছে-----কাল তুই বাঁশিটা উল্টো ধরেছিলি।
রাধা কোথায়?
অবনী?
অবনী হালদারই রাধা প্রায় দিন রাত্রিবেলায়। তখন তো অধিকাংশ গ্রামেই পালা পার্বণে গ্রামের মানুষ যাত্রাপালার আয়োজন করতো। আর এই তুলিনে রাধু বিটের পরিচালনায় কৃষ্ণ যাত্রা। রাধু বিটের লেখা পালা গুলিতে রাধু বিট সংগীত পরিচালকও।
বাঙালি মানসে একটা বড় জায়গা ছিল যাত্রাপালার। এক সময়। তখন জাঁকজমক ছিল না। কেবল সামিয়ানার নিচে অভিনয়। যে অভিনয় দেখার টানে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
সেই রাধা অবনী হালদারকেও আমি খুঁজে বেড়াই রাস্তা থেকে রাস্তায়। জঙ্গলে। ভিড়ে। দোকানেও। যদি দোকানে এসেছে নুন কিনতে।
আমার রাধা কৃষ্ণেরও নুন লাগে।
মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি যে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।
তোকেও যে খুঁজে পাচ্ছি না।
যাত্রাপালা শেষ হতে হতে অনেক রাত। অন্ধকারে ঘরে ফিরতে একটা হ্যারিকেন। সেই হ্যারিকেন কার হাতে যেন দুলতে দুলতে হারিয়ে গেল?
আমি যে মনে করেছিলাম, হ্যারিকেনের কাঁচের কালি আমার চোখের জলে ধুয়ে ফেলবো।
-----দুপুর--১--৩৩
----২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৭--৬--২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন