মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

মাটিতে রামধনু ওঠে - ৪১



৪১:
মাটিতে রামধনু ওঠে

উঁচু-নিচু জমি পার হতে হতে কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে পড়ি। কোথাও কোথাও হোঁচট খাই। উঠেও পড়ি।

প্রখর রোদ।

পাখিরাও নিজের নিজের বাসায়।

একটিও ডাক নেই।

একটিও ডাক আসবে না?

ভালোবাসা ছাড়াও তো ডাক দিতে পারে কেউ কেউ। নাকি ডাক দিতে গেলেই প্রকাশ হয়ে যাবে ভালোবাসা? নাকি ডাক দিয়ে গুরুত্ব দেবে না আমাকে?

গুরুত্ব?

গুরুত্ব চাইছি না। খিদেতেষ্টা আমাকে গুরুত্ব দিলেই চলবে। যেন খিদে পায়। পিপাসাতো চাইছি অহরহ।

হেঁটেই চলেছি----যা খুঁজছি তা এখনো আমার নাগালে নেই। চড়ুই পাখিকে অনেক অনেক দিন দেখিনি। আগে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে মুড়ির খোঁজ করতো।

কোথায় আছে চড়ুই? প্রতাপ বলতে পারবে? আমার মনে হয় সে পারবে না। সে কলকাতার ভিড়ে থাকে। এখন আমি যদি, সেই ভিড় থেকে একটা খেজুর গাছ চাই, সে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইবে।

হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো তাড়িখানা। কয়েকজন যুবক তাড়িতে চুমুক দিতে দিতে গল্প কথায়।

আমি কি এগিয়ে যাবো?

খেজুর গাছ কোথায়?

যতদূর দৃষ্টি যায় মাঠের পরে মাঠ। ঝাঁঝালো রোদ। উপর দিকে চোখ ওঠে না। আমার গায়ে জড়ানো গামছা থেকে বারবার মুছে নিচ্ছি ঘাম। কোথাও নেই জলের আধার। পিপাসাকে বুকে চেপে হেঁটে যাই।

অনেক মানুষ ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যাচ্ছে। খোঁজ করবে কে?

প্রিয়ংবদার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো--একাকী মানুষকেও চিহ্নিত করার প্রয়োজন আছে। এক জায়গায় জড়ো করে ভালোবাসার কথা বলতে হবে বৈকি।

প্রিয়ংবদা নিজের ঘরে সেলাই মেশিন রেখে নিজের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাপড় জামা সেলাই করে কতটুকুই বা রোজগার! আশ্চর্যের বিষয় সে লড়াই করতে করতে আর একা নয়। সে নিজের বৃত্তের কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে একটা দল করেছে। যাদের পথ দেখাবার চেষ্টাও করে। বাঁচার পথ। তাকে সমাজকর্মী বললে রেগে যায়। সে বলে---সমাজকর্মী হতে হলে বুকের জোর চাই।

আমার মনের জোর আছে?

সকাল বেলায় পায়রা না ডাকলে আমি মুষড়ে পড়ি।

নিজেকে কোথায় ধাক্কা দিলে সবাইকে খুঁজে পাবো? এই যে এখনও খুঁজে পাইনি সেই কবিতার প্রথম পংক্তি। তাকে খুঁজতে খুঁজতেইতো রোদে পুড়তে পুড়তে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত।

পাথর ফাটা রোদে জনপ্রাণী নেই।

একবার মনে হয়েছিল, প্রিয়ংবদাকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজবো। তারপরেই মনে হয়েছে, কাউকে সঙ্গে নিয়ে কিছুই খোঁজা যায় না।

প্রিয়ংবদা কে? তাকে কতটুকু চিনি? কতদিন ধরে চিনি? লুশাবেড়া তার সঙ্গে তো যাইনি কখনো। টুঁড়ুহুলু যাবো সুজলের সঙ্গে।

এই যে এই যে এখানে একটি কবিতার পঙক্তি---
                এক পায়ে দাঁড়িয়ে  
                          সব গাছ ছাড়িয়ে।

যাকে খুঁজছি তাকে তো পাই না। সেই তো আমার প্রেম। হারাতে হারাতেই  মিলবে গো সব মিলবে--একথায় আর আস্থা নেই আমার।

ভাঙ্গাচোরা আলপথে নেমেছি। নিচেই তো জমি, যাকে খুঁজছি যদি সে বীজের সঙ্গে লুকিয়ে আছে?

রুখাশুখা মাটিতে বীজ থাকার কথা নয়। তবু, তবুও নোখ আঁচড়াবো। যদি পাই। আমি আমার রক্ত ঘামে মেশাবো।

পেয়ে যাব সম্পূর্ণ কবিতা।

-----১০ জৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২৫---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার




৪২:
মাটিতে রামধনু ওঠে

দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি লুকিয়ে পড়ে। গাছের কোটরে। পাতার আড়ালে। তুই যখন গাছ তলাতে যাবি অপেক্ষা করার জন্য, তখন লুকানো বৃষ্টি তোর গায়ে পড়বে।

তোর অপেক্ষার গায়ে পড়বে।

কার জন্য অপেক্ষা?

তার সঙ্গে আলাপ হবে না? তার সঙ্গে কথা হবে না? তার মুখের আলোয় আমিও যে দেখতে চাই, আমার মুখ।

একটু ভুল হয়ে গেল, আমি তোর অপেক্ষার কাছে যাব না। ব্যাঘাত করবো না তোর মনের  অস্থিরতাকে। নাকি ধৈর্যকে? অপেক্ষা তো ধৈর্যেরও পরীক্ষা।

তোর সঙ্গে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে দেখা হোক। তখন তোর আঙ্গুলগুলো টেনে আমি খুঁজবো, কোনটা আমার কলম।

না, কলম খুঁজবো না। তুলিও না। তোর আঙ্গুলগুলি তো আলপনা আঁকে। আর এই এখন  তোর অপেক্ষার কাছে এসে দাঁড়াবে যে, তার মাথায় তার গালে আঙুলগুলি চলাফেরা করতেই পারে।

তোর অপেক্ষাকে দূর থেকে দেখাই উচিত মনে করছি। বরং গাছ তোকে দেখুক। তুই তো গাছের মতোই সুন্দরী।

তোকে বলেছি কিনা জানি না, আমি রোজ অপেক্ষা করি, কখন পোস্ত বাটার গন্ধ আসবে। কাঁচা লঙ্কা ঝাল হোক বা না হোক আমি দাঁতে কাটি না। আমার শুধু কাঁচা লঙ্কার গন্ধটা ধরে রাখতে ইচ্ছে করে।

তোর অপেক্ষা ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডের নয়। আমি তোকে দেখছি অনন্তকাল। 

অপেক্ষার তো শেষ নেই। অপেক্ষা চলতেই থাকে। ধারাবাহিক। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত বসন্ত হয়ে চলতেই থাকে।

এই অপেক্ষা থেকে তুই আমাকে শেরনার ঠিকানাটা দে। যদি একদিন হুট করে চলে যেতে পারি তার কাছে। তুই আমাকে দুলিয়ার গোপন কান্নার কাছে পৌঁছে দিতে পারিস, তোকে আমিও দেবো ১০১ টা পদ্মফুল।

ও পদ্মফুল পছন্দ নয়? শালুক ফুল? পানা ফুল? আকন্দ? তুই গোলাপ চাইলে আমি দেবো না। আমি নিজেই গোলাপের পক্ষে নই। তুই অবিনকে চাইলেও দিতে পারবো না। অবিন আশ্চর্য সুন্দর এক যুবক। অঙ্গনা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে।

যে গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছিস সেই গাছের পাতাটিও সুডোল। তুই দুচোখ মেলে দেখলে তুই দেখতে পাবি তোর অপেক্ষা।

অপেক্ষার তো অনেক ডালপালা।

অনেক পাতা।

কেউ সবুজ কেউ হলুদ। 

হলুদ যে হয়েছে অপেক্ষা করতে করতেই হয়েছে। তার গায়ে তোর আঙুলের স্পর্শ নেই।

আজ তোর অপেক্ষা না এলে তোর পাশে কে দাঁড়াবে? যদি হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ায় শুভদীপ?

দীপতো সব সময় শুভ। তাহলে কেন শুভদীপ? তার চেয়ে বরং আদারডি গ্রামের আলো অন্ধকার এসে দাঁড়ালে তোকে মানাবে ভালো।

আমলকিকে দেবো না। আমার মুঠোয় থাকবে আমার প্রাণবায়ু।

-----১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২৬--৫--২০২৩
-----নির্মল হালদার



৪৩:
মাটিতে রামধনু ওঠে

---শ্রী চৈতন্য কবি ছিলেন এ তোরা ভুলে গেলি?
----ওনার কবিতা তো পড়িনি।
----কবিতা লিখলেই কি কবি হয়? যদিও চৈতন্যদেব কবিতা লিখতেন। ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তার পান্ডুলিপি। জলে ভাসিয়ে দেবার মত ক্ষমতা আজকের কবিদের আছে?
-----তা আমি আর কি জানবো! তবে জানি, কবিরা শুধু নয়, আজকের অধিকাংশ মানুষই তার ছেঁড়া জুতো রাস্তায় ফেলে আসতে পারবে না। ছেঁড়া জুতার প্রতিও মোহ থেকে যায়।
-----তুই দেখছি মানুষকে ভালই চিনে গেছিস। কবিদের চিনতে পেরেছিস?
----আমি তো আর কাব্য জগতের লোক নই, আমি তুচ্ছ পাঠক।
-----পাঠক হয়ে থাকতে পারলে লাভ বেশি। শুধু কবিতাটা পড়ো। কবিকে জানার দরকার নেই।
-----অনেকের কাছে শুনেছি, কবিরা মহা ধুরন্ধর।
-----দু একজনের নাম বলতে পারবি না?
-----আমার বলাটা উচিত হবে না। আমার তো নিজের অভিজ্ঞতা নেই। শুনেছি, শঙ্খ ঘোষ কবি হিসেবে যত না বড় , তার চেয়েও বড় ছিলেন কাব্য রাজনীতিতে।
-----আমি জানি, কবি হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে অনেক উঁচু মাপের ছিলেন।
-----আপনার সঙ্গে আলাপ তো ছিল?
-----আলাপ ছিল না, একবার পরিচয় হয়েছিল যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। আমি তখন বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীর কাছে গেছলাম। সেও এখন
পুরুলিয়ার এক কলেজে পড়ায়।
------কী নাম বলুন তো?
-----মনে আছে কি এখন আর!
-----অবন্তিকা মিত্র কি?
-----হতে পারে। আমার স্মৃতি খুব গরিব।
----কবিরা তো কোন বিষয়েই গরিব হয় না। জানি। নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে, এই সত্যটা জানি।
------কে বলেছে নিঃসঙ্গ হয়? সমস্তটাই বানানো।
-----এ আমি মানতে পারলাম না।
-----তুই না মানলে আমার কিছু বলার নেই। এই সন্ধ্যাকালে এঁড়ে তর্ক করেও লাভ নেই।
----নিঃসঙ্গ বলেই, বেশিরভাগ কবি সন্ধে হলেই মদ্যপান করে।
------হা হা হা----মদ্যপানে নিসঙ্গতা কাটে আমি বিশ্বাসই করি না। আমি দু একবার পান করে দেখেছি নিঃসঙ্গতা বাড়ে।
-----আপনি দু একবার পান করেছেন! আমি তো শুনেছি, আপনি প্রতিদিন পান করতেন।
-----ভুল শুনেছিস। আমাকে নিয়ে বাজারে অনেক অপপ্রচার আছে, সেই দিকে তুই কান দিয়েছিস।
-----কান দিতে হয় না। কানের কাছে চলে আসে অনেক সত্য অনেক মিথ্যা।
-----ঝেড়ে ফেলবি।
-----সব ঝেড়ে ফেলা যায় না। কোনো কোনো গল্প কথা কান থেকে ঝুলেও থাকে।
------আয়নার কাছে গিয়ে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে নিবি। যা থাকলে অনেক সত্য  কানে এসে প্রবেশ করবে না।
------সত্য মিথ্যাকে যাচাই করবো কীভাবে?
------জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে। পড়াশোনা দিয়ে। তা যদি না করতে পারিস, মধুসূদন আড়ালে থেকে যাবেন। মধুসূদনের লেখার সঙ্গে তোর পরিচয় আছে?
-----মেঘনাদবধ কাব্য পড়েছি। দু' একজন অধ্যাপকের কাছে শুনেছি, মেঘনাদবধ কাব্য লেখা না হলে, রবীন্দ্রনাথ লিখতে পারতেন না কর্ণ কুন্তি সংবাদ।
------তাই?
-------আপনার কি সন্দেহ আছে?
------আমার সন্দেহে সাহিত্যের কিছু যায় আসে না। সাহিত্য সাহিত্যের জায়গায় থাকবে।
--------চলুন আরেকটা চা দোকানে। এখানে সিগারেট পাওয়া যায় না। ওই দোকানটাতে চা ও সিগারেট দুটোই পাবো।
-----আমাকে এক প্যাকেট বিড়ি কিনে দিস।
-----সিগারেট কি একদম খাচ্ছেন না?
-----সিগারেটের নেশা করলে অত টাকা পয়সা পাবো কোথায়? এমনিতেই, আমাকে অনেক জায়গায় ভিক্ষে করতে হয়। আর আমার তো ধরা বাঁধা কয়েকজন।
তাদের কাছে হাত পাতি। সিগারেট ধরলে, হাত পাতার জায়গাও বাড়াতে হবে। সে আর পারবোনা। যেমন ছন্দের কাছে হাত পাতলেও ছন্দ আসবেনা আমার কাছে। আমি আম পাতা জামপাতাই লিখে যাবো।
-----আপনি আমাকে একবার বলছিলেন সহজ পাঠের কথা।
------এখনো বলছি, ভবিষ্যতেও বলবো সহজ পাঠ একটি মহা গ্রন্থ। আমার কাছে বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ কবিতার বই।
-------আপনি তো বিভূতিভূষণকেও কবি বলেন।
-----হ্যাঁ বলি তো। বুদ্ধদেব বসুকে আমি কবি বলতে নারাজ। তিনি প্রবন্ধের জায়গায় চমৎকার।
------পরবর্তী সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে কবি বলবেন তো?
-------অবশ্যই বলবো। তুই আবার যদু মধুকে কবি বলতে বলিস না। চারদিকে কবির যা ভিড়। আমার ভয় করে। সমাজ মাধ্যমেও অজস্র কবি। এরা যদি একসঙ্গে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দেয়, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
-----হি হি হি --
----তুই হাসছিস? তুই নিশ্চয়ই দেখতে পাস, কবি তো অনেক। মানুষ নেই। মানুষের বড় অভাব। একই সঙ্গে মানুষ ও কবি আমাকে দেখাতে পারবি? কবিদের লুকানো দাঁত নখ প্রকাশ্যে এলেই, আরশোলা পালিয়ে যায়। কোনো কোনো কবি  বিপ্লবী সাজার চেষ্টা করে। তলে তলে তিনি আবার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। লিটিল ম্যাগাজিনের জগৎ তো আরো বিপজ্জনক।
------তাই তো দেখি। আমি একটি কাগজের গ্রাহক হয়েও আজ অব্দি একটি সংখ্যাও পেলাম না। অথচ আগাম টাকা দিয়ে দিয়েছি।
------কাগজটার নাম কি সাইকেল?
-----আপনি কেমন করে জানলেন?
-----আমার লেখা নিয়েছিল ওরা। কিন্তু পত্রিকা পাঠাননি। গালাগাল করলে যে কাঁচা ভাষায় করবো। তা করতে চাই না। চুপচাপ থেকে গেছি।
-----আপোষ করলেন?
-----কখনো কখনো কোথাও কোথাও নীরবতাও এক রকমের উপেক্ষার কথা বলে।
-----গ্রাহক না হয়েও আপনি প্রতিমাসে দেবদাসদার ভাইরাস কাগজটা পেতেন। আপনার কাছ থেকে জেনেছি।
------হ্যাঁ তা পেতাম। তখন আমি তেমন পরিচিত নই। কবি তো ছিলামই না। স্পষ্ট করে বলা ভালো, আজো আমি কবি নই। আমি একজন কলমজীবী। লেখার চেষ্টা করি মাত্র। এখন তো আবার প্রকাশকরাও লেখক। মন্ত্রী আমলারাও কবি।
------------
সন্ধে পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। জ্যৈষ্ঠের আকাশে মেঘ জমছে। শীতল হাওয়ার ঘোরাঘুরি। রাস্তা থেকে লোকজন দ্রুত বাড়ির দিকে। বৃষ্টি আসবে মনে হয়।

---------------
------চল্ রে চল্ , বাড়ি যাই। বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপের চেয়ে মন খারাপ হবে বেশি। ভাস্কর চক্রবর্তী আর পড়বো না। তার চেয়ে ভালো লাগবে বাসবদত্তার কবিতা। ওর কবিতার কাছে পাই থানকুনি পাতা। বাসক পাতা। হাঁসের কোলাহল। ওর কপালের টিপেও আমি বসত বাঁধতে পারি।
-----আমি তো নাম শুনিনি।
-----তুই তো শুধু আনন্দের কবি সমাজকে চিনিস। তার বাইরেই যে গোটা মানব সমাজ তুই চিনলিনারে। এবার মনে হয়, ছেলে মেয়েও আসবে আনন্দ প্রোডাকশন থেকে। বাঙালির যে কত রকম দুর্ভাগ্য!
------চলুন চলুন----গায়ে পড়েছে বৃষ্টির ফোঁটা।
-----ভালোই তো ভালোই তো। সব কালিমা ধুয়ে যাবে আমাদের।

-----১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২৭---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার



৪৪:
মাটিতে রামধনু ওঠে

কোনো ডাক না পেলে মাদল বাজে না। বাঁশি বাজে না। ওরা ঘরেই থাকে। অন্ধকারে। ডাক পেলেই ওদের আহার। পিপাসাও মিটে যায়।

ডাক তো আসে না।

নাচের পা নাচের হাতও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকে। প্রতিদিন।

পাহাড়তলির এই গ্রামে পাতা নাচের নিকটে ডাক আসেনি। ডাক পেলে দু'চারটে পয়সাও হাতে আসে।

কে আর ডাকবে?

শহুরে বিনোদন  নানারকম। সেখানে আদিবাসী নৃত্যের মাদল বাজবে না। বাঁশি বাজবে না।

শহুরে বিনোদনে শব্দ চাই। এখন তো গ্রামে গ্রামেও ডিজে। তার অত্যাচারে চাপা পড়ে যাচ্ছে বাঁশির মৃদু লয়। মাদলের বোল।

বাঁশপাতা ঝরে যাওয়ার শব্দেও সুর আছে। পাখিরা শুনতে পায়। ডিজে বেজে উঠলে পাখিরা গাছ থেকে চলে যায় আকাশের দিকে।

উঁচুতে ডিজের শব্দ উঠবে না।

ঘরে তো ফিরতেই হয়। আহার আছে বিশ্রাম আছে। ছানাপোনারাও বড় না হলে বাসাতেই থাকে। এবং ডিজের শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ে কেউ কেউ।

বাঁশির মর্ম বেদনার কাছে মাদল মনমরা হয়ে থাকে।

ডাক আসে না।

আগামীকাল পাতা নাচের সুরে যদি ঢুকে পড়ে হিন্দি ফিল্মি গানের সুর?

পূর্ণিমার চাঁদে আগুন জ্বলবে।

বাঁশি ও মাদল একা হয়ে যাচ্ছে।

একা হয়ে যাচ্ছে খুব।

-----১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২৮---৫---২০২৩
------নির্মল হালদার



৪৫:
মাটিতে রামধনু ওঠে

সকাল ন'টার মধ্যে গ্রামের অধিকাংশ মহিলা ও মরদ কাজে চলে যায়। শহরে।

গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত একই ছবি।

নিঝুম এক ছবি।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। যারা যায় না তারা ধুলোবালি খেলে। বেলা হলে তারাও ঘরে ঢুকে যায়।

নিঝুম লাগে চারপাশ।

কোনো শব্দ নেই কোলাহল নেই। কেবল ছোট ছোট এই রাস্তা ওই রাস্তা। সারি সারি ঘর। খড়ের চালা।খাপরার চালা। দু'চারটে গাছপালা। পাতারা দুলছে। থেমেও যায়।

আকাশ অনেক বড়। তার চেয়ে বড় খিদে। এই খিদের জ্বালায় গ্রাম থেকে শহর কাজে যায়। কাজের খোঁজেও যায় মানুষ।

ঘরে ঘরে সকাল দিকেই রান্না হয়ে যায়। দুপুরে ঠান্ডা হয়ে যায় ভাত। ছোট ছেলেমেয়েরা এবং যারা কাজে যাচ্ছে না তারা  ঠান্ডা ভাত তরকারি মুখে তোলে।

অনেক মহিলা কাছের জঙ্গলে শুকনো পাতা সংগ্রহ করতে চলে যায় দুপুরে।

শুকনো পাতা উনুনে গুঁজে গুঁজে জ্বালানি। রান্নাবান্না। নিজের জায়গায় গ্রাম একলা হয়ে থাকে। তার দিকে দৃষ্টি পড়েনা কারোর।

একলা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেও কুকুর খুঁজে পায়না খাদ্য। দূরের এক পাখি রাস্তায় নামে। উড়েও যায়।

কেউ কোথাও নেই।

রোদ জ্বলছে।

ছেঁড়া পাতা ঘুরে বেড়ায়। তাকে ধরবে না কেউ। ছোঁবে না কেউ। ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে যাবে, কোনো ঠিকানা নেই।

শহরে কাজ করতে করতে কোনো মহিলার মনে পড়ে তার সন্তানের কথা--- কি করছে  নুনু?

এই মনে পড়ে যাওয়াও খুব একা।

যেখানে কোনোদিন পৌছবে না আন্তরিক হাওয়া।

------১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-------৩০---৫---২০২৩
------নির্মল হালদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ