ঘর গেরস্থের শিল্প
১:
উনুন
উনুন ভেঙে গেছে।
উনুন ভেঙে গেছে। মাটি লাগবে। মা একে বলে তাকে বলে, কেউ এনে দেয় না। শহরে মেলেনা মাটি। যা পাওয়া যায়, উনুন হবে না।
সব মাটিতে উনুন হয় না।
শেষ অব্দি মা আমাদের ভাগ চাষী মতি মাহাতর কাছে অনুনয়-বিনয় করে বললো---মাহাত, কাল তোদের গাঁ থেকে এক থলি মাটি এনে দিতেই হবে আমাকে। উনুনটা ভেঙে গেছে।
উনুনের কোনো বিকল্প তো নেই।
দুবেলা রান্নার জন্য উনুন আবশ্যিক।
কয়লার উনুন। পাথুরে কয়লা হলে আঁচ হবেনা। এবং উনুনের মুখে কয়লা দেবার আগে কাঠ ও ঘুঁটে সাজানো। কম বেশি হলে হবে না, যতটুকু দরকার ততটুকু।
উনুনের যত্ন আত্তি চাই।
সাত সকালে ছাইপাশ ফেলে, উনুন পরিষ্কার করে উনুনে গোবর লেপতে হবে। এ একরকম উনুনের স্নান। তারপর তো বেলা নটা দশটা থেকে উনুন জ্বলবে।
খিদে দাউ দাউ করে জ্বলবে।
প্রথমেই, মাটির খোলাতে সেদ্ধ হবে ডাল। ফুটতে ফুটতে ডালের ফেনা উপচে পড়বে উনুনের গায়ে।
হলুদ রঙের অলংকরণ দেখা যাবে উনুনের চারপাশে। তারপর তো ভাত। ভাত ফুটতে ফুটতে ভাতের ফেনাও উপচে পড়বে। গায়ে পড়বে উনুনের।
আগে ছিল ডালের হলুদ। পরে এলো ভাতের ফেনার শাদা। হলুদ ও শাদা মিলেমিশে উনুনের আরেক রূপ।
নানা সবজির তেল হলুদ মসলার সেদ্ধ জল উনুনকে সাজাবেই। কিংবা ডাল ভাত তরকারির প্রথম স্বাদ উনুনকেই দিতে হবে প্রথম।
উনুন তো গেরস্তের দেবতা। তাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে। নইলে যে অকল্যাণ।
কল্যাণ চাই।
সবাই যে উনুনের মতো দেবতা গড়তে পারেনা। দেখা গেছে, হালদার ঘরের খুড়ি দত্ত ঘরের এক বউকে বলছে---ও মেজ বউ আমাদের উনুনে একটু তোমার হাত লাগিয়ে দিয়ে যাবে গো। একটু উপকার করবে গো। দেখবে তোমার ব্যাটা, দুধে ভাতে থাকবে।
কড়াইয়ে দুধ ফুটতে ফুটতেও উপচে পড়ছে। যেন বা উনুনের হাসি হয়ে উঠছে। উনুন যে গেরস্থের কল্যাণ কামনা করে। সব সময়।
বছরে দু একবার অরন্ধনের সময় উনুনের বিশ্রাম। তখন উনুনের পূজা। একবার মাঘ মাসে। আরেকবার শ্রাবণ বা ভাদ্র। তখন উনুনের রূপ ঝকঝকে তকতকে।
আরেক দেবী প্রতিমা।
উনুন এক শিল্প। কুটির শিল্প। গেরস্থ ঘরের শিল্প। যা এক সময় মেয়েদের হাতে গড়ে উঠেছিল।
একেক জায়গায় একেক রকম তার চেহারা। শহরের উনুন কয়লার উনুন। গ্রামের উনুন কাঠের উনুন। সেই উনুনে শুধু কাঠ জ্বলবে। অথবা শুকনো পাতা। গ্রামীণ কাঠামোতে দেখা গেছে উনুনের তিনটে মুখ। বিশেষ করে আদিবাসীদের ঘরে। এখনো দেখা যায়। তাদের জীবনযাত্রা থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি উনুনের ভূমিকা।
কোনো সচ্ছল পরিবারে গ্যাস ওভেন প্রবেশ করলেও উনুনেই রান্নাবান্না হচ্ছে।
গাছ তলাতেও ইঁটের উনুনে ভাত ফোটে। গ্রামের দিকে খেটে খাওয়া দিনমজুরদের ঘরে পাথরের উনুন। তিনদিকে তিনটে পাথর সাজিয়ে উনুনের রূপ।
নানা দিকে নানাভাবে উনুনের চেহারা দেখে মনে হয়, দেব দেবীদের রূপতো বিভিন্ন রকম হবেই। এই তো স্বাভাবিক।
তোলা উনুন হলো, ভাঙ্গা বা অকেজো লোহার বালতিতে তৈরি করা হয়। পাতা উনুন হলো, মেঝেতে তৈরি করা হবে। যা গ্রাম দেশে দেখা যায়। তোলা উনুন মফস্বল শহরের ঘরে ঘরে দেখা যেত এক সময়।
যেকোনো পরিবারে উনুন হলো সবার উপরে। আগে উনুনের পরিচর্যা। এখনো গ্রামীন পরিবারে চাষী পরিবারে দেখা যায় বড় বড় উনুন। ধান সেদ্ধ করার জন্য।
শহুরে জীবন চর্যায় উনুন আজ ব্রাত্য হয়ে পড়লেও গ্রামীন জীবনযাপনে উনুন আছে উনুনের উজ্জ্বলতায়।
উনুন এক শিল্প। যা এদেশে মেয়েদের হাতেই গড়ে উঠেছে। জানলা ভাঙ্গা লোহার শিক তার পাঁজর ।
কত কত আগুন যে ধরে রাখে, কত কত উত্তাপ, শেষ হতে হতেও অক্ষয় হয়ে আছে এই গরিব বাংলায়।
------২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১০---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার
২:
পান : খিলি পান
রাজা--রাজড়াদের পান কোত্থেকে আসতো সেই
গল্পের কাছে যাচ্ছি না। পানের রং-রস মেয়েদের ঠোঁট রাঙিয়ে তুলত। তা কতটা মনোরঞ্জন করত পুরুষদের সে গল্পেও যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি, আমার পানের ডাবরের কাছে। চুনের ভাঁড়ের কাছে। দোক্তা --সুপারি--খয়েরের কৌটোর কাছে। যা আমাদের ঘরেও ছিল। মা বৌদির জন্য।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে পান-দোক্তা মায়ের চাই। যদি দেখতো পান নাই, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ডাক: যারে দু পয়সা পান এনে দে---মুখটা টক টক লাগছে। অনেক সময় মায়ের কথা আমি গ্রাহ্য করিনি। কোনো হুঁ হাঁ-ও করছি না। মা আবার ডাকে : যা বাবা যা একটু এনে দে---।
ইচ্ছা অনিচ্ছায় মাকে আমি পান এনে দি।
এই পান আমাদের সংসারের।
দোক্তা ফুরিয়ে গেলেও মা আমাকেই বলতো : বাজারের দোকান থেকে দোক্তা পাতা নিয়ে আসার জন্য। তার সঙ্গে দোক্তার মসলা মৌরী ধনে ও জোয়ান নিয়ে আসতে হবে।
দোক্তা ভাজবে মা।
দোক্তা ভাজাটাও এক বিশেষ কর্ম। বাঙালি জীবনে ঘরোয়া শিল্প। উনুনে শুকনো গরম তাওয়াতে ভেজে নিতে হবে মৌরি ধনে জোয়ান। তারপর হাতের মুঠোয় গুঁড়ো করে দোক্তা পাতার সঙ্গে মেশানো। মেলানো।
দোক্তা পাতার চাষ হয়ে থাকে দামোদরের দু পাশে। বর্ধমানের কাছাকাছি।কারণ,নদীর জলে ধুয়ে শুকানো হয়ে থাকে। এবং দোক্তা গাছ ছোট হলেও পাতাগুলি সেগুন পাতার মত বড় বড়। দেখতে ইস্কাপনের মত। এইসঙ্গে চুনের কথাও বলতে হয়।
পানের ডাবরের কাছে চুন না থাকলে মা আমাকেই ডাকতো : কইরে কোথায় গেলি! একটু চুন এনে দে---। আমি দোকান থেকে দুটো পয়সা নিয়ে কিংবা একমুঠো চাল নিয়ে চুনওয়ালিদের কাছে গেলাম। ওরা পয়সার চেয়ে চাল নিতেই উৎসাহ দেখাতো।
ওরা গ্রাম থেকে আসতো চুন বিক্রি করতে। পাথুরে চুন। জল দিলেই ফুটে যায়। সেই চুন বাজারে বিক্রি। যে যার মতো কিনে নিয়ে যেত।
পানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ সমস্ত জীবন। যে জীবন রাঙিয়ে দিয়ে যায়। পানের রস ঠোঁট রাঙালেও অম্বল নাশও করে।
পানের ব্যবহার পুজো থেকে শুরু করে যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। পানের মর্যাদা প্রতিদিন। প্রতি ক্ষণ। নিঃশব্দে।
ঘরে ঘরে।
চুন সুপারি খয়ের দোক্তা দিয়ে পান সাজানো পানের খিলি করাও রীতিমতো এক শিল্প।
কুটির শিল্প।
আমাদের ছোটবেলায় পারিবারিক বড় কোনো অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ার পরে ঘরের সাজা পান অতিথিদের হাতে হাতে দেওয়া হতো। এ জন্য ঘরের বয়স্ক মহিলারা দুপুর থেকেই পান সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। একটা দুটো পান নয়তো, দুশোর বেশি অন্তত।
আমাদের সমাজ জীবনে পানের ভূমিকা আজও উঁচু হয়ে আছে। কেন না, পান খাওয়া হয় যেমন তেমনিভাবে পানকে আমরা ব্যবহার করে থাকি শুভ কাজে।
পান আমাদের সঙ্গেই থাকে। পরিবারের অংশ হয়ে। শুভ আকাঙ্খায়।
-----২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১১---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার
৩:
কাঁথা ও আসন এবং অন্যান্য
গ্রীষ্ম দিনের দুপুর বেলা। চারদিক চুপচাপ। এঁঠো কাঁটা মুখে নিয়ে উড়ে গেছে কাক। ঘরের টঙে উঠে গেছে পায়রা।
শিশুরা ঘুমিয়ে গেছে।
কোনো কোনো মহিলা শাড়ির পাড় থেকে টেনে টেনে জড়ো করছে সুতো। সেলাই করবে কাঁথা।
এক রকমের সুতো নয়, নানান শাড়ি। তাদের নানান পাড়। অনেক রকমের রঙ।
যত রঙ তত ভালো লাগবে কাঁথার চেহারা। মহিলারা তাই শাড়ির পাড় থেকে সুতো টেনে টেনে জড়ো করছে। তার ফাঁকেই সংসারের গল্প। শ্বশুর শাশুড়ি থেকে আরম্ভ করে জা-ভাসুর, ননদের গল্প। সোমবার নাপিত বউ এলে পরতেই হবে আলতা----পা-টা খালি খালি দেখাচ্ছে---এ গল্পও
চলছে।
কাঁথার যে প্রয়োজন খুব। মাটিতে মেলতে। শুতে। গায়ে ঢাকা নিতেও হয়। লেপ তোষক কম্বলের ঘর যে নয়, সাধারণ বাঙালি ঘর। নিম্নবিত্ত। কাঁথা ছাড়া চলবে না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোলে শীত চলে যায়। এ কারণেই, খর দিনের এই দীর্ঘ দুপুরে কাঁথা সেলাই। বিকেল অব্দি চলবে।
সেলাইয়ের ছুঁচ ছোট বড় মাঝারি।
যার হাত চটপটে তার কাঁথা সেলাই এগিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। সে হয়তো মাসে দুটো বড় মাপের কাঁথা তৈরি করে ফেললো। শুধু তো সেলাই নয়, কোনো কোনো কাঁথায় ফুল ফল লতাপাতা।
ঘরে এসেছে নবজাতক। তার জন্য কয়েকটা লাগবে কাঁথা। ছোট কাঁথা সেলাই করতে সময় লাগে। কেউ কেউ নবজাতকদের কাঁথায় সেলাই করে--"সুখে থাকো খোকা"। কোনো কাঁথায় লেখা হয়----"দুধে ভাতে থাকো"।
নবজাতকদের জন্য তৈরি হয়ে উঠতো ছোট ছোট অনেক কাঁথা। ওরা যে ঘন ঘন কাঁথা ভেজায়।
সেই আমলে শাড়ি ছিঁড়ে গেলেও একদিকে জমিয়ে রাখা হতো। কাঁথা তৈরিতে কাজে লাগবে। শাড়িটা যদি একদম ফলাফালা হয়ে থাকে তবুও জমানো থাকতো। টিনের বাক্সে। শাড়ির পাড় থেকে পাওয়া যাবে সুতো।
কাঁথা-কানির সংসারে কাঁথাও ছিল ঘরের একজন। যে দেখতে পেয়েছে, ঘরের মেয়ে বউদের কান্না। লুকিয়ে ফেলেছে চোখের জল।
এই মেয়ে বউরা বৈশাখ -জ্যৈষ্ঠ মাসেই আসন বুনতো। চট জোগাড় করে আসনের মাপ মতো কেটে আসন সেলাই। সেই আসনেই সেলাই হয়েছে------"আসুন বসুন"।
একদিন আমাদের ঘরের মেয়েরা নিজেরাই খুঁজে নিয়েছে নিজেদের কারু কাজ। নিজেদের ঘরোয়া শিল্প। তাদের হাত বাড়াতে হয়নি অন্যদিকে। এবং নিজেরাই হয়েছে নিজে গুনে স্বনির্ভর। নিজেদের এই কাজ থেকে অর্থ উপার্জন না হলেও সংসারের উপকার হয়েছে। সেও তো অর্থের চেয়ে কম নয়।
তখনকার দিনে পাত্রী দেখতে এলে, পাত্রপক্ষ দেখতে চাইতেন, পাত্রীর হাতের কাজ। দেখানো হতো, আসন। নানা রঙের সুতোয় বোনা খাবারের ঢাকনা। দেয়ালে টাঙানো দুই হরিণ শিশু। যা শাদা কাপড়ে ছুঁচ--সুতোয় বোনা।
কালি ঝুলি পড়লেও দেখা যায় দেয়ালে ঝুলছে---পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম----।
সেকালের সেই মেয়েদের ঘরোয়া কাজ গুলি ছুঁচ--সুতোর কাজগুলি নতুন আঙ্গিকে আসছে। বিপণন হয়ে। তা কিছুটা যন্ত্র থেকে তৈরি হচ্ছে। আর কাঁথা শিল্পের তো জগৎজোড়া খ্যাতি। বীরভূম জেলার মেয়েদের হাত থেকে তৈরি হয়ে চলে গেছে পাহাড়ে। সমুদ্রে।
এই ছবি থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেই সময়ের বাংলার মেয়েদের কাজ আজ নতুন করে মূল্যায়ন হচ্ছে।
এই মেয়েদের আমরা যেন ভুলে না যাই।
-----২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
----১২---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার
৪:
আলপনা
আলপনা। বৃহস্পতিবার ঘরের চৌকাঠে। এ শুধু লক্ষ্মী দেবীকে আহ্বান করার জন্য নয়, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকেও আলপনার আহ্বান।
আমি মনে করি এই।
আমাদের মেয়েরা জানে, সবাইকে ভালোবাসতে হলে একই রীতিতে ভালবাসতে হয়। তাই, লক্ষ্মী দেবীকে যে রীতিতে আহ্বান করা হচ্ছে কিংবা ভালোবাসা হচ্ছে, মানুষকেও সেই রীতি ধরেই ভালবাসতে হয়।
লক্ষী দেবী হলেও ঘরেরই মেয়ে।
বাঙালি ঘরের মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই আলপনা আঁকে। পুজো থেকে আরম্ভ করে বিয়ের অনুষ্ঠানেও।
আলপনা আঁকা আঁকির জন্য কোনো প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই মা মাসি পিসি জেঠি খুড়িদের আলপনা আঁকা দেখতে দেখতে মনে মনে পাঠ নিয়ে থাকে----- কেমন করে আঙুল ঘোরাতে হয়,প্যাঁচাতে হয়। এবং খড়ি মাটিতে কতটুকু জল মেশালে ফুটে উঠবে আলপনার শাদা।
প্রায় সমস্ত বাঙালি ঘরেই খড়ি মাটি থাকে। বৃহস্পতিবার যাকে লক্ষ্মী বারও বলা হয়ে থাকে, কেননা, এই দিনে লক্ষ্মীর পুজো।
সপ্তাহে একদিন।
প্রতি সপ্তাহে পুজো।
ঘরে ঘরে আলপনা। যা দৃষ্টিনন্দন।
মনে হয়, বাঙালি মেয়েরা জন্ম থেকেই বহন করে নান্দনিক বোধ। তার প্রথম উদাহরণ, আলপনা।
আমাদের এই বাংলাদেশের এক একটি গ্রামে এক এক রকম আলপনা। রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করতেও চেয়েছিলেন। জেনেছি।
আমি দেখেছি, বৃহস্পতিবারের আলপনা এবং বিবাহ অনুষ্ঠানের আলপনা একই ধাঁচের নয়। মেয়েরা জানে, কোথায় কি আঁকতে হবে।
এই শিক্ষাও পারিবারিক শিক্ষা।
এখানে আমি বলতেই পারি, মেয়েরা কোনোদিন পিছিয়ে ছিলনা সৃষ্টি ও কল্পনা থেকে।
সন্তানকে মানুষ করার মধ্যেও কল্পনা থাকে। যেমন আলপনা আঁকার জন্য খড়ি মাটি থাকে। মেয়েরা তা জানে বলেই, মেয়েরা আজও সুন্দর।
মেয়েদের সুচারু আঙুল থেকেই নব নব রূপে আলপনা এসেছে ঘরে ঘরে। চৌকাঠে।
এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে----বাইরে থেকে ঘরে ঢুকছি যেই----- "দাঁড়া দাঁড়া" মায়ের সাবধান বাণী --- "দেখিস
পায়ে পায়ে আলপনা যেন মুছে না যায়।"
-----২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১৩---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার
৫:
বড়ি
বিরি কলাই ভেজানো হয়েছে। সারারাত ভিজবে। সকালে হবে শিল -নোড়াতে বাটা। তার আগে শিল-নোড়া দিয়েই ভাঙ্গা হয়েছে বিরি। ঝরে গেছে বিরির কালো খোসা।
বিরি বাটা থেকেই বড়ি।
তেলের টিন বা ঘিয়ের টিন কেটে বড়ি দেবার ও শুকানোর একটি পাত্র তৈরি করা হয়। প্রধানত শীতের দিকেই বড়ি দেবার কাজ। যা থেকেও যাবে প্রায় সারা বছর। কেউ কেউ ঘরের খাওয়ার জন্য বড়ি তৈরি করে। কেউ কেউ বিক্রি করার জন্য।
বড়ি বিক্রি করেও দুটো পয়সা আসে। সংসারের তেল-নুনটা হয়।
সবাই তো বড়ি দিতেও পারেনা। দু আঙুলে বড়ি বাটা নিয়ে টিনের পাতে একটি একটি করে ফেলা, সহজ কাজ নয়। যেন বড়ির নাকটিও উঁচু হয়। মানুষের নাকের মতো খাড়া। বয়স্ক মহিলাদের কেউ কেউ যত সহজে বড়ি দিতে পারে কম বয়সী মেয়েরা পারেনা।
যেকোনো রচনা যেকোনো শিল্প সবার হাতে গড়ে ওঠে না। অথবা বলা যায়, সৃষ্টির দিকে যায় না।
অনেকে কারিগর হয়। শিল্পী হয় না। বড়িও তো শিল্প। মন দিতে হয়েছে। ধ্যান দিতে হয়েছে। তারপর এক একটি বড়ি। রোদে শুকনো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের রূপে।
এই বড়ি-শিল্প বিক্রি করে নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারে হাসি দেখা গেছে। একসময়। আজ অবশ্যই কলে বানানো বড়ি বাজারে দেখা যায়। তার স্বাদ কি ঘরে বানানো বড়ির মতো?
সময়ের ঘূর্ণনে অনেক কিছুই পাল্টে যেতে যেতে দেখা গেল দেখা যাচ্ছে আজও অনেকের জীবিকাও শেষ হয়ে গেল। যেমন, টোটোর মত যান এসে রিক্সাওয়ালাদের পেটের ভাত মেরে ফেলেছে।
আমাদের এই বাংলায় বড়ি ও ঠোঙা ঘরে বানিয়ে মেয়েরা সহযোগিতা করেছে স্বামী ও সংসারকে। মেয়েরাই পেটকোলে কাঁসার থালা প্রতিবেশীর কাছে বন্ধক রেখে নিজের ঘরের সম্মান বজায় রেখেছে। অনেক সময় কোনো বড় বিপদে মেয়েরা নিজেদের গয়না বন্ধক রেখেছে। কখনো কখনো বাধ্য হয়েছে বিক্রি করতে। এই মেয়েরাই সবচেয়ে অবহেলিত, উপেক্ষিত বাঙালি পরিবারে।
নিজের খাওয়া পরার দিকে না তাকিয়ে ছেলে মেয়ে ও স্বামীর জন্য প্রাণপাত করে গেছে সেকালের মেয়েরা। এখনো করছে। হয়ত ছবিটা পাল্টে গেছে কোথাও কোথাও। কিন্তু নিজেদের উৎসর্গ করতে মেয়েরা ভুলে যায়নি। এখনো তাদের যে ত্যাগ, নীরবে---অনেক সময় বাড়ির গৃহকর্তা জানতেও পারেন না।
একটু আগেই দেখা গেছে চাল নেই। তার একটু পরেই এসে পড়লো চাল। জাদু খেলা তো নয়, কিভাবে কেমন করে এলো, ঘরের কেউ টের পেলো না।
অভাব যেন চোখে মুখে প্রকাশ না পায়, এজন্যেই বড়ি। বড়ি তৈরি। তা ভোরে উঠেই, শিল-নোড়ার কাছে যাওয়া। কোমরে ব্যথা ধরে। ঘাড়ে টান। তবু অভাবকে শিল-নোড়াতে পিষতে পিষতে কোনো কোনো মা দেখতো বড়ির মতো শাদা হাসি ছেলেমেয়েদের মুখে।
সেই বড়ি দেওয়া মেয়েদের কথা যেন ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই বাঙালির সংসারে মেয়েদের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে কত ছোটখাটো শিল্প। শিল্প সামগ্রী।
যা হাতে হাতে বিক্রি হয়েছে।
ঘরে এসে নিয়ে গেছে দু পয়সা চার পয়সার বড়ি। সেই বড়ির সৌন্দর্য নিম্নবিত্ত বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্য।
-----৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----১৪---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন