মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

মাটিতে রামধনু ওঠে - ৩১



৩১:
মাটিতে রামধনু ওঠে

আমার ছোট্ট একটি ঘরে আমি মেঝেতে বসেই লেখা লিখি করি। আলস্য করি।

মেঝেতেই শুয়ে থাকি। মেঝেতেই ঘুম। বন্ধুবান্ধবরা এলে মেঝেতেই। শোওয়া-বসা-আড্ডা সমস্তই।

একটা চেয়ার আছে। ইজি চেয়ার।

যার ইচ্ছে সে এসে বসতে পারে।

তবে চেয়ারটি সারাদিন একা পড়ে থাকে। নাকি চেয়ারটি একা থাকে না? আমার পূর্বপুরুষরা কেউ কেউ এসে বসে কি? আমার মাতৃকুলের কেউ এসে বসে কি?

তারা তো কেউ চেয়ারের লোক ছিল না। আমি যেটুকু জানি। তারপরেও ভাবি, চেয়ারটা ফাঁকা দেখে যদি বসে! আমার কুশল জানার জন্য কেউ কেউ তো আসতেই পারে। তারাও তো ভাবতে পারে, চেয়ারটা তাদের জন্যই।

আমি তো একদমই চেয়ারের আসন ব্যবহার করি না। অন্তত আমার ঘরে।

চেয়ারে বসবো চেয়ারে বসতে দেবো এই সংস্কৃতির মধ্যে আমি বড় হয়ে উঠিনি। আমার অভ্যেসও নেই, চেয়ার ব্যবহার করা।

মাঝরাতে কখনো কখনো ঘুম ভাঙলেই আমার চোখ চলে গেছে চেয়ারের দিকে। কেউ বসে আছে নাকি, এই সন্দেহে চেয়ে থেকেছি অনেকক্ষণ।

কাউকেই দেখতে পাই না।

ততক্ষণে ঘুম চলে গেছে। এপাশ-ওপাশ করি। আলো নেভাই। আলো জ্বালাই। জেগে ওঠে পিপাসা।

খুঁজে পাই না জলের বোতল। অথবা খুঁজে পেলেও জল নেই।

একদিন ভোরের সময় মনে হলো, চেয়ারে বসে আছে কেউ। অথচ তাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু চেয়ারের তলে দুটি পা। ফর্সা দুটি পা। কোনো মহিলার পা। আমি শুয়ে শুয়েই জানতে চাইলাম----কে আপনি কে কে?

নিস্তব্ধতা।

কয়েক মুহূর্ত পরেই, পা দুটি দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি চিনতে পারলাম না, কার পা এসেছিল। পায়ের চিহ্ন পড়েনি ঘরের মেঝেতে।

চেয়ারটা কার জন্য অপেক্ষা করে? একদিন দেখি, চেয়ারের হাতলে পড়ে আছে শাড়ির আঁচল। আমি শুয়ে শুয়েই আঁচলের দিকে হাত বাড়াই। উড়ে যায় আঁচল। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।

দরজা তো বন্ধ। অথচ আঁচলটি নেই।

চেয়ারটা আর কাছে রাখবো না।

পিটার পালক ব্যবহার করবে, ওদের কাছে রেখে দেবো। সঙ্গে সঙ্গে আরেক ভাবনা আসে, ওরা এখুনি হেলান দিয়ে বসলে, শিরদাঁড়ার ক্ষতি হতেই পারে। ওদের দেবো না। আমার ঘরেই থাক।

একলা একলা থাক। নিজের মতো করে থাকুক।

আমিও তো নিজের মতো করেই থাকি। তার দিকে আমার লক্ষ্য যায় না। আমি নজর করি না, তার রঙ কতটা ফ্যাকাসে হলো।

চেয়ারটা আমাকে দিয়েছে আমাদের বাড়ির বড় ছেলে নুপুর। তার উপহারকে যথার্থ সম্মান দেওয়া আমার কাজ। চেয়ারটাকে তাই সকাল সন্ধ্যা ঝাড়মোছ করা দরকার। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আজ ভোরের সময় দেখছিলাম, ছেঁড়া ছেঁড়া চুল পড়ে আছে চেয়ারে। কাঁচাপাকা লম্বা লম্বা চুল।

কে এসেছিল কখন?

এতো মেয়েদের মাথার চুল। যদি তা হয়েই থাকে, কে ছিল? মেয়েদের তো কাঁচা পাকা চুল হয় না, নিশ্চয়ই কোনো মহিলার চুল। কে ছিল মহিলা?

রোদ এসে চেয়ারে বসলো।

------বেলা-১০--২
-----২৬ বোশেখ ১৫৩০
-----১০---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার



৩২:
মাটিতে রামধনু ওঠে

বিছানার চাদরেও ফুল ফল থাকে। লতা পাতা থাকে। তুমি স্পর্শ না করা অব্দি ওই লতা পাতা ফুল ফল প্রাণ পাবে না। তোমার স্পর্শ মানে তোমার শয়ন। তুমি হাত-পা ছড়িয়ে দেবে। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে দিলেই, জেগে উঠবে প্রাণ।

প্রাণের সজীবতা।

তুমি দেরি করো না, স্পর্শ করার কোনো সময় অসময় বলে কিছু নেই। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে বিছানার চাদর। এবং তার নীরবতা।

নীরবতার কাছে তুমি স্পর্শ রাখো।

স্পর্শেই জাদু থাকে। শিউরে ওঠা।

তুমি জেনে রাখো, চাদরটি তোমার কাছেই এসেছে। তোমার কাছ থেকেই আশা করে, তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে জাগাবে প্রাণ।

এইতো চাদর পেতেছো তুমি। শাদা -কালো রঙের মানুষও আছে দেখছি। তোমার জন্যেই এসেছে বহু যুগের ওপার হতে। ওদের সঙ্গে আলাপ করো। ওদের কুশল জেনে ঠিকানা নাও। তোমার সঙ্গে ওদের ভালবাসাবাসি হোক। ভালোবাসাই তো সমস্ত জীবনকে যত্নে রাখে।

ফুল ফল লতাপাতা এবং মানুষ তোমার কাছে এসেছে মানেই জীবন এসেছে। যে জীবনকে কাছে রেখে তোমার জীবনের সঙ্গে মেলাতে হবে।

সারাদিন বিছানার চাদর একা থাকে। যত তাড়াতাড়ি পারো তাকে সঙ্গ দাও। বিছিয়ে দাও তোমার শরীর।

তুমিও তো একা। চাদরের ফুল ফল লতাপাতা শাদা কালো মানুষ তোমাকে সঙ্গ দেবে।

আমাকে তুমি সঙ্গ না দাও, আমি অভিমান করবো না। আমাকে তুমি সময় না দাও, আমি রাগ করবো না। মিনতি করবো শুধু, চাদরের ফুল ফলে তুমি তৃষ্ণা জাগাও।

পিপাসা থেকে পিপাসায় ওরা থাকবে অমলিন।

-----২৭ বোশেখ ১৪৩০
----১১---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার



৩৩:
মাটিতে রামধনু ওঠে

সৃষ্টির পরেই যে কোনো শিল্প নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। শিল্প যতক্ষণ কবি বা শিল্পীর কাছে ততক্ষণ সে সঙ্গ পেয়ে থাকে।
পাঠক শ্রোতা দর্শক শিল্পের নিকটে এলে শিল্প নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পায়। সেও তো কিছু সময় জুড়ে। তারপর শিল্পের একাকীত্ব যাপন। লম্বা লম্বা রাস্তা ধরে একা একা হেঁটে যাওয়া।

যখন চিঠির আদান-প্রদান ছিল তখন চিঠিও ছিল একা। চিঠি পড়ার পরেই চিঠি চালান হয়ে যেতো আলমারি কিংবা বাক্সে। অথবা কুলঙ্গিতে। যেন বা নির্বাসন। নিঃসঙ্গতার দিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া।

শিল্প সেও তো অন্ধকারেই থাকে। তাকে না ছুঁলে এগিয়ে আসবে না। যেমন বইয়ের পাতা না ওল্টালে আলো পড়বে না বইয়ের পাতায়।

দৃষ্টি ও মন তার সঙ্গে ভালোবাসা শিল্পকে জিইয়ে রাখে। এবং জিইয়ে রাখার জন্য সঙ্গ দিতে হবে।

শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষ এই সত্যটুকু জানে কি?

-----২৯ বোশেখ ১৪৩০
-----১৩---৫---২০২৩
------নির্মল হালদার



৩৪:
মাটিতে রামধনু ওঠে

কোনো কোনো সকালে কোনো গান থেকে বিষণ্ণতা। হঠাৎ হাওয়ার মত ঢুকে পড়ে মনে। মন থেকে সারা শরীর।

কেঁপে ওঠে সকাল। কান্না থেকে কান্নায়।

কান্নাও নিঃসঙ্গ খুব। একা একা চলে যায় পিছনের রাস্তায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুরা। যে বন্ধুরা আর এগিয়ে আসবে না সামনের দিকে। যে আত্মীয়-স্বজন আর এগিয়ে আসবে না আমার দিকে। শুধু দূর থেকে, পিছনের রাস্তা থেকে দেখবে।

পিছনের রাস্তাতেও অনেক কান্না।

খুব একা।

যেমন মায়েরাও খুব একা হয়। স্বামী সন্তানদের নিয়েও একা। এই দেশের একটি নিভৃত কোণে মায়ের ঠাই।

অন্ধকার মুখ।

একা একা নিঃসঙ্গতার আঁচ বারো মাস পোহাতে থাকে। এই মায়েদের শীত নেই গ্রীষ্ম নেই। এই মায়েদের নীরব একাকিত্বে হাওয়া নেই।

কান্না আছে। একাকী কান্না।

মায়ের পাশে যদি বাবা দাঁড়ায়? মা তার পরেও একা।

মা একা বলেই গর্ভে ধারণ করে বীজ। তার সঙ্গে তার ব্যথা বেদনা আনন্দ। যা খেলা করে অন্তরে। একা একা।

মায়ের স্নেহ ভালোবাসা সর্বত্রগামী। এ কারণেই এখনও এই প্রকৃতির চলাচল।

মা ও প্রকৃতি একইসঙ্গে আমাদের সামনে।

-------১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১৬---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার



৩৫:
মাটিতে রামধনু ওঠে

খুব একা হয়ে গেছে কাঠের লাঙ্গল। খুব নির্জন। যে নির্জনতার কাছে শুশ্রষা নেই।

ওই তো ভাদু মাহাতানের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাঙ্গল। একা। ভাদুর শ্বশুরের আমলে এসেছিল। তারপর অনেকগুলো বর্ষায় চাষ করেছে। এই লাঙ্গল।

আজ লাঙ্গলের ফলায় মরচে।

মন খারাপের মরচে।

কেউ লক্ষ্য করে কি?

বছরে দুবার লাঙ্গলে সিঁদুর দিয়েই লাঙ্গল থেকে মুখ ফেরানো মানুষ, ট্রাক্টরের কাছে নত হয়েছে।

লাঙ্গল আজ একা। খুব একা।

ভাদু মাহাতান কোনো কোনো ভোরে লাঙ্গলের কাছে গোবর মাড়ুলি দেয়। লাঙ্গলের কি এটুকুই প্রাপ্তি? সে যে একদিন মাটি খুঁড়ে সীতাকে নিয়ে এসেছিল। ভুলে যাবে সবাই?

আজ আর কেউ পিছন দিকে তাকায় না, সামনের দিকে এগিয়ে যায় শুধু। সামনে খাল আছে না অন্ধকার চিন্তা করার সময় নেই। ট্রাক্টর এসেছে। অনেক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। তাকেই তো দরকার। অদরকারি হয়ে পড়লো লাঙ্গল।

একা হয়ে পড়লো লাঙ্গল।

কোনো কোনো সংসারে থেকেও নেই। ভাদু মাহাতানের ঘরে থেকেও এক পাশে একা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে তো চেনেই না।

আর কোনোদিন চিনবেও না।

ট্রাক্টর এসেছে।

হৈ হৈ করে ছেলেমেয়েরা ট্রাক্টরে উঠবে। শব্দ করতে করতে এগিয়ে যাবে ধান জমির দিকে। তার ঘন্টা পিছু ভাড়া--হাজার টাকা।

মাটিকে তল উপর করে চাষযোগ্য করে তুলবে জমি।

লাঙ্গলে চাষ করতে হলে গরুও চাই। গরুকে ঘরে রাখার জন্য খরচ ঢের। সাত ঝামেলায় না গিয়ে ভাদু মাহাতানরা ঝুঁকে পড়েছে ট্রাক্টরের দিকে। সময় লাগে কম। একটা লাঙ্গলের সঙ্গে একটা লোক। অনেকটা সময় চলে যায়। খাটুনি তো আছেই। তার চেয়ে সহজ ট্রাক্টর ভাড়া করো। লাঙ্গল পড়ে থাক একা।

লাঙ্গলকে আর কোনো কাজে লাগানো যেত না? চাষীরাই তো এ বিষয়ে নতুন করে ভাববে।

ভাববে না?

------২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
----১৭---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ