মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

ঘর গেরস্থের শিল্প - ৬




ঘর গেরস্থের শিল্প

৬.
গোবর মাড়ুলি

আজও হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে ভোরের দিকে গোবর মাড়ুলি দেখা যায়। দরজার বাইরে। তুলসী তলায় গোবর মাড়ুলি। বিশেষ করে গ্ৰামীণ সমাজে এবং মফস্বল শহরে। কুড়মি সমাজেও গোবর মাড়ুলি দেবার রীতি আছে।

হিন্দু সংস্কৃতি ধারায় আরও যে সমস্ত সম্প্রদায় আছে তারা যেমন গোবর মাড়ুলি দেয় তেমনি হিন্দু সংস্কৃতির বাইরের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও মাড়ুলি দেবার প্রচলন আছে।

এই মাড়ুলি দেবার প্রচলন সম্পর্কে শোনা যায়, যখন দেখা গেল গোহত্যা চলছে দিকে দিকে, তখনকার সেই সমাজের মুখিয়াদের মাথায় হাত----গেল গেল সব গেল। কেন না, গরু কৃষি কাজের উপকারে লাগে। গরুর দুধও উপকারী। এই গরু হত্যা দিন দিন চললে, লুপ্ত হয়ে যাবে গরুর বংশ। তখন গরুকে রক্ষা করার জন্যই শুরু হলো ভগবতীর পূজা। গরু হলো ভগবতী। মায়ের মত। গরুর বিষ্ঠাও উপকারী। চাষবাসের জন্য। অর্থাৎ গোবর হল সার। গোমূত্র এলো পুজোর অনুষ্ঠানেও।

গরুর সবকিছুই হিন্দু বাঙালির ঘরে পবিত্র হয়ে উঠলো। এবং কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যেও। এ কারণেই, ভোরবেলায় দুয়ারে বা উঠোনের মাঝে, তুলসি থানের সামনে গোবর মাড়ুলি কিংবা গোবর ছড়া দিয়ে চারদিক শুদ্ধিকরণ করা হয়।

ঘরের মেয়েরা মাড়ুলি যখন দিচ্ছে তখন যেমন তেমন করে দিচ্ছে না। প্রায় আলপনার মতই আঁকছে একটি গোল বৃত্ত। যেন বা ভোরের প্রথম সূর্য। ঘরে ঘরে এসে গৃহস্থের কল্যাণ করবে।

এই মাড়ুলিও কল্যাণমুখী। এই মাড়ুলিও মেয়েদের হাতে শিল্প হয়ে রচনা করছে সকালের সূচনা।

এই মাড়ুলি প্রসঙ্গে আমার কবি বন্ধু দুর্গা দত্তের একটি কবিতা সবার জন্যেই রাখছি :

মা
-------
মা মাড়ুলি দেয় ভোরের আভায়
সদর দরজার সামনে দোকান দাওয়ায়
জলে ও গোবরে খুব ঘন করে গোল গোল করে
মাড়ুলি দিয়েই চলে শিবথানে আটচালায়
ওলাইচণ্ডীর থানে মনসাতলায়

মায়ের কপাল থেকে সিঁদুরের টিপ
উঠে পড়ে পুবের আকাশে----

প্রতি ভোরে ঠিক ঠিক মাড়ুলি যেমন।

------৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১৫---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার




৭.
মুড়ি

বাঙালির ঘরে ঘরে মুড়িও এক আহার। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়া বাঁকুড়া বীরভূমে। সকালের জলখাবার ------ মুড়ি। মুড়ির সঙ্গে তেল কাঁচা লঙ্কা ও তেলেভাজা।

একসঙ্গে মাখামাখি করে সুস্বাদু জলখাবার। সকাল বেলা।

আমার মাকে দেখেছি, এক থালা মুড়িতে এক গ্লাস জল ঢেলে এক চিমটে নুন মিশিয়ে কাঁচালঙ্কা মুড়িতে ঘষে মায়ের খাওয়া। মা কোনোদিনই তেলেভাজা খেতো না। দিদিদের দেখেছি, তেলেভাজা না পেলে ডাল মেখে মুড়ি খেতে। তখন হয়তো উনুনে চাপানো হয়েছে ডাল।

এ গল্প তো পারিবারিক গল্প। এই গল্পে আর একটু যোগ করতে হয়, আমাদের ঘরেই মুড়ি ভাজার চল ছিল। আমার মা মুড়ি ভাজতো। বড় বৌদিকেও দেখেছি ভাজতে।

সবাই মুড়ি ভাজতে পারে না। মাটির খোলায় বালি দিয়ে মুড়ির চাল ফেলে বাঁশের কুচিতে নাড়াচাড়া করতে করতে ফুটে উঠতো চাল।

কুচি কতটা নাড়াবে কতটা নাড়াবে না এবং খোলার বালি কতটা তেতে থাকবে, জানতে হবে অবশ্যই।

একটা সময় ছিল যখন মহল্লায় মহল্লায় মুড়ি ভাজুনিদের দেখা যেত। ঘরে মুড়ি ভাজার কেউ নেই, ভাজুনিকে ডাকা হলো। সে পারিশ্রমিক পাবে কয়েক সের ধান।

মুড়ি ভাজাও ছিল এক ধরনের জীবিকা। এবং এ কাজ করেছে মহিলারাই। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে মেয়েদের ভূমিকা সবসময় উজ্জ্বল।

দেখার জন্য মন চাই।

মনের দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা যায় মেয়েদের ভূমিকা সন্তান লালন থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে মেয়েরা এগিয়ে। এজন্যে ওদের কোনো মাসমাইনে নেই। কিন্তু পরিশ্রম আছে। তার মূল্য দিতেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অপারগ। এই সমাজের প্রধান দোষ, অর্থ দিয়ে সবকিছুর মাপামাপি করা।

মেয়েদের গুণের পরিমাপ করবে কে? মেয়েরাই তো সন্তান লালন পালন করে। মেয়েদের হাতেই গড়ে ওঠে দিন রাত্রির আহার। এখনও। এই দেশে।

মেয়েদের এড়িয়ে অথবা আড়াল করে ঘর ও বাইরের রাস্তা এগিয়ে যায় না। যাবেও না।

আরেকটা কথা বলতে হয়, আমরা পুরুষ ও মহিলা আলাদা আলাদা করে ভাগ করবো কেন? আমরা বলবো না কেন, মানুষের পাশে মানুষ সৃষ্টি করে নির্মাণ করে প্রেম ভালবাসা থেকে রান্নাবান্না।

হয়তো গ্রামের দিকে দেখা যায় আজও শোনা যায় আজও, মুড়ি ভাজার শব্দ। যদিও এই শব্দ চাপা পড়েছে যন্ত্রের তলায়।

মুড়ি ভাজুনিদেরও দেখা যায় না আজকাল। তাদের খুঁট থেকেও খুলে গেছে পানদোক্তা। পা মাড়িয়ে চলেও গেছে কেউ। শালপাতায় নিজেকে মুড়ে নিজেকে রক্ষা করছে কান্না আর কান্না।

-------৩ আষাঢ় ১৪৩০
-------১৯---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার



৮.
আচার

আচার। আমের আচার করতে হলে, মৌরি গোটা জিরে ধনে শুকনো লঙ্কা, কম পরিমাণে মেথি শুকনো কড়াইয়ে গরম করে কিংবা ভাজা ভাজা করে গুঁড়ো করতে হয়। তার আগে কাঁচা আম সুন্দর করে কেটে, নুন হলুদ মেখে রোদে শুকানো। তার পরের কাজ সর্ষের তেল গরম করে অন্য একটি পাত্রে আলাদা করে রাখতে হবে। তারপর মসলা মাখিয়ে আবার অল্প নুন দিয়ে রোদে শুকানো আম গুলি ফেলে দেওয়া।

এই হলো, তেলের আচার।

মিষ্টি আচার করতে হলে, কম তেল কড়াইয়ে গরম করে শুকানো আমগুলি ফেলে দাও। তারপর দিতে হবে গুড়। আগুনের আঁচে থাকতে থাকতেই মাখামাখি হবে সব একসঙ্গে। এরপর আগুন থেকে নামানো।

এবং প্রতিদিনই রোদে রাখা। হাওয়ার মধ্যে রাখা। যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়ে যায়।

এসব তো কেজো গল্প।

আচার নিয়ে আমারও আছে ছোটবেলার গল্প। আমি তো আর আচার তৈরি করতে যাইনি। যা করেছে যেটুকু করেছে মা।

আমাদের অভাবের সংসারে আচার করতেও ভাবনা চিন্তা করতে হয়েছে। কারণ আর কিছুই না, খরচ হয়। তেলের খরচ গুড়ের খরচ। জোগাড় করতে হয় অথবা দেখতে হয়, গত বছরের কাচের বয়াম এ বছর আছে তো! ভেঙ্গে যায় নি তো!

এই জটিলতার দিকে না গিয়ে আমার দায়িত্ব থাকতো, আচারের বয়াম দিয়ে আসতে হবে রোদে। আমি তখনই মিষ্টি আচার দু-একটি তুলে মুখে নিয়ে ঘরে থাকতাম না। কারো সামনে থাকতাম না, ধরা পড়ে যাব।

যখন তখন বাসি কাপড়ে ছোঁয়া যাবে না আচার। আচারেরও অনেক আচার-নিয়ম। ঘরের ভেতরেও তাকে রাখতে হয় সাবধানে। ধরা ছোঁয়া থেকে দূরত্ব রেখে। তো বলছিলাম, মায়ের আমলে মা সব সময় বলতো, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এলেই বলতো, বাজারে দেখবি রে আম এসেছে তো নিয়ে আসবি। আচার করব একটু।

গ্রীষ্ম পার হলেই শাকসবজির অভাব দেখা যায়। বেড়ে যায় দাম। অথচ ভাতের সঙ্গে একটু টক না হলে মানায় না। পাল্টায় না মুখের স্বাদ। বর্ষার দিনে টমেটো যাকে পুরুলিয়ার সাধারন মানুষ বলে, বিলাতি। বিলাতির দাম হয়ে যায় আগুন ।

ঢেঁড়সের সঙ্গে বিলাতি দিয়েও এক রকমের টক হয়ে থাকে। আজও হয়। শুকনো আবহাওয়াতে টকের প্রয়োজন হয় খুব। কুচো চিংড়ির সঙ্গে বিলাতির টক খেলে জিভে লেগে থাকবে। আর আচার তো বছরে একবার। কুটুমের মত আসে চলেও যায়।

গ্রীষ্মের সময় আচার চাই ।

আমার বাড়িতে আজও আমার মাড়োয়ারি কবি বন্ধু শ্যাম অবিনাশের বাড়ি থেকে আচার আসে। গ্রীষ্ম দিনে।

মাড়োয়ারি পরিবারের আচারের সঙ্গে আমাদের বাঙালি পরিবারের আচারের খুব সামান্য তফাৎ। তাদের আচার বেশি বেশি শুকনো। কারণটা মনে হয়, তারা রুটির সঙ্গে আচার খেয়ে থাকে।

আমার বালক বেলাতে আমি এক বিহারী ঘরে ছোলা পাতার আচার খেয়েছিলাম। এখনো সেই ছোলা পাতা দেখলে আমি পিছন দিকে ফিরে যাই। আমার মনে পড়ে বিহারী পোস্টমাস্টারের কথা।

তাঁর স্নেহ ছিল মিষ্টি আচারের মত।

সেই সমস্ত আচার বাজারে বাজারে পণ্য হয়ে উঠলো। কুলের আচার তো আমরা খেয়েছি। আজও খাই। বাজারে এখন রসুনের আচার বিক্রি হয়। আদার আচার বিক্রি হয়ে থাকে। নানান কিসিমের আচার। বেশ চড়া দাম।

কাছে দাঁড়াতে ভয় করে।

ছোটবেলায় দেখা, আচার তৈরি করার মধ্যেও  অনেক গল্পগাছা এক জায়গায় জড়ো হয়ে,বঁটিতে আম কাটা। আবার আঁশ বঁটি হলে চলবে না।

শুদ্ধতা বজায় রেখে আচার তৈরি করতে হয়। আজও। সেই ঘরের আচার মা কাকিদের তৈরি করা আচার পাওয়া না গেলেও বাজারের দিকে চলো।

মায়ের তৈরি আচারের স্বাদ না পেলেও বাজারের তৈরি করা স্বাদ গ্রাহ্য করতেই হবে। বেঁচে থাকার যে কত আঁকাবাঁকা পথ।

হেঁটে যেতেই হবে।

নান্দনিকতার সঙ্গে দেখা না হলেও হেঁটে যেতেই হবে।

-------৫ আষাঢ় ১৪৩০
------২১---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার




৯.
ঠোঙা

খবরের কাগজ কতজনের ঘরে আর থাকতো! খবর পড়ার ও খবর শোনার মত আগ্রহ কতজনের ছিল?

আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে না কিছুই।

তুলিনের দিদি বাড়িতে আনন্দবাজার দেখেছি। প্রতিদিন। বাসি কাগজ। পড়ার অভ্যেস হয়ে গেছলো। আমি পাতা উল্টে বিনোদনের পাতা অথবা সিনেমার পাতা দেখতাম। সেই খবরের কাগজ বাড়িতেও দেখেছি। ছোটবেলায়। ছোড়দি বাদে বাকি তিন দিদি ঠোঙা করতো। নিয়মিত। শুনেছি, তাদের বিয়ের জন্যেই  তারা বাবাকে সাহায্য করবে। ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি ক'রে। কেননা, বিয়েতে বাবাকে দিতে হবে পণ।

বিকেল না হতে হতেই, দিদিরা ঠোঙা করতে বসতো। আমার আবছা মনে পড়ে, ঠোঙা করতে করতে কোনো দিদি ঘুমে ঢলে পড়ছে।

ঠোঙা করার আগে একটা পুরনো পাত্রে ময়দার চিট ( আঠা) তৈরি করতো রান্না শেষের উনুনের আঁচে।

আমরা ছোটরা ঠোঙা করার বাতিল কাগজ নিয়ে ঘুড়ি বানিয়েছি কত। আমাদেরও প্রয়োজন পড়তো চিট। কাগজের সঙ্গে কাগজ জুড়তে হবে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরেই , দিদিরা মেঝেতে খবরের কাগজ পেড়ে সাইজ করে কাটতো। একদিকে ছোট ও মাঝারি ঠোঙা আর আরেক দিকে বড়ো ঠোঙা। মোট তিন রকমের ঠোঙা।

তিন চার দিনে গাদা গাদা ঠোঙা জমে উঠতো। চিট শুকানোর পরে ঠোঙা সাজানো। বেঁধে ফেলা। এর পরে বিক্রি। অনেকেই ঘর থেকে কিনে নিয়ে যেত।

খবরের কাগজের ঠোঙার পাশাপাশি আটা বিক্রি করা হবে এমন ঠোঙাও তৈরি করতো দিদিরা। কোনো আটা কলের মাড়োয়ারি মালিকের অর্ডার।

ঠোঙা সাপ্লাই করলেই মজুরির টাকা।

সেই আটকল থেকে অনেকদিন মাথায় করে কাগজ নিয়ে এসেছি। বিশেষ এক কাগজ। মাটি মাটি রঙ। মালিকের কাগজ, দিদিরা বানালে মজুরি পাবে।

আমাদের পরিবারে শুধু নয় অনেক পরিবারেই ঠোঙার কাজ। এবং ঠোঙা বিক্রি থেকে দু চার পয়সা রোজগার। সংসারের মুখে আলো জ্বালানো।

সেও তো মেয়েরাই করতো।

কোনো কালেই ঘরে বসে থাকেনি মেয়েরা। কোনো না কোনো কাজ করে সংসারের সূরাহা করেছে। এ কথা লেখা হয়নি কোথাও।

ঘরে ঘরে নিঃশব্দে কুটির শিল্পের কাজে মেয়েরা এগিয়ে ছিল। এগিয়ে আছে আজও। সমাজের চোখে পড়ে না ব'লে, লেখা হয় না ইতিহাস। ঠোঙা বড়ি আচার মেয়েরাই করে এসেছে চিরকাল। এখন, প্লাস্টিক এসে খেয়ে ফেলেছে ঠোঙার কদর। যে প্লাস্টিক ক্ষতি করছে মাটির। প্লাস্টিক তো পচেও না। তা থেকে জন্মায় না কোনো কিছু।

মাঝেমধ্যে রব ওঠে-----প্লাস্টিক বর্জন করো। দোকানদারদের সাবধান করে প্রশাসন থেকে, প্লাস্টিক ব্যবহার করলে জেল জরিমানা ফাইন। দুদিন চুপচাপ।
তারপর আবার, প্লাস্টিক প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের মতো দানব ছেয়ে ফেলেছে বাজার হাট গ্রাম শহর।

এদিকে ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি ক'রে যে সমস্ত পরিবারে আধ বা এক সের চাল আসতো, তাদের অভাব আরো বেড়ে গেল।

বড় বড় শহরের শপিংমলে কাগজের ব্যাগ দেখা যায়। সুদৃশ্য। সে তো কল থেকে তৈরি হয়ে আসছে। মেয়েদের হাতের তৈরি ঠোঙা, আমি বলবো শিল্প। একেবারেই লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে। তাকে উদ্ধার করার মত কে এগিয়ে আসবে? কারা এগিয়ে আসবে?

ঠোঙাও তো আমাদের গরীব বাংলায় কুটির শিল্প। যা যন্ত্রের তলায় পড়ে, রক্তাক্ত। এদিক-ওদিক যে দু'চারটে ঠোঙা বেঁচে আছে, তারা উড়ছেতো উড়ছেই। আমি তাদের গায়ে দেখতে পাই, বাংলার অসংখ্য দিদি ও বোনের আঙুলের দাগ।

--------৬ আষাঢ় ১৪৩০
--------২২---৬---২০২৩
---------নির্মল হালদার



১০.
কাজললতা ও কাজল

কাজলের মতো একটি প্রসাধন সামগ্রী মেয়েরা নিজেরাই তৈরি করতো ঘরে। গল্পকথা নয়, বাস্তব। সেই সময়ের বাস্তব। ঘিয়ের প্রদীপ শিখা থেকে যে কালি হয়, সেই কালি কাজললতার পাতায় ধরে কাজল তৈরি। যে সমস্ত ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ ছিল না, সেখানে লম্ফর শিখা থেকে হ্যারিকেনের শিখা থেকে মেয়েরা কালি ধরে রাখতো কাজললতায়।

কাজল তো শুধু মেয়েরা পরতো না, শিশুদের চোখেও পরানো হতো কাজল। তাদের কপালেও কাজলের একটা টিপ। শিশুদের কপালে ওই টিপ থাকলে কারোর কুনজর পড়বে না। এই সংস্কার এখনো আছে। তবে সেই কাজল নেই। তার বদলে আই ভ্রু পেন্সিল। যা বাজারের একটি সামগ্ৰী। কাজললতাও উঠে গেল।

মাছের আকারে ছোট ছোট কাজললতা কামার শালে তৈরি হয়ে হাটে বাজারে বিক্রি ।

একটা শিল্পের সঙ্গে আরেকটা শিল্প জড়িয়ে শিল্পের সুষমা। মেয়েদের প্রসাধনে বেঁচে বর্তে ছিল। আজ কামার শালের হাপর ওঠানামা করে না। কাজললতাও নেই। ছোট ছোট লোহার কাজললতা দরজায় ঝুলতে ঝুলতে মেয়েদের চোখের শিশুদের চোখের কামনা করতো শুশ্রুষা।

কাজললতাও মাঙ্গলিক এক রূপ।

বিয়ের সময় আজও মেয়েদের হাতে থাকে কাজললতা।

ফিঙে পাখি পুরুলিয়াতে কাজললতা পাখি। কারণ, ফিঙে পাখির লেজটি কাজললতার মতো। গায়ের রঙও ঘন কালো।

ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট শিল্প। কুটির শিল্প। কামার কুমোররা ছিল তার কারিগর। তারা আজ কাজ হারিয়ে বেকার। আমাদের সমাজ তাদের দিতে পারেনি বিকল্প কোনো কাজ। 

সময়ের ঝাপটায় পাল্টে যেতে যেতে শোনা যায় বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নিঃশব্দ চিৎকার। 

ঘিয়ের প্রদীপ শিখার তলায় কাজল পাড়ছে এক মা। একটি মেয়ে। এই ছবি ধ্বসে যাওয়ার পরেও একটি লম্ফ শিখার কালি এখনো আকাশের দিকে লতিয়ে লতিয়ে উঠছে। এই আমাদের ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপ। সেই রূপের কাছে কাজললতা নেই। 

শিল্পের নামে প্রসাধনের নামে কোম্পানির প্রোডাক্ট গুলি বিকৃত করছে দূষিত করছে শরীর ও ত্বক। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার নামে লুট করছে গরিব দেশের টাকা। চাপা পড়ে গেছে শিশুর কান্নার কাছে মায়ের গান:

আয় চাঁদ মামা আয়রে  
আমার সোনার কপালে টিপ দিয়ে যা----

------৭ আষাঢ় ১৪৩০
------২৩---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ