মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

ঘর গেরস্থের শিল্প - ১১




১১:
ঘর গেরস্থের শিল্প

শাঁখা চাই -----শাঁখা চাই----
এই মহল্লা থেকে ওই মহল্লা----
শাঁখা চাই ---- শাঁখা চাই -----

রোদ পড়ে যাওয়া বেলাতে শাঁখারিদের হাঁক----মহল্লা থেকে মহল্লা।

লাজ দুয়ারের দরজা খুলে উঁকি দেয় ছোট বউ। জানলা খুলে উঁকি দেয় সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি। শাঁখারি দাঁড়িয়ে গেছে। মনে হয়েছে তার, ঘরের ভিতরে কেউ ডাকছে। কেউ কেউ শাঁখা পরবে।

ধূতি ও কামিজ পরা শাঁখারির মুখে আলগা হাসি। সে ঘর ভিতরে ঢুকে উঠোনে বসে পড়ে। ঘরের বউ ও অন্যান্যরা একে একে জড়ো হয়। শাঁখারিও তার টিনের বাক্স খুলে দেখাতে থাকে শাঁখা। দেখাতে দেখাতে সেও নিজের ঘরের গল্প করে। তিনটে মেয়ে ছিল, এখনো বিয়ে দিতে বাকি একটি মেয়ের। পণের টাকা কোথায় কিভাবে কার কাছে পাবে, শাঁখারি দুশ্চিন্তার কথা বলে। বলতে বলতেই, শাঁখা পরায় মেয়েদের কোমল হাতে। তারই মাঝে কোনো বউ কোনো গোপন কথা থেকে হেসে উঠে, আরেক বউয়ের গায়ে পড়ে।

শাঁখারির জল তেষ্টা পেলে এক গ্লাস জল খোঁজে মেয়েদের কাছে। কোনো কোনো ঘরে শাঁখারির জুটে যায় এক কাপ চা।

এই তো ছিল একসময়ের গ্রাম বাংলার ছবি। এই ছবি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হয়ে ধূসর হয়ে গেছে।

শাদা শাদা শাঁখা গুলি রয়ে গেছে আজও। গ্রাম বাংলার মেয়েদের হাতে। এখানে প্রশ্ন---শাঁখারিরা কোথায় গেল? যারা নিজেদের ঘরে নিজেরাই তৈরি করত শাঁখা। নিজেরাই গড়ে তুলেছিল কুটির শিল্প। শাঁখার গঠন শাঁখার সৌন্দর্য সেই কারিগরের দল জানতো বলেই শিল্পকেও এক রকম জেনেছিল তারা।

সেই শাঁখারিরা বিকল্প কাজ খুঁজে পেয়েছে কি?

আজও গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে দারিদ্র ও অসহায়তা থাকার পরেও মেয়েরা পরবেই শাঁখা। সেই শাঁখা গুলি তাই চাঁদের শুভ্রতার সঙ্গে থাকে।

-------৭ আষাঢ় ১৪৩০
-------২৪---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার



১২.
চন্দন পিঁড়ি

গন্ধ আসছে। শরীর ও মন হয়ে উঠছে পবিত্র। ঘরের ভিতরে ঢুকে টের পাই , গন্ধটা হলো চন্দনের গন্ধ। কিন্তু এই ঘরটা তো ঠাকুর ঘর নয়। এই ঘরটা বসার ঘর। বৈঠকখানা।

তবে কি ভেতর ঘর থেকে গন্ধটা আসছে? ভেতর ঘরে কেনই বা, চন্দনের গন্ধ?

আমার মনে পড়তে লাগলো, শ্বেত শুভ্র চন্দন বাটা। ঠাকুর ঘরে পুজো করছে মা। সকাল বেলা। মনে পড়তে লাগলো, আমার সঙ্গে চন্দনের সম্পর্ক ছিল বছরে দুবার। একবার ভাই ফোঁটার সময়। আরেকবার পরীক্ষা চলাকালীন। কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলে মাথা ঠান্ডা থাকে। ভালো হয় পরীক্ষা। এ বাদে চন্দনকে আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, বিয়ের কনের কপালে চন্দনের ফোঁটায় সাজাতে।

গ্রীষ্মকালে গায়ে হাতে ঘামফোঁড়া হলে চন্দনের প্রলেপ। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।

এ সমস্ত কারণেই, পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে চন্দন পিঁড়ি সবার ঘরে ঘরে। মনে পড়ছে, ঘষতে ঘষতে চন্দন ক্ষয়ে গেলে মা অনেককে বলতো, একটা চন্দন কাঠ নিয়ে আসবি রে। পূজা করতে পারছি না।

গৃহস্থ ঘরে যা যা প্রয়োজন হয়ে থাকে, তার মধ্যে চন্দন কাঠ ও চন্দন পিঁড়ি অবশ্যই থাকবে। শিল্প হয়েই থাকবে। যে শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল মানব সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে। যা আজও ধারাবাহিক। মানুষের মঙ্গলে।

ঠাকুর ঘরে দেবদেবীর সঙ্গে শান্ত হয়ে থাকে চন্দন পিঁড়ি ও চন্দন কাঠ।

চন্দনের গন্ধ শিল্পের সুবাস। আবহমান। এইতো সেদিন পুরুলিয়ার মাঠাতে চন্দন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে নত হয়ে গেলাম। মনে মনে।

জানতে চাইছিলাম, যুগ যুগ ধরে এই সুগন্ধ কে পাঠায়? জানতে চাইছিলাম, এই সুগন্ধ কি স্বর্গ থেকে আসছে?

নিরুত্তর চন্দন গাছ থেকে দু একটি পাতা খসে পড়ল আমার মাথায়।

------১০ আষাঢ় ১৪৩০
------২৬---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার


১৩:
ঘর গেরস্থের শিল্প

কুমোরের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হাঁড়ি-কলসি। এক তাল দু তাল তিন তাল মাটি কুমোরের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী গড়ে ওঠে।

হাঁড়ি--কলসির পাশাপাশি গড়ে ওঠে প্রদীপ। পিলসুজ। কুমোরের কুটির শিল্প সংসার জীবনে হয়ে ওঠে গেরস্থের শিল্প।

এই শিল্প আলো করে তুলসি থান।

দেবদেবীর কাছেও প্রদীপ জ্বলে।

আর আমি দেখতে পাই, প্রদীপের আলোয় একটি ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনা করছে। আমি দেখতে পাই, রাস্তা হারিয়ে একটি ছেলে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে জ্বলছে একটি প্রদীপ।

একাকী প্রদীপ।

প্রদীপের নিঃশব্দ শিখায় আবছা হলেও দেখা যায়, ফাটা দেওয়ালের গায়ে পাঁচটা আঙুলের চিহ্ন।

সামনে খুব সামনে না গেলে দেখা যাবে না স্পষ্ট হবে না, প্রদীপটি পেতলের না মাটির।

কোনো একদিন প্রদীপ ও পিলসুজ ছিল পেতলের। সন্ধ্যে দেবার আগে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতো ঘরের কোনো মেয়ে।

অর্থনীতির টালমাটালে অনেক কিছুর রূপ পাল্টে গেছে। কুটির শিল্প যেটুকু আছে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষের দিকে।

গ্রাম জীবনের সংসারে মাটির প্রদীপের চাহিদা বেশি। গরাম থান থেকে তুলসি থানে মাটির প্রদীপ জ্বলে।

পিলসুজও মাটির। পিলসুজের উপরে থেকেই প্রদীপ তার শিখা ঊর্ধ্বমুখী করে।

ঊর্ধ্বে কে আছে?

শিল্পের দেবদেবী কোথায় থাকেন?

প্রদীপের রূপ মাতৃমুখী।

মাতৃমুখী আলো থেকেই শিল্পের আগুন। ঘর গেরস্থে অনির্বাণ। প্রদীপের মুখে। প্রদীপ শিল্পী কুমোর মাটি মাখতে মাখতে মঙ্গল কামনা করে এই সংসারের।

প্রদীপ জ্বলবেই সংসারে।

--------১১ আষাঢ় ১৪৩০
--------২৭---৬----২০২৩
---------নির্মল হালদার




১৪.
জাঁতি


জাঁতিও পরিবারের একটি অঙ্গ। পানের বাটার সঙ্গে থাকবে। বরের সঙ্গেও থাকবে বিয়ের সময়।

জাঁতি বরের সঙ্গে। কনের সঙ্গে কাজললতা।

জাঁতি ও কাজল কিসের প্রতীক না জানা থাকলেও বলতে পারি, বাঙালি বিবাহে যখন থাকছে, তখন তা মাঙ্গলিক।

জাঁতি পরিবারের একটি অঙ্গ।

এক সময় তো ছিলই, পানের বাটা থাকলে জাঁতি থাকবেই। জাঁতি যে সুপারি কুচি কুচি করে।

পান রসসিক্ত হয়ে ওঠে চুন সুপারি খয়েরের মিশ্রণে। লাল হয়েও ওঠে। সে এক অন্য কথা, এখন কথা জাঁতি সম্পর্কে। একসময় রূপোর জাঁতিও দেখা যেত। ব্যবহার না হলেও ঘরের অলংকার হিসেবে একটি শোভা। এবং তার অনেক রূপ। কর্মকারদের মতো কারিগররাও লোহার জাঁতি তৈরি করেছে। এই জাঁতি যেন পরিবারের ছোট ছোট দুঃখ-বেদনা গুলি সুপারির মতো কাটে। এক সময় কেটেওছে। আমরা পেয়েছি, জাঁতির মত এক শিল্প। আজ হারিয়ে যাওয়ার মুখে জাঁতিকেও মনে পড়ে বৈকি।

জাঁতির গায়েও লেগে আছে চুনের দাগের মতো অথবা পানের লাল দাগের মতো আবছা অভিমান।

যে অভিমানের রঙ বয়ে বেড়াতো মা ঠাকুমা। জেঠি খুড়ি। মাসি পিসিরা।

শিল্পে যতই ঠাঁট-ঠমক আসুক,কুটির শিল্পের গরিমা পেতল কাঁসা লোহা থেকেও প্রকাশ পেয়েছে। ঘরে ঘরে। তা রক্ষা হলে, শিল্পী বা কারিগররাও রক্ষা পাবে বলেই মনে করি।

--------১২ আষাঢ় ১৪৩০
--------২৮---৬----২০২৩
---------নির্মল হালদার



১৫.
শিলনোড়া

বেলা বারোটা বাজতে বাজতেই সবাই খিদে খিদে করে। কাক এসে ডাকে। পায়রা এসে ডাকে। দুয়ারে কুকুর এসে দাঁড়ায়। রান্নাঘর থেকে হাতা খুন্তির শব্দ শোনা যায়। কড়াইয়ে তেল পড়লেও শব্দ শোনা যায়। শিল--নোড়া থেকেও শব্দ আসে।

শিল--নোড়া সংসারের অতি প্রয়োজনীয় কাজের সামগ্রী। সংসারে কবে এসেছিল কেউ মনে করতে পারে না। একসঙ্গে এসেছিল একসঙ্গেই আছে। শিলের সঙ্গে নোড়া, যুগলবন্দী এক রূপ।

বাটাবাটির শব্দ হলেই, মেয়েদের হাতে চুড়ির রুনুঝুনু। যেকোনো মসলা বাটার সঙ্গে শিল ধোওয়া জল। শাঁখা-চুড়ি ধোওয়া জল।

যেকোনো রান্নাকেই সুস্বাদু করে।

হিন্দু বাঙালি পরিবারে অরন্ধনের দিন শিল-নোড়াকে শান্ত রাখা হয়। লাল পাড়ের শাড়ি পরিয়ে অঞ্জলি দেওয়া হয়ে থাকে।

উনুন ও শিল-নোড়াকে মা ষষ্ঠী রূপে দেখা হয়। বাঙালি ঘরের ধারাবাহিক এই লৌকিক পূজার্চনার ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে আছে ব্যথা বেদনার ও আনন্দের প্রতীকি ব্যঞ্জনা। যা শিল্প হয়ে উঠেছে।

শিল্প তো সেই, ঘর থেকে বাইরে বৃত্তকে করে বৃহৎ। এখানে শিল-নোড়ার ভূমিকাও পরিবারের সদস্যের মতোই। সঙ্গে সঙ্গে আছে।

আমরা মনে করতেই পারি, সভ্যতার শুরুতে পাথরে পাথরে ঘর্ষণ। জ্বলে উঠেছিল আগুন।

শিকড় -বাকড় বাটার জন্যে মানুষ সাহায্য নিয়েছিল পাথরের। হয়ত পাহাড় থেকে গড়ানো পাথর শিল-নোড়ার কাজ করেছিল।

যা ধারাবাহিক শিল্প রচনা।

------ ১৪ আষাঢ় ১৪৩০
------৩০--৬--২০২৩
------নির্মল হালদার






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ