বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

পাহাড়ের গল্প / নির্মল হালদার

পাহাড়ের গল্প / নির্মল হালদার


রোজ পাহাড়ের কাছে সে এসে দাঁড়ায়। সকালবেলা। সে অর্থাৎ বাপি মনে করে পাহাড়টা তার আপনজন। তার দাদুও প্রতিদিন পাহাড়ের কাছে এসে পাহাড়ের দেখভাল করতো। যেন কেউ পাহাড়ের গায়ে আঘাত না করে। যেন পাহাড়ের গাছপালা পাহাড়েই অক্ষত থাকে।

দাদুর মত বাপিও পাহাড়ের কাছে এসে পাহাড়ের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে-----কেমন আছো? আর কোনো বন্ধু এসেছিল তোমার কাছে? আজ?
কী বলছিল?
বাপির মনে হয় পাহাড়টা নড়েচড়ে বলে-----আজ কেউ আসেনি। তবে কাল রাতে শিশির পড়েছে খুব। ঠান্ডা লাগছিল। বাপি তার কথার উত্তরে বলে------ দাঁড়াও দাঁড়াও আরো গাছ লাগাবো। তাহলে শিশির আটকানো যাবে। নিশ্চয়ই গাছ হবে তোমার গায়ে ।
আগেও তো হয়েছে। কিন্তু গাছপালা বেশি নেই বলে, শিশিরের ছ্যাঁকা লাগছে।

বাপি কখনো কখনো সন্ধের দিকে যায়। সন্ধের অন্ধকার পাহাড়কে আরো রহস্যময় করে তোলে। যেন ধ্যানী এক মহামানব। অথবা এক শক্তি। বাপির গা ছমছম করে। সে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে সাহস পায় না। তার মনে হয় , যদি ধ্যান ভেঙ্গে যায়? যদি ক্রোধের সৃষ্টি হয়? এবং ক্রোধ থেকে আগুনের সৃষ্টি হয়? ক্ষতি হয়ে যাবে চারপাশের।

বাপি  পাহাড়ের দিকে চেয়ে ঘরে ফিরে আসে। ঘুমোতে গিয়েও বাপির মন ছটফট করে পাহাড়ের জন্য।কেবলই মনে হয়, পাহাড়টা যদি ছোট হয়ে যায়? সেও ছোট হয়ে যাবে। পাহাড়টা যদি ছোট হয়ে যায়?আকাশটা ছোট হয়ে যাবে। একবার মাঝরাত্রে তার মনে হলো কেউ চুরি করতে এসেছে পাহাড়ের পাথর। সে ঘুম থেকে উঠে দৌড়োতে দৌড়েতে পাহাড় কোলে পৌঁছে যায়। কেন না, পাথর হলো পাহাড়ের হৃৎপিণ্ড।
পাথর হলো পাহাড়ের শরীর। পাহাড়ের মন।

এক একটা পাথর পাহাড়-শরীরের একেকটা অংশ। কোনো ভাবেই পাথর চুরি করতে দেওয়া হবে না। পাথর কাটা চলবে না।

পাহাড়ের গায়ে যত গাছ আছে পাহাড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। পাহাড়ের নিঃশ্বাস গাছের গায়ে গায়ে বইতে থাকে। গাছের নিঃশ্বাস পাহাড়ের গায়ে গায়ে বইতে থাকে।

পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমলে পাহাড়কে আরও সুন্দর লাগে। গাছপালা হলো পাহাড়ের প্রেম। মেঘ হলো পাহাড়ের প্রেম।

বাপি লক্ষ্য করলো, ইদানিং পাহাড়কে খুব করুণ লাগছে। কারণটা সে বুঝতে না পেরে, পাহাড়ের চারদিকে ঘুরতে থাকে। তারপরেই চোখে পড়লো, পাহাড়ের পায়ের তলার দিকটা ছিন্নভিন্ন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লো। তার চিন্তা পাহাড়কে কীভাবে রক্ষা করবে?

যদি গ্রামের লোককে বলে, পাহাড় বাঁচাও, শুনবে কি? যদি  গ্রামের লোককে বলে-----পাহাড় আমাদের চৌদ্দপুরুষের। সবাই শুনবে কি?

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে বাপি গ্রামের কোনো কোনো যুবককে তার ভয়ের কথা বলে। বিশেষ করে বাপির যারা বন্ধু। কথাগুলো শুনলেও কেউ কোনো
সমাধানের পথ বাৎলায়না। একজন তো বললো, পাহাড়টা আমার বাপের নয়। পাহাড়কে নিয়ে যে যা ইচ্ছে করুক গে।

বাপির মুখে বিষণ্ণ ছায়া।

সে এইবার কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে পাহাড় তলে
পলাশ গাছ লাগাতে শুরু করলো। সে দিনে রাতে দেখতে চায় কারা আসছে পাহাড় ভাঙতে। এবং সে একা একা পাহাড় কোলেই রাত্রিবেলা ঘুমোয়। কারণ, বাপি পাহারায় থাকতে চায়।

সে একদিন স্বপ্নে দেখতে পেলো অনেক ট্রাক্টর এসেছে। অনেক লরি এসেছে। পাহাড় কাটার যন্ত্র
এসেছে। সে চিৎকার করেও কাউকে আটকাতে পারছে না। সে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে পাহাড়ের নীচে শুয়ে পড়েছে। সে বলছেও-----আমাকে আগে মারো তারপর পাহাড়কে আঘাত করবে।

তার ঘুম ভেঙে গেল।

ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই বাপি তার কাঁধে ওঠায় পাহাড়টাকে। তার আদরের পাহাড় ভালোবাসার পাহাড় তাদের ঘরেই থাকবে।


-----২৫ শ্রাবণ ১৪২৮
-----১১---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ