মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

আমার প্রথম কবিতার বই / নির্মল হালদার

আমার প্রথম কবিতার বই / নির্মল হালদার


তখন আমি আর সৈকত শহরে গ্রামে উড়ে বেড়াই। আমাদের পাগলপারা জীবন। তখন সারাদিন টই টই করছি। তখন সারাদিন কাব্য কবিতা। তখন রাস্তা থেকে শাদা কাগজ কুড়িয়ে কবিতা লিখছি। তখন মধ্যরাত্রির কালী মন্দিরে ঢুকে কবিতা পাঠ করছি।
মন্দিরে শুয়ে থাকা ঘুমিয়ে থাকা ভিখারিদের ঘুম ভেঙে যেতো। হয়তো বা আমাদের শাপ শাপান্ত করেছে। আমরা গ্রাহ্য করিনি। আমরা শুধু কবিতার ঘোরে কাটিয়ে গেছি আমাদের যৌবন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ অনেকগুলো বছর আমাদের কবিতা পাগলামি কিংবা সাহিত্য পাগলামি রাস্তায় রাস্তায়। অন্ধকার গলিতে। চায়ের দোকানে। অযোধ্যা পাহাড়ে। মাঠার জঙ্গলে। ধারাবাহিক চলছেতো চলছেই।কোনো বিরাম নেই। সঙ্গে আছে আমাদের পত্রিকা "আমরা সত্তরের যীশু"। যা বাসে উঠে গান গাইতে গাইতে যাত্রীদের বিক্রি করেছি। যা তিন টাকা দাম, দশ টাকায় বিক্রি করেছি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের। বিক্রি করেছি শহরের মোড়ে মোড়ে। গান গেয়ে গেয়ে। এবং স্ট্রীট কর্নারে কবিতা পড়েছি। কবিতার প্রদর্শনী আমাদের উদ্যোগে শহরের সদর রাস্তায়।

এইসব উন্মাদনার মাঝে হঠাৎ খেয়াল হয়েছে আমাদের দুজনেরই বই নেই। এবং বই করতে হলে টাকা লাগবে। টাকা নেই। ঘর থেকে তো বই প্রকাশ করার জন্য টাকা দেবে না।

দুজনেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। দুজনেই উড়ে বেড়াই। কোথাও কোনো অর্থের সংস্থান নেই। তো, সৈকত পরিকল্পনা করলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের।

পুরুলিয়ার রবীন্দ্রভবনে তিনদিনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তখন রবীন্দ্রভবনে চেয়ার ছিল না। সাউন্ড ছিল অত্যন্ত খারাপ। সৈকত কলকাতা থেকে সমস্ত আয়োজন করলো।

অফিসে অফিসে টিকিট বিক্রি করলাম আমরা। রিকশা নিয়ে প্রচার করলাম আমরা। তখন আমাদের শুভাকাঙ্খীরা আমাদের সহযোগিতা করেছিল খুব।

সেই প্রথম পুরুলিয়া শহরে ফিল্ম ফেষ্টিভ্যাল।
এইবার টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ টাকা থেকে দেখলাম দুজনের বই হয়ে যাবে।

প্রকাশক কে হবে?

তখন আমাদের কাছের বন্ধু কবি বন্ধু সুজিত সরকার শোণপাংশু নামে একটি পত্রিকা করছে। তাকেই বললাম, প্রকাশক হতে।


আমি তখন কবিতা লিখেছি খুব অল্প। একটা চার ফর্মার বই হবে না। মনে পড়ছে, একদিন কালী মন্দিরে বসে আমি আর সৈকত দুজনে আমার কবিতার ঝাড়াই-বাছাই করলাম। দেখা গেল একটি দু ফর্মার বই হবে। তাই হোক। দুজন মিলেই ঠিক করলাম বইয়ের নামকরণ-----"অস্ত্রের নীরবতা"।

ছাপাছাপির কাজ কলকাতায়। মলাট এঁকে দিলেন কবি ও শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী। বইয়ের সব কাজ
দেখভাল করেছিল সৈকত নিজে। আমার কাব্য গ্রন্থের পাশাপাশি সৈকতের গল্পের বই "আরাম চেয়ার" প্রকাশিত হয়েছিল।

সেই তখন বই উদ্বোধনের এত আলো এত ক্যামেরা সুসজ্জিত মহল ছিল না। সৈকতের ইচ্ছে হলো
আমাদের বই উদ্বোধন হবে, শ্মশানে।

কলকাতা থেকে বই চলে এলো। বই উদ্বোধনের দিন স্থির হয়ে গেল। নির্দিষ্ট তারিখে কবি অশোক দত্ত কে সঙ্গে নিয়ে আমরা চললাম শ্মশানে। তখন আমরা কোনো নেশা করতাম না। রাতের আহার টুকু করে তিনজন শ্মশানের স্তব্ধতায় উন্মোচন করলাম আমাদের প্রথম বই। কবিতার পর কবিতা পড়া। গল্প পড়া। আলোচনা।

কে জানে আমাদের কবিতা পাঠ আমাদের আলোচনা মা কালী শুনতে পেয়েছিলেন কিনা। তবে বলতে পারি, আমাদের সেই উন্মাদনা আমরা রেখে এসেছিলাম শ্মশানের নিস্তব্ধতায়।

নতুন বইয়ের গন্ধ। আমাদের যৌবনের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের ভবিষ্যৎ সবই রেখে এসেছিলাম।

ভোরের আগেই অন্ধকার থাকতে-থাকতে সোজা কবি মুকুল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি----চা চাই।

এইতো আমাদের প্রথম বইয়ের গল্প। সেই যৌবনের দিন। সেই দিন রাত্রি সমান করে আমাদের পথ চলা। আর অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে কেবলই, কবিতা কবিতা।

তখন ভেতরে বাইরে আমাদের নান্দনিক সাজ। এখনও ভেতরে বাইরে আমাদের কাব্য উন্মাদনা।

-----২৪ শ্রাবণ ১৪২৮
-----১০---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ