বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার






পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার


৩৭.
একটা নদী
ফসলের ক্ষেত
ঘাস জমিও আছে
ঘাস বীজ ও আছে

ছোট-বড় পলাশ গাছ
পোকামাকড়ের সংসার
কুল গাছে লাক্ষার ফলন
হাওয়া ওড়াউড়ি করে

শালপাতা তুলছে একজন
নিমকাঠি খুঁজছে একজন
সাইকেল নামছে নদীতে
বস্তা বস্তা বালি

দূরের মন্দিরে ঘন্টা বাজলো
নদীর পারে পোড়া কাঠ
শুঁকে বেড়ায় কুকুর
মোষের পিঠে রোদ হাসছে

কেটে যাচ্ছে কুয়াশা
স্পষ্ট হয়ে যায় পাহাড়ের রেখা
আকাশ ও আস্তে আস্তে নিকটে
মুখ দেখবে জলে

এইতো শুরু
শেষের খেলা কখন কে জানে?


--------৮ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৫----৮----২০২১



৩৮.
একটা মেয়ে
একটা রাস্তা
পথিকের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা নিশ্বাস
মেঘের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা রঙ
বাতাসের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা সূর্য
রোদের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা দিন
ধুলোর চলাচল


একটা মেয়ের মাটিতেই পা।



৩৯.
নাপিত বউ এসেছে গো নাপিত বউ
কে নখ কাটবে এসো কে আলতা পরবে পরো

আজ বুধবার নাপিত বউয়ের দিন

নখ কাটতে কাটতে সেজ বউ বলবে, ও দিদি
নরুণে ধার নাই। মেজ বউ বলবে,
ঝামা ইঁটে ঘষবে গোড়ালি।আর
বড় বউ আলতা বাটির দিকে
পা বাড়িয়ে দিলেই, ঘরের কুল গাছটাও
বাড়িয়ে দেবে পা

আলতা পরবে।


----৯ ভাদ্র ১৪২৮
----২৬----৮----২০২১



৪০.
নিমতল থেকেই কান্নাটা আসছে
কে এলোরে কে এলো?
নিমতল থেকেই কান্নাটা আসছে
কে জন্মালো?

নবজাতকের চোখের জল
এক--একটি ফল।



৪১.
সন্ধ্যার রঙ
জোনাকির টুপটাপ
ঝিঁঝিঁ পোকা
নির্জনতা

কে কথা বলবে বলো?

আকাশেও ফুল
সৌরভের আলো
নিস্তব্ধ মাটি
গাছপালা অস্পষ্ট

কে কথা বলবে বলো?

দূরে দূরে গ্রাম
অন্ধকারের নীরবতা
ছায়ার কাঁপন
হিম পড়ছে

কে কথা বলবে বলো?

বাঁশবনের ঝর ঝর
শিয়াল দৌড়ে আসে
পোকা উড়ছে
রাত চরার ডাক

আমার কথা নেই একটিও


-----১০ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৭----৮---২০২১



৪২.
উঁচু জমির জল নিচু জমিতে।
জলের সঙ্গে পুঁটি ও মৌরলা।
মেঘ আসে মেঘ যায়।
রৌদ্র ছায়া।

গাছ তলে থেৎলে গেছে তাল।
মাছির ভনভনানি।
পিঁপড়ের অসংখ্য ডিম।
শুকনো গোবর।

খেজুর পাতা থেকেও জল পড়ছে।
মাঠে-মাঠে চোরকাঁটা।
মাথায় হাঁড়ি চলেছে রাস্তায়।
টিউ কল ভাঙ্গা।

ধানক্ষেতের আল ভেঙ্গেও গেছে।
ধান গাছের মাথায় ভাদুরে হাওয়া।
নদী জলে ঝাঁপ মারে বালক।
কাদা মাখছে শিশুরা।

আমি তো ধুলাও মাখি না।



৪৩.
নুন লঙ্কা হলুদ-তেল বিক্রি করতে করতে
ভুলে যায় না, লোকটার চারটে বিটি। চারটে বেটা।
একটা বিটিরও বিয়া দিতে পারে নাই। মানুষ হলো না একটা বেটাও। ছোটটা এত ছোট
শুধু কাঁদে, কাজ করতে দেয় না ওর মাকে।

আনমনা হয়ে কখনো কখনো
জিরার বদলে পস্তু পোটলা করে দেয়।
হয়তোবা লোকটা নিজের দুঃখকেই পোটলা করে দেয়।

লোকটার সারা গা থেকে ঝরে বেদনার নুন।


------১১ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৮---৮--২০২১



৪৪.
চাঁদ উঠেছে
তারার ঝিকিমিকি
কেউ এসেছে
কেউ আসে নাই

ঘর অন্ধকার
উনুনের আলো
রুটি ফুলছে
শিশুর কান্না

মহুল পাতে শিশির
কাঁপছে হ্যারিকেন
লম্ফতে তেল নাই
রাত বাড়ছে

জনার পোড়ার গন্ধ
মশার ওড়াউড়ি
কথা আসছে
কথা যাচ্ছে

ঘরের দুয়ারে চাঁদ
দরজায় আগুড়
তারার ডাকাডাকি
স্তব্ধ রাস্তা

গগন তলে কে বাজাও গো বাঁশি?



৪৫.
উনুন শুকনো থাকলে
উপোসে থাকবে সবাই। উনুনটা ধরাও গো।
দেখো কোথায় জমানো আছে চাল।
ঘরে তো থাকেই একটা লক্ষীর হাঁড়ি।

উনুনটা জ্বালাও গো

ভাতের হাঁড়ি চাপাও।

এক মুঠো চাল পেলেই এক হাঁড়ি ভাত

আমাদের তো অন্নপূর্ণার সংসার।


------১২ ভাদ্র ১৪২৮
------২৯----৮----২০২১



৪৬.
বাসি হলেও হলুদ টাটকা হলেও হলুদ
হলুদ ছাড়া সংসার অচল।
ডালে হলুদ দিতেই হবে, তবেই তো রঙ।
সংসার ধর্ম।

নুন--তেলটাও চাই। ধনে--জিরে--লঙ্কাও চাই।
পাঁচফোড়ন ও লাগে। একটা তেজ পাতাও 
রান্নাঘরের শ্রী। ভুললে চলবেনা
সরষের কথাও। মা যেমন ভুলে যায় না, তার কোলে কাঁদছে শিশু, দুধ দিতে হবে।



৪৭.
সকালবেলা
বৃষ্টির অন্ধকার
বৃষ্টির হাওয়া
আঁচল উড়ছে

সাড়া শব্দ নেই
গাছপালা ভিজছে
মাঠ-ঘাট ভিজছে
শুকর ছানা একা

বালকের ছুটে যাওয়া
ডুংরি কোলে জল
ঘাসের কাঁপন
বুনোলতা

মাটি গলছে
একটা কাকের উড়ে যাওয়া
গরু ভিজছে
আবছা পুকুর ঘাট

আলপথে কাশের দোল
মান পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা
ভূঁইয়ে লুটায় অপরাজিতা
নীল রঙের স্রোত

আঁচল উড়ছে।


---১৩ ভাদ্র ১৪২৮
----৩০----৮---২০২১



৪৮.
চিরুনিতে লটকে থাকা লম্বা লম্বা চুল
কার চুল? কে এসেছিল?
জানলা থেকে দেখি আকাশের মাথা
আমি ভুল করে আঁচড়েছি মেঘের রেখা।



৪৯.
ঠোঙা তৈরির মজুরি থেকে
মেয়েরা টাকা জমিয়েছিল। বাপকে দিয়ে বলেও ছিল, এই নাও পণের টাকা। 
সেই মেয়েরা বিয়ের পর সংসার করতে করতে 
গরীব বাপের দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল।
আজীবন।

বাপ --বিটি কেউ নেই শুধু রয়ে গেছে ঠোঙা।
ঠোঙা ভর্তি হচ্ছে। ঠোঙা উড়ছে। ঠোঙা লুটিয়ে পড়ছে ধুলায় ধুলায়।


-----১৪ ভাদ্র ১৪২৮
----৩১----৮---২০২১



৫০.
নুন মশলার দোকানে
সারাদিন আসা-যাওয়া করে
দু--এক পয়সার খদ্দের। বিকেল হলেই
কেরোসিন বিক্রি। দোকানেও লম্ফ জ্বলে।

আলো আঁধারের ছায়ায় মেয়ে এসে বলে, 
বাবা-দিদি আমাকে দিচ্ছেনা বুট ভাজা। তখন ঘরের ভেতর মেয়ের মা মুড়ি ভাজছে। আর
কয়লার উনুনের কাছে সেদ্ধ হয়ে উঠছে। তখন

তুলসী তলায় জ্বলছে একটি পিদিম।




৫১.
দেয়ালে দেয়ালে ঘুঁটে

আমি ঘুঁটের মধ্যে খুঁজি আঙুলের ছাপ।
যদি আঙুল গুলি ধরে রাখতে পারি,
আঙুল গুলি পুড়বেনা উনুনের আগুনে।



৫২.
পুকুর ঘাট
বালিকার কোলে হাঁস
জলের চঞ্চলতা।

ছাগল ছানার লাফ
গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে
ছিপ হাতে এক যুবক।

ঘোমটা টানা বউ
রাস্তায় নোংরা জল
কাদা ছপ ছপ।

দেয়ালে হেলানো লাঙ্গল
মাথায় গোবরের ঝুড়ি
ঘরের চালায় ডিংলা।

ধোঁয়া উঠছে
সকালবেলায় ভাতের হাঁড়ি
সজনে শাক।

রোদ এসে দাঁড়িয়ে আছে
উঠোনে খেলছে শিশু
টঙে উঠছে পায়রা।

এই বেলার এই খেলায় আকাশ প্রশস্ত।


-----১৫ ভাদ্র ১৪২৮
-----১----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ