ঘর গেরস্থের শিল্প
১৬.
পিঁড়ি
মেঘ এসেছে পিঁড়ি পেতে দে।
বৃষ্টি এসেছে পিঁড়ি পেতে দে।
কুটুম এসেছে সেবা করতেই হবে।
সেবা করার প্রথম কাজ, পিঁড়ি পেতে দাও। কাঠের পিঁড়ি। ঘরের পিঁড়ি।
কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি না থাকলেও পিঁড়ি আছে। বসতে দাও মাসি-পিসিকে।
ঈশ্বর যদি অতিথি হয়ে আসে পিঁড়ি পেতে দাও। সেবা করো। আশীর্বাদ পাবে।
পিঁড়ি ঘরের আসবাব নয়। পিঁড়িও কল্যাণমুখী। সে চেয়ে থাকে কখন আসবে কুটুম কিংবা অতিথি। সে চেয়ে থাকে কবে কখন বিবাহ অনুষ্ঠান। সে বর কনেকে বসাবে।
বিবাহ অনুষ্ঠানের পিঁড়িতে আঁকা হয়েছে ফুল লতা পাতা। পিঁড়ি হয়েছে সৌন্দর্যময়।
ঝড় এলেও বসতে দিও পিঁড়িতে। ঝড় থেমে যাবে। কথাও শুনবে সুখ দুঃখের।
মেয়েদের ব্রত কথায়, লোকাচারেও পিঁড়ি।
পিঁড়িতে বসতে দিলেই মন বসবে।
মনেই অধিষ্ঠান করে ঈশ্বর।
আমাদের গার্হস্থ কাঠামোতে পিঁড়িও এক শিল্প। রান্নাঘর থেকে বারান্দায় সাজানো আছে সারি সারি পিঁড়ি।
শিশুর জন্যেও আছে। সে পিঁড়ি পেতে খেতে বসবে ভাত। এখুনি একটা পিঁড়ি পাতো মামা আসছে।
বড় কুটুম।
-------দুপুর--১--৫১
-------১৬ আষাঢ় ১৪৩০
------১---৭---২০২৩
-----নির্মল হালদার
১৭:
ঝ্যাঁটা
ঝ্যাঁটা।
ঘর সংসারের উপকারে লাগলেও উপেক্ষিত হয়েই থাকে। অবহেলিত সর্বদা। লোক চক্ষুর আড়ালেই তাকে রাখা হয়। প্রয়োজনে ব্যবহার।
ঝ্যাঁটা।
নিম্নবর্গের মানুষ তৈরি করে থাকে। যত্নের সঙ্গে তৈরি করে আদিবাসীরাও। মাঠ থেকে এক একটি চোর কাঁটা তুলে একসঙ্গে বাঁধন দেয়। যে বাঁধন সংসারের বাঁধন। সংসার কে পরিচ্ছন্ন রাখে।
ঝুলকালিও ঝাড়ে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ।
ঝ্যাঁটাইতো ব্যবহারিক শিল্প। অন্তর থেকে বাহির ধুয়ে মুছে সংসার করে পরিচ্ছন্ন। এই পরিচ্ছন্নতা থেকে মনের সুবাস।
এ বিষয়ে ঝ্যাঁটার অবদান প্রতিটি সংসারে। জগৎ সংসারেই তার অবস্থান। তাকেও যেন সম্মান দেখাতে ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই, যারা ধোওয়া মোছা করার জন্য তৈরি করছে ঝ্যাঁটার মত প্রয়োজনীয় এক সামগ্রী, তাদের কাছেও যেন নমস্কার রাখি।
------১৮ আষাঢ় ১৪৩০
-------৩---৭---২০২৩
-------নির্মল হালদার
১৮.
শাঁখ অথবা শঙ্খ
শাঁখ বাজছে।
সন্ধ্যে হলো গো মা------।
শাঁখ বাজলেই শুনতে পাই, সমুদ্রের ধ্বনি। সমুদ্রের সুর। শাঁখের সঙ্গেই থাকে সমুদ্র। এই সমুদ্র থাকে হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে।
সকাল সন্ধ্যা পূজার্চনায় শাঁখ বাজে। মন জুড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে ধূপের গন্ধ ।
এক নারী মুখ উঁচু করে শাঁখে ফুঁ দেয় যেন বা শাঁখের প্রথম ফুঁ উৎসর্গ করছে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে। এই ছবি সারা বাংলায়। সকাল সন্ধ্যা। প্রতিদিন।
শঙ্খ হয়ে উঠল ঘরে ঘরে শাঁখ। তাকে ব্যবহার উপযোগী করে তুললো অজানা শিল্পীরা। তার ঠাঁই হলো পূজা বেদির কাছে। এবং পূজার সময় একটি তুলসী পাতা দিয়ে শাঁখকেও নিবেদন করা হয়। সেও তো মনকে শান্ত করে। ঘরেও নিয়ে আসে শান্তি।
শাঁখও কুটির শিল্প থেকে গেরস্থের ঘরে এসে কল্যাণমুখী। সে বিবাহ অনুষ্ঠানেও বেজে ওঠে। সংসারে নবজাতক এলে শাঁখ বাজিয়ে নবজন্মের উদযাপন। কিংবা নবজাতকের আগমনের পথ প্রশস্ত করা হয়, এ কথাও বলা যায়।
যেকোনো মাঙ্গলিক আচার -অনুষ্ঠানে শাঁখ বাজবেই। শঙ্খ ধ্বনির মধ্যেই সংসারে সমুদ্র এসে দাঁড়ায়। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধুয়ে দেয় আমাদের মনের কালিমা।
শঙ্খ ধ্বনি দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে সন্ধ্যেবেলার প্রথম তারার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিশোরী কন্যার মতো। যে তার মায়ের কথামতো শিখেছে শাঁখে ফুঁ দিতে।
------১৮ আষাঢ় ১৪৩০
------৪---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার
১৯.
পানের ডাবর
সবকিছু রাখার একটি পাত্র চাই। যেমন জলের আধার মাটি। যেমন ভালোবাসার আধার হৃদয়। তেমনি পান রাখার একটি পাত্র ডাবর।
কাঁসার ডাবর।
অল্প জল থাকবে ডাবরে পানকে ভিজিয়ে রাখার জন্য। সজীব রাখার জন্য। ডাবরের উপরে একটি কাঁসার থালা। যেখানে থাকে জাঁতি।
বিবাহের সময় কনের সঙ্গে দান সামগ্রী হিসেবে কাঁসা-পিতলের বাসন-কোসন দেওয়া হয়। এইসঙ্গে পানের ডাবরও থাকবে।
পুরনো হলেও এই ছবি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির শিল্পের ধারা। সেই শিল্পকেই ধারণ করেছে বাঙালি, যা ব্যবহার উপযোগী। যা যথার্থ সুন্দর। যা থেকে গেরস্থ পরিবারের জীবনযাত্রার একটি রূপ আজও আমাদের কাছে।
আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দেবদেবীর পূজায় পান লাগবেই। পানের প্রতীকি ব্যঞ্জনা যেই হোক, পানের ঠাঁই একটি কাঁসার ডাবর।
ডাবরের চেহারাও গর্ভবতী নারীর মতো। ধারণ করে আছে পান।
মঙ্গলদাত্রী।
-------২১ আষাঢ় ১৪৩০
------৭---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার
২০.
কুলা
বাঁশের তৈরি একটি কুলো।
কালিন্দী বা ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ ঝুড়ি ঝ্যাঁটার সঙ্গে তৈরি করে কুলো। কুলোর সমস্ত বাঁধন বাঁশের বাঁধন।
কঠিন বাঁধন।
কুলোর তিনটে বেড় দেখলেই মালুম হয়, কুলো-কারিগর, কারিগর নয়, শিল্পী। কুলো থেকে সহজেই পড়ে যাবে না ধান গম চাল।কুলোর পিছন দিকটি নিচু যেমন, উপরের দিক উঁচু।
পাছড়াতে পাছড়াতে চাল থেকে উড়ে যায় আবর্জনা। চাল বা গম থেকে আলাদা হয়ে যায় বালি ও কাঁকর।
ঘর গেরস্থে কুলো অপরিহার্য।
কুলো নিয়েই পূজার্চনা হয়ে থাকে।
কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়ানো হয়ে থাকে ঘরের অলক্ষীকে।
কুলো আমাদেরই।
সেই কুলো শিল্পীরা এই বাংলার গ্রামে গ্রামে। তাদের খোঁজ ক'জনই বা রাখি! ক'জন জানি, তাদের ভাঙাচোরা জীবনের ছন্দে ছন্দ মেলানোর আর কেউ নেই।
ক'জন জানি, চড়াই-উৎরাই।
কুলোতেই তো ফুল ফল রেখে ঘরে অভ্যর্থনা করি নতুন মানুষ।
নতুন আলো।
সূর্যোদয়।
--------২৩ আষাঢ় ১৪৩০
--------৯---৭---২০২৩
--------নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন