মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

ঘর গেরস্থের শিল্প - ২১




ঘর গেরস্থের শিল্প

২১.
বঁটি

বঁটিতে দু চারবার আঙুল কেটেছে মা মাসিদের, দিদি বৌদির এই তো স্বাভাবিক। রক্তের দেখা না পেলে সম্পর্ক যে পোক্ত হয় না। বঁটির সঙ্গে সহজ হতে হলে এক আধবার রক্ত দিতেই হবে। বঁটিও থাকবে ঘরে।

এক রকম নয়, তিন তিন রকমের বঁটি।আঁশ বঁটি। নিরামিষ বঁটি। ফল কাটার বঁটি। তিন রকম বঁটি নিয়ে সংসার চলে।

আঁশ বঁটিতে মাছ মাংস কাটা হবে। শাকসবজিও কাটাকুটি করে। একেবারে নিরামিষাসীদের জন্য নিরামিষ বঁটি। অনেক পরিবারেই অনেকে আছেন যারা পেঁয়াজ - রসুন ছোঁয়া স্পর্শ করেন না। নিরামিষ বঁটিও তাই আঁশের ধারে--কাছে আসবে না একেবারেই।

ঠাকুর ঘরের বঁটি ঠাকুর ঘরেই থাকে। ফলমূল কাটে। শুদ্ধ শান্ত হয়ে থাকে চুপচাপ।

এ সমস্ত বঁটি কামার ঘরের বঁটি।

কামার শালে হাতা খুন্তি কড়াই তৈরির পাশাপাশি বঁটিও তৈরি হয়। আজও। আজও ধুকধুপ করে চললেও কামারশাল গ্রাম বাংলায় চলে। কোথাও কোথাও।

মাছের বাজারে যে সমস্ত বড় বড় বঁটি দেখা যায় তা আসে হুগলির কামারকুন্ড থেকে। পুরুলিয়ার ঝালদাতেও লোহার সামগ্রী তৈরি হয়ে থাকে। পুরুলিয়ার বাজারে দেখাও যায়।

পুরুলিয়ার ছোটখাটো মেলা বড় মেলাতে লোহার হাতা খুন্তি কড়াই বঁটি ও ছুরির দোকান বসে।

বিহার ও ঝাড়খন্ড থেকেও লৌহজাত সামগ্রী মেলাতে মেলাতে আসে বিক্রির জন্য। মহিলাদের কাছে চাহিদাও খুব।

নারকেল কোরার জন্য আরেক রকম বঁটি আছে, যার মাথা মোরগের ঝুঁটির মতো। যার সাহায্যে নারকেল কোরানো হয়। সেই বঁটিতে ফল কাটাও হয়ে থাকে। বঁটির নাম মাহাত্ম্য মহিলাদের কাছে থাকলেও আমার কাছে কামার বা কর্মকারদের বিশেষ একটি বিষয়, পুরুলিয়া জেলায় অনেক কর্মকার আছেন, যারা একসময় লিখে গেছেন ঝুমুরের পদ। তার মধ্যে চামু কর্মকার।অখু কর্মকার। উদয় কর্মকার। পরেশ কর্মকার। কৃত্তিবাস কর্মকার এছাড়াও আরো অনেকে আছেন। কামারদের সম্পর্কে একটি প্রবাদ শোনা যায় :
         ঢোলে গামহার
                        ঝুমুরে কামার।

কামার বা কর্মকাররা লোহার কাজে যুক্ত থেকেও রসিক হয়ে আছে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিতে।

-------২৬ আষাঢ় ১৪৩০
-------১২---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার




২২.
তালপাতার পাখা।। হাতপাখা

(উৎসর্গ : মৃগাঙ্ক আমলকি)

সারা বছর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ঘরেই থাকে। এখনও আমাদের চারপাশে নিম্নবিত্ত পরিবার। গরিব পরিবার তো আছেই। এই সব পরিবারের সঙ্গে সারা বছর তালপাতার পাখা। হাতপাখা। শুধু কি গরম লাগলে হাতে পাখা ঘুরবে? উনুন না জ্বললে পাখার হাওয়া উনুনে পাঠিয়ে জ্বালাতে হবেই। জ্বর জ্বালা অসুখ-বিসুখ করলেও মাথার কাছে একটি পাখা। 

নিম্নবিত্ত পরিবারে গরিব পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে তালপাতার পাখা অপরিহার্য।

বাজারে প্লাস্টিকের পাখা এলেও সেই পাখার হাওয়াতে কোমলতা নেই। শীতল নয়।

যে সব জেলাতে পাখা তৈরি হয়, যারা পাখা তৈরি করে তারাও এক ধরনের শিল্পী। মানুষের শরীরকে সুস্থ ও সহজ রাখতে পাখার ভূমিকা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

পাখাও তো কুটির শিল্প।

শুধু তালপাতাটি বেঁধে শিল্পীর মুক্তি নেই। তিনি প্রতিটি পাখায় রঙের চিহ্ন  দিয়ে পাখার সাজসজ্জা করেন। আরো মনোহরণ। কোনো কোনো পাখায় ফুল লতা পাতা। হাতে পাখা ঘুরতে ঘুরতে ফুল লতা পাতার শিশির গায়ে লাগবে। যেন বা।

প্রকৃতি কত রকম ভাবে আমাদের উপকারে। আজও।

তাল গাছের মাথার দিকে চোখ না গেলেও তাল পাতা ঘরে ঘরে এসে সেবা করছে।

সেবা বলবো না শুশ্রুষা?

-------২৯ আষাঢ় ১৪৩০
------১৫---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার




২৩.
বাসনকোসন

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কাজের লোক ছিল না। তখন কাজের লোক রাখারও চল ছিল না নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারে।

অথচ কাজ ছিল দেদার। ঘরদোর পরিষ্কার থেকে থালা-বাসন ধোওয়া -ধুয়ি। এঁঠো থালা বাসন ধোয়া মোছা করার কাজটি ছিল কঠিন কাজ। তো, সেই কাজটি সহজ করার জন্য ঘরের কেউ না কেউ বাজার থেকে নিয়ে এসেছি শাল পাতা। খাও দাও ফেলে দাও।

সেই আমলে কাঁসার থালা বাটি প্রায় সব ঘরে। আমার মনে আছে বেশ, আমি একটি পিতলের গ্লাসে নিয়মিত চা খেয়েছি।

কুটুম এলে কাঁসার বগি থালায় সাজানো হতো ভাত তরকারি। বাটিতে বাটিতে ডাল ঝোল। পিতলের গ্লাসে জল। এ থেকেই একটা পরিবারের আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

চুরিও হয়েছে।

তখনকার দিনেও কাঁসা পিতলের দাম ছিল যথেষ্ট। মেয়ের বিয়েতে পিতাকেও দান হিসেবে দিতে হয়েছে কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী।

মর্যাদার চিহ্ন।

মর্যাদা আর কতদিন রক্ষা করবে মানুষ? নিম্নবিত্ত মানুষ? বাজারে আসতে লাগলো টিন দস্তা স্টিল। ছেয়ে খেললো চারদিক।

মর্যাদার মূল্য বেড়ে যেতে যেতেই, কাঁসা পিতল বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত ধাতুর বাসন-কোসন দেখা গেল ঘরে ঘরে।

চেটেপুটে খাওয়া-দাওয়ার পরেও এঁঠো থালায় আঁকিবুকি করছি, নাম লিখছি নিজের। অথবা থালায় দেখতে পাচ্ছি, দুধে ভাতে থাকো। সেই খোদাই করা আশীর্বাদ স্টিলের বাসনে এলেও আশীর্বাদকে মনে হয় স্টিলের মত। যার গা থেকে দিনরাত্রির কিরণ নেই।

কাঁসা-পিতল সামগ্রীর সুনাম আছে মুর্শিদাবাদের। বাঁকুড়ার মলিয়ানেও হয়ে থাকে কাঁসা-পিতলের কাজ। এবং যারা এই কাজে দক্ষ তাদের আমরা চিনি না। চেনার চেষ্টাও নেই। যারা এখনও গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসী। তার সঙ্গে তাদের জীবিকাও জড়িত।

কাঁসা-পিতলও পরিবারের শ্রী। সৌন্দর্য তো নিশ্চয়ই। যা ভুলে যেতে যেতে ভুলে যাচ্ছি কাঁসা-পিতলের কৌলিন্য। 

------- ৯ শ্রাবণ ১৪৩০
---------২৬---৭---২০২৩
---------নির্মল হালদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ