আলোক বর্তিকা
নির্মল হালদার
শঙ্খ ঘোষ কেমন ছিলেন, কত বড় কবি ছিলেন, বলার মতাে আমার কোনও সাহস নেই। অথবা বলতে পারি, ক্ষমতা নেই। খুব সহজ করে বলতে পারি, তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। ছিলেন প্রাণের মানুষ। আমার সঙ্গে তার ৪২ বছরের সম্পর্ক। সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে। আমি তাকে রাত এগারােটার সময়ও ফোন করেছি, কোনও একটি বিষয় জানার জন্য। আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তা আমি বুঝতে পেরেও প্রশ্ন করে যাচ্ছি, তিনিও উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। এই হচ্ছে আমার বন্ধু শঙ্খ ঘােষ। তখন টিভির এক চ্যানেলে ঋতুপর্ণ ঘােষের সিরিয়াল ‘গানের ওপারে' নিয়মিত দেখতাম। শঙ্খবাবুও তাঁর পরিবার নিয়ে ধারাবাহিকটির দর্শক। সিরিয়ালটি শেষ হলেই, এপার থেকে আমার সঙ্গে তাঁর আলােচনা। হাসি ও গল্প। কোনও কোনও দিন আমার কান্না। উনি কখনওই বিরক্ত হতেন না। কখনও কখনও কোনও বিষয়ে অনুযােগ করেছি। অভিযােগ। অভিমানের সঙ্গে কথা বলেছি। শঙ্খবাবু শান্ত হয়ে শুনেছেন। কখনও চুপ। কখনও উত্তর দিয়েছেন।
আমি সামনা সামনি শঙ্খদা বলেছি বরাবর। তাঁর আড়ালে শঙ্খবাবু। তাঁর সময়ের আর কোনও কবিকে আমি 'বাবু’ বলিনি। সবাই দাদা। তবে শঙ্খবাবু বাদে আর কেউ বন্ধু হতে পারেননি। আলােক সরকার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তারাপদ রায় এরা অত্যন্ত নিকটজন ছিলেন। কিন্তু শঙ্খবাবুর মতাে বন্ধু ছিলেন না। বন্ধু হতে হলে নিজেকে যেভাবে খােলামেলা হওয়া দরকার, সবাই তা পারেন না। তবে কী শঙ্খবাবু তাঁর সমস্ত দরজা খুলে দিয়েছিলেন? উনি খােলার আগেই আমি নির্লজ্জের মতাে নিজেকে খুলে দিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কবিতা নিয়ে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে যত না কথা বলেছি, তার চেয়ে বেশি কথা হয়েছে রাজনীতি নিয়ে। দেশকাল নিয়ে। বাজারদর নিয়ে। আমি তাঁর কাছে কবিদের সম্পর্কে অভিযােগ করেছি। বলেছি, কবিদের তুলনায় চিত্রকররা অনেক বেশি উদার। সহজ সাবলীল। পাশাপাশি বিষ্ণু দে সম্পর্কে একবার বলছিলাম, তাঁর কবিতা মােটেই দুর্বোধ্য নয়। দুরূহ বলা যায়। বলেছিলাম, অমিয় চক্রবর্তী আমার খুব প্রিয়। একবার রাত্রিবেলা জানতে চাইলাম, শক্তিদা কী
মদ্যপান করে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলেন? উনি হ্যাঁ বললেন। আমার কৌতুহল বেড়ে যেতেই জানতে চাইলাম আরও- তারপর, তারপর কী হল...? আমিও তাঁকে শক্তিদা সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা জানালাম। সমস্তই মধুর অভিজ্ঞতা। তখন রাত এগারােটা বেজে গেছে। আজ কটা বাজে এখন? উনি কি জানতে পারবেন, আমি কী লিখছি তাঁর সম্পর্কে? বলেছিলাম, আপনি আমাকে সময়ে-অসময়ে যা যা বলেছেন, আমি কি লিখতে পারি? উনি অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, আমাকে একবার দেখিয়ে নিও। আজ আমার এই কথাবার্তা যদি কোথাও ভুল লিখে থাকি, কে সংশােধন করে দেবেন? কে দেখে দেবেন? শঙ্খবাবুকে নিয়ে একটি ছােট্ট লেখা লিখেছি। পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের ঘরে। আজ বড় ইচ্ছে করছে,
আমার এই লেখা উনি একবার দেখুন। আর অমলিন হাসি হেসে আমার দিকে চেয়ে থাকবেন।
শঙ্খবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটি মনে পড়ে খুব। শীতের দিন ছিল। শ্যামবাজারে কুয়াশা ছিল। সেই কুয়াশা কঠিন পার হয়ে আমি তাঁর কাছে একা একা গেছি। কোনও জড়তা ছিল না আমার। তার কাছে টাকা চাইতেও আমার জড়তা ছিল না কখনও। পুরুলিয়া ফিরে আসব অর্থাৎ বাড়ি ফিরে আসব, দেখা করতে গেছি। আমার উঠে যাওয়ার আগে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি বই। অস্ফুট গলায় বললেন, একটা খাম আছে দেখে নিও। আজ কোন খামটা খুলে দেখব? আজ কোন বইটা খুলে দেখব, মাথায় লেখা আছে শ্রী? কেবল মনে মনে জানি, শঙ্খবাবু গতকাল ছিলেন শ্রী। চিরকাল থাকবেন শ্ৰী। চিরদিনের এই মানুষটিকে হারিয়ে আমি হারিয়ে ফেললাম, আমার আলােকবর্তিকা। তারপরেও বলতে হয়, হারিয়ে যাইনি। যে শঙ্খ বেজেছে একবার আকাশে আকাশে, যে শঙ্খ জ্বালিয়েছে আলাে ধুলায় ধুলায়, তা যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। থেকে যায়। থেকে যাবেই। শঙ্খের মুখে ফু না দিলেও থাকবে শঙ্খ। বাজবে তার ধ্বনি। আমার চারটে বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি করে দিয়েছেন। নামকরণ করেছেন। বানান সংশােধন করে দিয়েছেন। ছন্দ ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। তারপরও কী করে বলব, আমার বন্ধু নেই। বন্ধু আছে। আমার বন্ধু দুর্গা দত্ত যিনি শঙ্খবাবুর প্রিয় ছাত্র। তাকে একবার বলছিলাম, কী আর হল কবিতা লিখে...! দুর্গা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, কেন শঙ্খবাবুকে তাে পেলে। আমি আর কী বলব...মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি। শঙ্খবাবুর সঙ্গে অথবা বন্ধুর সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি বারবার। তখন দুর্গাকে বলেছি আবার, তােমার স্যারের সঙ্গে আলাপ না হলেই ভালাে হতাে। দুর্গা কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলেছি। তিনি হেসে উঠেছেন।
শঙ্খবাবু খ্যাতিমান কবি-প্রাবন্ধিক-রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ মনে রেখে বা না রেখেও আমি যে তাঁকে বন্ধু করতে পেরেছিলাম এবং তিনিও বন্ধু হয়েছিলেন, এ আমার পরম প্রাপ্তি। আমার বৃত্তে যারা থাকে তাদের
প্রায় সবাইকে নিয়ে গেছি শঙ্খবাবুর কাছে। আমার নিজের তাে গর্ব করার কিছু নেই। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি নেই, শুধু আছে শঙ্খ ঘােষ। তাই সবাইকে নিয়ে দেখাতে গিয়েছি, দেখাে এই আমার শঙ্খবাবু। আমার
চিরকালীন বন্ধু।
(সাপ্তাহিক বর্তমানে প্রকাশিত)








কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন