মঙ্গলবার, ১১ মে, ২০২১

সহজপাঠ আমার জীবন

চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ

সহজপাঠ আমার জীবন

নির্মল হালদার








ছোট খোকা বলে অ আ / শেখেনি সে কথা কওয়া নন্দলালের ছবির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখা, শিশুদের বর্ণপরিচয়। সহজ পাঠ। প্রথম ভাগ। শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ / কোণে বসে কাশে খ ক্ষ। সহজ পাঠের প্রথম থেকে শেষ সরলতায় বাঁধা এবং শিশুর মতোই সহজ সরল উচ্চারণ। তবে কি এ শুধুই শিশুপাঠ্য? আমি তো আজ সহজপাঠের মধ্যে আমার গ্রাম-বাংলাকে পাই। নিজেকে পাই। সরলভাবে বাঁচার দিকেও যেতে পারি।

বনে থাকে বাঘ।

গাছে থাকে পাখি।

জলে থাকে মাছ।

ডালে আছে ফল।

পাখি ফল খায় ৷

পাখা মেলে ওড়ে।

এই লেখা থেকে শিশুরা শেখে। আমিও শিখি। আবার নিজেকে প্রশ্ন করি, কী শিখি? আধুনিকতার নামে অহংকারী হই, উদ্ধত হই। এবং ধাঁধার ভেতরে ঘুরে মরি।

রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল। হাতে তার সাজি।

জবা ফুল তোলে। বেল ফুল তোলে। বেল ফুল সাদা। জবা ফুল লাল। জলে আছে নাল ফুল।

ফুল তুলে রাম বাড়ি চলে। তার বাড়ি আজ পূজা। পূজা হবে রাতে। তাই রাম ফুল আনে। তাই তার ঘরে খুব ঘটা। ঢাক বাজে ঢোল

বাজে, ঘরে ঘরে ধূপ-ধুনা।

এই সরলতার কাছে আমরা কি পৌঁছোতে পারব না?

কালো রাতি গেল ঘুচে

আলো তারে দিল মুছে

পুব দিকে ঘুমভাঙ্গা

হাসে ঊষা চোখ রাঙা।

রবীন্দ্রনাথের ঊষাকালের ছবি। প্রতিদিনই দর্শন করতেন। ঊষার আলো ঊষার রঙ। তাই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন, হাসে ঊষা চোখ রাঙা।

নির্মাণ করেননি। সৃষ্টি করেছেন।

১৮ পঙ্ক্তির কবিতা, ৪টে পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি থেকেও কবিতার সম্পূর্ণতা পাই। এই কবিতার শেষ ৪ লাইন :

বনে বনে পাখি জাগে

মেঘে মেঘে রঙ লাগে,

জলে জলে ঢেউ ওঠে

ডালে ডালে ফুল ফোটে।

এই ফুলে শিশির জমে। এই ফুলের গন্ধে ছুটে আসে মৌমাছি। এই ফুলের হাসি আমাদের ডাকে। সাড়া দেব কি দেব না আমাদের বিষয়।

নাম তার মোতিঝিল, বহুদূর জল

হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল

গাঁগেরামের এই ছবি প্রতিদিন, কিন্তু হাঁসের কোলাহল শুনতে পাই না। কারণ, রবীন্দ্রনাথের শোনা কোলাহল মধূর। এই সময়ের এক কবিও হাঁস চলার পথ দেখিয়ে গেলেন, সেই পথও আমরা দেখতে পাব না।

ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি

আছে আমাদের পাড়াখানি

দিঘি তার মাঝখানটিতে

তালবন তারি চারি ভিতে

এ ছবি বীরভূমের। রাঢ় বাংলার। নন্দলালের চিত্রকলাতেও পাই। রবীন্দ্রনাথও উপহার দিলেন আমাদের, তার কবিতায়। এই দিঘির নাম আমাদের রাঢ়ের ভাষায়, তালপুকুর। পুরুলিয়াতে তালতলের হাটও আছে।

চলো ভাই নীলু, এই তালবন দিয়ে পথ। তারপরে তিল খেত। তারপরে তিসি খেত। তারপরে দিঘি। জল খুব নীল। ধারে ধারে কাদা। জলে আলো ঝিলিমিলি করে। বক মিটিমিটি চায় আর মাছ ধরে।

বকের সঙ্গে আমিও মাছ ধরব, দিঘির দিকে দৌড়ে যাই। তারপরই চলে যাই—

এ কী পাখি? এ যে টিয়ে পাখি। ও পাখি কি কিছু কথা বলে? কী কথা বলে? ও বলে, রাম রাম হরি হরি। ও কী খায়? ও খায় দানা। রাণীদিদি ওর বাটি ভ’রে আনে দানা। বুড়িদাসী আনে জল। পাখি কি ওড়ে? না, পাখি ওড়ে না, ওর পায়ে বেড়ি।

ও আগে ছিল বনে। বনে নদী ছিল, ও নিজে গিয়ে জল খেত।

দীনু এই পাখি পোষে।

পাখিটির জন্যে আসে। তার পায়ে বেড়ি। যেখানে সে জল খেত, বনের লুকানো ঝরনায় অথবা কোনও জলাশয়ে, সেখানে পৌঁছে যেতে ইচ্ছে হয়। এখন দীনু তাকে পোষে। এবং পোষমানা এই পাখি, রাম রাম হরি হরি ডাকে।

আমার ছোটবেলার টিয়াপাখিকে মনে পড়ে। মা পুষেছিল। তার দাঁড়ের বাটিতে ভেজা ছোলা টুকটুকে লঙ্কা দিয়ে। মা বলত, বলো বলো, রাধে রাধে কৃষ্ণ কৃষ্ণ। সে যখন মারা যায় মায়ের কী কান্না। সন্ধেবেলা তুলসী মঞ্চের নীচে মাটি খুঁড়ে তাকে কবর দেওয়া হল।

পাখির সেই মৃত্যুর পর পাখি পুষব এই বাসনা কখনওই জাগেনি। বরং কারও বাড়িতে পোষা পাখি দেখলেই উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। খাঁচা ভর্তি পাখিরা যখন বাজারে আসে, তখনও উড়িয়ে দেওয়ার উষ্ণ ইচ্ছা মনকে অস্থির করে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’-এর নায়ক নবীনকুমার খাঁচাভরা পাখি কিনে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যার যেখানে জায়গা। আকাশ তো পাখিদের। ওদের জায়গায় ওদের যেতে দাও।

এখানে পাখিটি প্রধান না দীনু? তারপরই মনে হয়, পাখি ও দীনু একই সঙ্গে সরল। এবং প্রধানও। পাখি পুষেছে বলে দীনুর প্রতি রাগ জন্মায় না, দীনু যে শিশু আমাদের। বয়েসের উল্লেখ না থাকলেও দীনু এক শিশু। যেহেতু শিশুদের জন্যেই রবীন্দ্রনাথের এই লেখা। আমাদের জন্যেও।

আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে

পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,

দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,

এক ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা,

কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাক,

রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক

আর-পাড়ে আমবন তালবন চলে,

গাঁয়ের বামুনপাড়া তারি ছায়াতলে,

তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাইবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে

শেষের আগেই থামছি একটু, গামছায় জল ভরি বাক্যটির কাছে এসে আমাকে পিছিয়ে যেতে হল আমার বাল্যকালের কাছে। বাবা আমাকে স্নান করাতে নিয়ে যেত পুকুরে কিন্তু জলে নামতে দিত না। পাছে ডুবে যায় ছেলে। তাই ঘাটে বসিয়ে, গামছায় জল ভরে আমার মাথায় ঢালত। এখনও সেই পুকুরের দিকে গেলে, বাবাকে মনে পড়ে। যাই হোক, পুরো কবিতাটি আপনাদের শোনাই :

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হ’লে পরে,

আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।

বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,

বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর-ভর

মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।

মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,

ঘোলাজলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া

বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।

এ নাকি কবিতা নয়, এ শুধু পদ্য। এই রব শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। যার ফলাফল দেখতে পাই, অসংখ্য কবিতায় অকারণ শব্দের সমষ্টি, জটিলতা। বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠিছে ওই, এ যদি কবিতা না হয় তবে আজকের কবিতা কী?

এক যে ছিল গাছ সন্ধে হ’তেই দু’হাত তুলে জুড়ত ভুতের নাচ— এই কবিতাও পদ্য বলে বাতিল হয়ে গেছে।

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত যতীন্দ্রমোহন বাগচী কুমুদরঞ্জন মল্লিক ইত্যাদি কবিরা আজ ব্রাত্য। তাঁদের নামও আজকের অনেকেই শোনেননি। বিনয় মজুমদারের বাড়িতে গেছলাম একবার। একথা সেকথা-র পরে জানতে চাইলেন, বল তো তালগাছ বললে কী কবিতা মনে পড়ে? পালকি বললে কার কবিতা মনে পড়ে? চাঁদ বললেও তো সুকান্তকে মনে পড়ে, পড়ে না? আমরা তো নজরুলও উচ্চারণ করি না।

যে ক’জন ছিলাম, এ ওর দিকে তাকাই, কখনও উত্তর দি, কখনও চুপ। বিনয়দা হো-হো করে হাসেন।

অন্তরে অন্তরে আজও যা বেজে চলে অথবা মায়ের স্নেহের মতো বইতে থাকে স্রোত, কেমন করে ভুলি। ভুলিয়ে দিতে চাইলেও ভুলতে পারব না।

কাল ছিল ডাল খালি

আজ ফুলে যায় ভরে।

এই কবিতার পঙ্ক্তি আমার কাছে শ্লোক হয়ে গেছে। পদ্য বলে কিম্বা শিশুশিক্ষার জন্যে বলে, আমি দূরে সরিয়ে রাখিনি।

রবীন্দ্রনাথ কি শিশুদের গল্প বলার ছলে, বানান শেখাচ্ছেন? এই যে এখানে—

শৈল এল কৈ? ঐ যে আসে ভেলা চড়ে, বৈঠা বেয়ে ওর আজ পৈতে।

এই পঙক্তির ভেতরে কাব্যরস নেই? অথবা

সৌর, জান ওটা কী পাখি ?

ও তো বৌ কথা কও

না, ওটা নয়। ঐ-যে জলে, যেখানে জেলে মৌরলা মাছ ধরে।

ওটা তো পানকৌড়ি।

পাখিও চেনাচ্ছেন। পাখি মানেই তো কোমল কবিতা। যেমন ‘ভোর’ এক একক কবিতা। এইসব লেখার কাছে আমাদের দু-চার লাইনই বরং বাতিল হয়ে যায়। বড় বেশি চালাকি যে, বড় বেশি পাণ্ডিত্য ফলাই। অথবা বিদ্যা জাহির করার নামে মূর্খামি করি। বিমূর্ততার নামে তালগোল পাকাই।

নদীর ঘাটের কাছে

নৌকো বাঁধা আছে,

নাইতে যখন যাই দেখি সে

জলের ঢেউয়ে নাচে

এই কবিতাকে ছড়া বা পদ্য বলে দূরে ঠেলে ফেলব? এই চিত্রকল্প ধার করা নয়, বানানো নয়, এখানে আমি নিজেও

জ্যাস্ত হয়ে উঠি।

চন্দ্রবিন্দুতে যাই—

আঁধার হল, ঐ যে চাঁপাগাছের ফাঁকে বাঁকা চাঁদ, আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস উড়ে গেল।

একটা গন্ধ লুকানো আছে, চাপা ফুলের গন্ধ। রবীন্দ্রনাথ বললেন না, আমি গন্ধটা পেয়ে আনন্দে হাঁসের সঙ্গে

উড়ে যাই। এখানে ফুলের স্বপ্নও মনে পড়ছে—

কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাব কবে

যেথা খুশি সেথা যাব ভারী মজা হবে।

তাই ফুল একদিন মেলি দিল ডানা—

প্রজাপতি হল, তারে কে করিবে মানা।

সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগে এসে প্রথমেই বিখ্যাত কবিতাটি বারবার পড়ি :

কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি

বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি।

গাড়ি চালায় বংশী বদন

সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।

হাট বসেছে গুরুবারে

বক্সিগঞ্জে পদ্মাপাড়ে।

বাকি অংশটি নিশ্চয় মনে পড়বে সকলের। আমি এই কবিতার বাইরে যেতে পারি না কোথাও। না, আমি আজকের কবিতার দুরূহতা দুর্বোধ্যতার কাছে, অকারণ বুঝতে দেব না এই চিন্তার কাছে যাব না। বলতে শুনেছি, বুঝতে দিলেই তো কিছু থাকল না। আমি মনে করি কবিতায় দীক্ষিত হতে হয় আগে কবিকে। হ্যাঁ, কবিকে। সরলতা ও উদারতার কাছেও কবিকে পাঠ নিতে হয়। কবিতাকে বুঝতে দেব না এই যে ভাবনা অথবা অহংকার আমি মনে করি ভুল। পাঠককে কবিতায় দীক্ষিত হতে হবে, এ ঘোষণাও কবিরা করে, এও ভুল, আর কবিকে দীক্ষিত হতে হবে না সমাজ সময়ের কাছে? মানুষের কাছে? কবিতা কি শুধু কবির জন্যে? কবি কি মাটিতে পা রাখবেন না? শিকড়ের স্বর কান পেতে শুনবেন না?

আজকের চিত্রশিল্পীরা যদি বলেন, বেঙ্গল স্কুল ভুল। যামিনী রায় ভুল। যদি বলেন, অবনীন্দ্রনাথের পদ্য রচনা চমৎকার তবে ছবি বড় দুর্বল। যদি বলেন গগনেন্দ্র নাথ হেমেন মজুমদার আজ ব্রাত্য, তবে তারাও তো ভুল করবেন।

আমরাও তো আকাশ থেকে পড়িনি, বাপ-চৌদ্দ পুরুষের রক্ত তো বইছে। তাহলে যে কোনও শিল্পের ক্ষেত্রে চৌদ্দপুরুষ আছে। সত্যেন্দ্রনাথ মোহিতলালরা আমাদেরই মহাজন, অনেক ঋণ আছে তাঁদের কাছে।

পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে নিজের দিকে তাকাই যখন, তখন কালীঘাটের পট, মেদিনীপুরের পট, পুরুলিয়ার ছো নাচ আমার দিকে চেয়ে পিতৃ-পুরুষের মতোই আশীর্বাদ করে।

পাবলো নেরুদা যেমন থাকবেন, তেমনি বিষ্ণু দে থাকবেন।

আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন।

বাল্যকালের এই বাক্য ভেতরে গেঁথে আছে ব’লে, আজও মনে মনে আওড়ে যাই। মনে মনে কত যে ময়লা পরিষ্কার করি, এখানেই সার্থকতা।

তিনটে শালিক ঝগড়া করে

রান্নাঘরের চালে

অনেকেই বলতে না কার লাইন, মুখে মুখে প্রবাদে পরিণত। খামোকা রবীন্দ্রনাথ না-পড়ে না-বুঝে নিজেকে আলাদা করার জন্যে রবীন্দ্রবিদ্বেষী সাজার অর্থ নেই। সহজ পাঠ সারা জীবনের জন্য পাঠ করার বই। বানান শিখব, বাক্য শিখব, শুভ বোধের দিকে যেতে পারব। আপাতত যেতে চাই—

অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনা গাঁয়ে

পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে

জীর্ণ ফাটল ধরা এক কোণে তারি

অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী

কুঞ্জবিহারীর গান যে শুনতে হবে, একতারার একটি তারে বিন্দু বিন্দু চোখের জল ঝরে পড়ে সুর হ’য়ে—

ঐ যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা আইরি খেতের আড়ে

প্রস্তুটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়া ঝাড়ে

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এই কবিতা কি বাংলা সাহিত্য থেকে বাদ চলে যাবে? আধুনিকতার নামে আমরা কি ভুলে যাচ্ছি না আমাদের গ্রাম-দেশ, জল-মাটি হাওয়া? কুমুদরঞ্জন মল্লিককে মনে কি আছে? যার কবিতার এই পঙক্তি মনে কি পড়বে না?

বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদীর বাঁকে

জল সেখানে সোহাগ করে স্থলকে ঘিরে রাখে

এখনও, হ্যাঁ এখনও অজয় নদী পার হ’তে হ’তে আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে যেকোনও হাটে গেলেই যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে :

দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি মাঝে একখানি হাট

সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ প্রভাতে পড়ে না ঝাট

হাটের তো একই দশা আজও। শহরেও যে ছোটখাটো বড়-মেজো হাট হয়, সেখানেও একই অবস্থা। বেচাকেনা শেষ, হাটের প্রাণও শেষ। কেবল বাতাস বইতে থাকে অথবা দীর্ঘশ্বাস।

এইসব কবিতাও সহজ পাঠেরই অঙ্গ। সহজ-সরল জীবনের অঙ্গ। আমাদের চিরায়ত বাংলার প্রাণ। প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবিরা। তাই এখনও শুনতে পাই:

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল

কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল

মদনমোহন তর্কালঙ্কার তো চিরকালীন সত্যকে শব্দে গেঁথেছেন। যেখানে, গোপাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে—এই ছবিও আমাদের। এখন এইসব কবিতাকে পদ্য বলে যারা দেগে দিতে চান, তাঁরা জীবন থেকে দূরে থেকে, প্রেম-ভালবাসা থেকে দূরে থেকে, জীবনকে অপমান করেন। কবি ও কবিতাকে ছোট করেন।

শিশুপাঠ্যে বয়স্ক পাঠ্যেও এই কবিতা আসুক। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি নজরুল যতীন্দ্রমোহনরা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি।

আমাদের কাব্যচেতনায় মরচে কেবল মরচে। শ্যাওলাও ধরেছে কোথাও কোথাও, তাই শিকড়ের ডানা হোক, ডানার শিকড়—ভুলে যাই ক্রমশ।

বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস ভারতচন্দ্র জয়দেবকে ভুলে যাই। লালন ফকির মীরাবাঈকে ভুলে যাই। বটের ছায়া মুছতে মুছতে যে ভূমিতে দাঁড়াই, যা আমার অচেনা, অজানা। অচেনা অজানাকেও জানব, নিজের মাটিকে না-ভুলে। চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আমাদেরই পূর্ব-পুরুষ, তাদেরই রক্তে বহমান বাংলা কবিতা যেন যন্ত্রে পরিণত না হয়। যেন জীবনকে জীবন বলেই চিনতে পারি। যেন সেই জীবনের উপর অশত্থের ছায়া বটের ছায়া আমজামের ছায়া পড়ে। যেন বটফল তুলেও বলতে পারি, কেমন আছো? জামের কালোরঙে জিভ রাঙিয়ে যেন ভয় দেখাতে পারি পিটারকে। আর পিটার হেসে উঠবে হো হো করে।

শালিক চড়ুইয়ের উড়ন্ত ছায়া গায়ে পড়লে বলব, ভালো আছি। তোমরাও ভালো থেকো। ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা আসুক উঠোনে। দু’খানা ওদেরও প্রাপ্য। কাক এলে, দূর দূর করব না। মনে মনে উচ্চারণ করব: আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।

আমি যে জানি :

দিঘি ভরা জল করে ঢল্ ঢল্

নানা ফুল ধারে ধারে,

কচি ধান গাছে খেত ভরে আছে—

হাওয়া দোলা দেয় তারে।

(ঋণ : শঙ্খ ঘোষ, দুর্গা দত্ত, স্বপন চক্রবর্তী, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়)

** সম্পূর্ণ লেখাটি কবিতা আশ্রম মে-২০১৭ মুদ্রিত সংখ্যা থেকে গৃহীত



প্রধান উদ্দেশ্য


সহায়তা বা অনুরোধের জন্য


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ