শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১

লোকটা / নির্মল হালদার

লোকটা / নির্মল হালদার



কোথায় গেল রে বাবা লোকটা?
টিভি চলছে। অথচ ঘরে নেই।
কোথায় গেল?

এদিক ওদিক চেয়ে দেখি।
চেঁচিয়ে ডাক দি------ ও মোহন দা
ও মোহন দা-----।কোনো সাড়াশব্দ পাইনা।

কোথায় গেল রে বাবা?

সকালেই আসতে বলেছিল আমাকে। আমিও ঠিক সময়ে এসেছি। অথচ নিজে লোকটা নেই।
বেশি দূরে তো যাবে না নিশ্চয়ই।
কাছাকাছি আছে। তাই হয়তো, টিভি চালিয়ে চলে গেছে।

বিল তো উঠবেই। লোকটা কি আর জানে না! জিজ্ঞেস করতে হবে। সঠিক উত্তর পাবো কি?

লোকটা আগে আসুক।

দরজা খুলে ঘরের ভেতরে বসি।
দেখতে পাই, খোলা আছে খবরের কাগজ। ৩ নাম্বার পাতায় একটা কলম রাখা আছে। তার মানে, একটু আগেই ছিল। কোনো কাজে উঠে গেছে। পড়ে আছে চায়ের কাপ। অর্ধেক খালি। এস্ট্রে আছে।
পোড়া সিগারেট বিড়ি নেই।

লোকটা আছে। এখুনি এসে হাসতে হাসতে বলবে, রাগ করিস না। দেরি হয়ে গেল।

লোকটা এলো।
এবং আমি যা ভাবছিলাম, তাই বললো, রাগ করিস না।
আমি বললাম রাগ করছি অন্য একটা কারণে। তুমি নেই আর
ঘরে টিভি চলছে। কী ব্যাপার?
লোকটা জানালো, টিভি না চললে
তুই আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতিস না। এতদিন আসছিস, কিছুই তো বুঝলি না । আমার দরজা ভেজানো থাকে। তালা চাবি থাকে কী? কারণ ঐ একটাই, আমি আছি। একটা সময় ছিল যখন, দু হাট করে আমার দরজা খোলা থাকত সবসময়। তার ফল ভুগেছি। চুরি হয়েছে অনেক কিছুই। এখন দরজা ভেজানো থাকে। শুধু। এখনো চুরি হতে পারে।

আমি বললাম, দাঁড়াও-------আমি একবার চুপি চুপি তোমার ঘরে যা আছে যেটুকু আছে নিয়ে যাবো। চুরি করে নিয়ে যাবো।

লোকটা বললো, কি আর আছে! একটা সময় সংগ্রহ করেছিলাম, রবীন্দ্র রচনাবলী।রমেনকে দিয়ে
দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী পেয়েছিলাম। দিয়ে দিয়েছি।
তা বাদে আর কিছু নেই। এখন বই
কেনা ছেড়ে দিয়েছি। সংগ্রহ করা ছেড়ে দিয়েছি। যেহেতু লেখাপড়া করি না আর।

অনেকক্ষণ পর লোকটা বললো,
চল্-----চা খেয়ে আসি। লক্ষ্য করলাম, লোকটা পায়ে চটি না গলিয়ে আমার সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে। আমি বললাম, জুতো পরবেনা? লোকটা উত্তরে বললো,
কেউ যদি এসে আমাকে দেখতে না পায়? আমার ঘরে তো কেউ নেই যে জানান দেবে আমার খবর।
তুমি আশ্চর্য লোক তো। যার দরকার তোমাকে খুঁজে নেবে। তুমি জুতোটা পরো।
আমার কথা না শুনে খালি পায়েই বাইরে চললো।
আমি বললাম, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না।

লোকটা হাসলো।

আমার মনে পড়ে গেল, সুবোধ আমাকে একদিন বলছিল, লোকটা নাকি প্রায় দিন সন্ধ্যেবেলা ঘুমোয়। এদিকে চলতে থাকে টিভি। সুবোধ ঘুম থেকে তুলে প্রথমেই লোকটাকে বলেছিল, টিভিটা বন্ধ করো। বুঝতে পারছি, তোমার অনেক পয়সা হয়েছে। ইলেকট্রিক বিল যা খুশি হবে দিতে পারবে তুমি।

সুবোধ উত্তরে জেনেছিল, ঘরে যে কেউ আছে , লোকটা বাদেও কেউ আছে এটা জানান দিতেই, এই পদ্ধতি।
একটা ঘর। সে কি শুধু চুপচাপ থাকবে? একটা ঘর সেতো বোবা নয়। শব্দ চলতে থাকুক। সুবোধ
তারপর বলেছিল, গান চলতে পারে। মন্দ লাগবে না। তুমি ঘুমিয়ে গেলেও গান চলবে। গান চলতে পারে। গান , ঘুমের জন্য
শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা।
মোহন দা, তুমি একটা মিউজিক সিস্টেম কিনে নাও। গান চালিয়ে
নিজেকে ঘুম পাড়াবে।

লোকটা নাকি হেসেছিল খুব।
লোকটা এও বলেছিল, আমি কি বিপদ করবো। গানে আমার ঘুম আসেনা। কান্না আসে।

সুবোধ আর কি বলবে চুপচাপ ছিল।

মোহনদার সঙ্গে একদিন বাজারে দেখা। লক্ষ্য করলাম, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। জামাকাপড় মলিন।
আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার? তোমাকে অন্যরকম লাগছে?

মোহনদা আমাকে বলে, আমি তো এটাই চাইছিলাম। খুব ধোপ দুরস্ত
হয়ে থাকলে, তুই কাছে দাঁড়াতিস না। কথা বলতে বলতে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতিস। এই যে তুই দু'দণ্ড দাঁড়ালি এটাই আমি চাইছিলাম। তোর কাছ থেকে। এখন তো আমরা কেউ কারোর কাছে দাঁড়াই না।
আমারও যে অস্তিত্ব আছে, এইটে
আমাকে বলতে হবে কেন? যদিও
বলতেই হচ্ছে, আচার-আচরণে।
পোশাকে আশাকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখি, যেন কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করি। দুর্ব্যবহার থেকে প্রমাণ হয় না, আমি আছি।

আরেকদিন সন্ধ্যেবেলা, মোহন দার বাড়িতে বন্ধুরা সবাই আসবে।
আমারও নিমন্ত্রণ। তো গিয়ে দেখি, তখনো কেউ আসেনি। ঘর
লাগোয়া ছাদের দেয়ালে একটা জামা ঝুলছে। এবং জামার পকেট থেকে উকি দিচ্ছে একটা নোটিশ। বিষয়: আমি না থাকলে
দরজা খুলে বসে পড়ো।

মনে পড়ে গেছলো, মোহনদার
আরেকটা কথা: ঘর মানে ঘর নয়। মানুষজন না থাকলে ঘরের
কোনো অর্থ নেই। অস্তিত্ব নেই।

আমি বলেছিলাম, তোমার অস্তিত্ব কি থাকবে মৃত্যুর পরে? মোহন দা
তার স্বভাবসুলভ হাসিতে জানিয়েছিল, না থাকবে না। আমার মৃত্যুর পরে আমার অস্তিত্ব নিয়ে আমার টানাপোড়েন থাকবে না। কিন্তু যতক্ষণ আছি, অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতেই হয়।
বলেছিল, এই যে আমি প্রেম প্রেম করি তার কারণ একটাই, আমার অস্তিত্বকে জাগিয়ে রাখা। আমার যৌনতাকে জাগিয়ে রাখা।

আমি মোহনদার সব কথা বুঝতে পারি না বলে, তর্ক করি না। আজ
যেমন আমাকে বললো, মানুষের
স্বপ্ন ও কল্পনা মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। আর মানুষও অনেক দূর যেতে ভালোবাসে। কেননা, সে যত দূর যাবে ততদূর তার অস্তিত্ব। তার বেঁচে থাকা।

আপাতত এই মদের আড্ডায়
ভারি ভারি কথা না হলেই ভাল লাগবে মোহন দা। তুমি বরং
তোমার ছোটবেলার কথা বলো‌।
আমি শুনবো।

আর একটু রাত হোক। তোকে নিয়ে নদীর কাছে যাবো।নদীও
শুনবে আমার ছোটবেলার গল্প।
জলধারায় বয়ে যাবে অতীত। আর আমি বর্তমান জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে
স্নান করবো এই অমাবস্যার রাতে।

কী রাজি তো?

আমি চুপচাপ।

----২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৩----৬----২০২১
----নির্মল হালদার





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ