কোনো বন্ধুর লেখা অন্যদের পড়ানোর মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। আর, সে-লেখা যদি হয় এমন।
আসুন, আমরা সঙ্গী হই এক আশ্চর্য যাত্রাপথের।
(লেখাটির নাম আমার দেওয়া, নির্মলের অনুমতি না নিয়েই।)
.
.
আমার মায়ের নাম মায়া
.........
নির্মল হালদার
.
বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আমার বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
কোনো গাড়ি নেই। গাড়ি বলতে বাস-ট্যাক্সি নেই।
বর যাচ্ছে গোরুর গাড়িতে।
বরের সঙ্গে একজন মুরুব্বি।
তিনি শুধু হুঁকো টেনে চলেছেন।
বর নাকের কাছে হাত রেখে হাওয়া করছে। হুঁকোর গন্ধ তার সয়না।
পুরুলিয়া থেকে মানবাজার অনেকটা রাস্তা। কাঁচা রাস্তা। এবড়োখেবড়ো। উঁচু-নিচু।
ঢিকির ঢিকির গোরুর গাড়ি চলেছে।
বেলা বারোটায় শুরু হয়েছে যাত্রা। এখন, বেলা পড়ে আসছে। গাছপালায় আলো-আঁধারের শেষ খেলা। আর বর চলেছে নতুন জীবনের দিকে।
শেয়াল ডেকে উঠলো।
আরেকটা গোরুর গাড়িতে আছে আমার দাদু শিবপ্রসাদ হালদার। সে বলছে, ভয় নেই রে, ভয় নেই। এ বরং শুভযাত্রা।
আমিও তো আছি গোরুর গাড়িতে। আমি বললাম-- শেয়ালের অভিনন্দনবার্তা।
আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এমন ভাবে লুকিয়ে আছি, আমার নিশ্বাসের শব্দ কেউ টের পায় না। আমি মজা করে, কয়েকবার বাবার পিঠে চিমটি কেটে দিই।
পিছন ফিরে দেখে, কেউ নেই।
কয়েকবারের পর বাবাকে বলতেই হলো-- পিঠে চিমটি কাটছে কে রে বাবা!
মুরুব্বি বলেন-- কে আবার, মশা।
আমি চুপিচুপি হাসি।
বাবার খিদে পায়। মুরুব্বিকে বলে। তিনি জানান, খাবি কী রে বাবা! আজ তো বিয়ের পরে খাওয়া। বাবাজি, আপাতত খিদে চেপে রাখো।
-- জল তো খেতে পাবো।
কিন্তু কোথায় জল?
মুরুব্বি হাঁক দেন-- 'ও খুড়া, বজেনের জলতেষ্টা পেয়েছে। কী করবো?'
আমার দাদু আরেক গাড়ি থেকে জানায়-- বাঁধ দেখলে দাঁড়াবি-ই-ই।
বাবার কপালে ঘাম।
আমি মুছিয়ে দিলাম, নিঃশব্দে। বাবা চারদিকে তাকিয়ে দেখে, কোথায় হাওয়া, কী হাওয়া।
যেটুকু হাওয়া বইছে, ঘাম মুছতে পারে না।
বাবা কী করে জানবে। আমার ছোট দুটো হাত, মুছে দিয়েছে বাবার ক্লান্তি।
বাবার মুখ শুকনো।
বাবার পরনে হাঁটুঅব্দি একটা ধুতি। একটা সাদা পাঞ্জাবি। বাবার পাশেই নামানো আছে টোপর।
সেও কখনো কখনো গরুর গাড়ির দুলুনিতে দুলে উঠছে। নাকি নেচে উঠছে খুশিতে?
গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে।
দুটো গাড়ি থেকেই সবাই নামলো। রাস্তার ধারে একটা পুকুর। অন্ধকার জল।
বরযাত্রীদের কে একজন বললো-- আগে হ্যাজাকটা জ্বালতে দাও, তারপর জলে নামবে।
আমিও নেমেছি। বাবার পিছনে পিছনে। বলা যায়, বাবার পাঞ্জাবি ধরে ধরে নেমেছি।
আমারও তেষ্টা পেয়েছে।
বাবার একবার মনে হলো, কেউ বোধহয় পিছন দিকে টানছে। পিছন ফিরে দেখে, কেউ নেই।
বাবা কোনো কথাও বলছে না। মুরুব্বি দাদুকে বলেন-- হ্যাঁগো খুড়া, তোমার ছেলে যে কোনো কথাই বলছে না। বরযাত্রীদের কে একজন বললো, নতুন বৌয়ের স্বপ্ন দেখছে। ওকে দেখতে দাও।
কী স্বপ্ন?
আমি জানতাম।
আমি জানতাম, স্বপ্ন নয়। বাবার মাথায় ঘুরছিল এক ভাবনা।
বিয়ে তো করছি, সংসার চালাতে পারবো? লোকের দোকানে চাল মেপে যেটুকু রোজকার, সংসার চলবে?
চলবে চলবে... পেঁচা ডেকে উঠলো। গাছে গাছে রাতের পাখিরা ডানা ঝাপটায়। জোনাকিরা উড়ে উড়ে বাবাকে শুভ বার্তা জানায়। প্রতিটি রাস্তায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, আজ যেন প্রকৃতির শঙ্খধ্বনি।
আমার বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আর কত দূর?
কত দূর?
এইতো এসে গেলাম, এসে গেলাম...।
দুটো গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে যায়। বর ও বরযাত্রীরা নেমে পড়ে। দাদুর নির্দেশ, সবাই চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবে। বিয়ে তো শেষ রাতে। আর কনের ঘর কি দেবে না দেবে, দাদু কিছুই জানে না।
চিঁড়ের সঙ্গে মিঠাই ছিল, আমিও পেয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে।
আমার খিদের কথা কেউ জানে না। আরও কত খিদে, কেউ জানে না।
রাত হয়ে গেল মানবাজার পৌঁছোতে। কুণ্ডুঘরে বেজে উঠলো শাঁখ।
এয়োতিরা পিতল কলসির জল গোরুর গাড়ির চাকায় ঢালে। সবাই বরের মুখ দেখে বলে-- কী সুন্দর মুখ গো! আমাদের মেয়েটা সুখ পাবে গো সুখ পাবে।
বাবার মুখ নীচু।
মুরুব্বি পরিয়ে দেন টোপর।
আমার দিদিমা বাবাকে বরণ করে। মিষ্টিমুখ করায়।
আর আমি দিদিমার খুঁটে-বাঁধা পান খুলে ফেলে দিই।
বাজনা বাজছে।
আমার মামাবাড়িতে দুর্গা মন্দির আছে। দাদু বাবাকে বললো-- যা মন্দিরে গিয়ে প্রণাম কর।
সেই ফাঁকে আমি চলে গেছি মায়ের কাছে। মা বসে আছে সেজেগুজে।
মা না, এক বালিকা।
বারো বছর বয়স।
লাল রঙা এক ফিনফিনে শাড়িতে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মা।
ভয় মেশানো মুখ। মা ভাবছিল-- কোথায় যাবে, কী করবে, কাদের পাবে শ্বশুরবাড়িতে। শেষ হয়ে গেল খেলনাবাটি খেলা। এক্কাদোক্কা। লুকোচুরি। পুকুরে সাঁতার। দুর্গা মন্দিরে খড়ের কাঠামোর পিছনে লুকিয়ে থাকার মজা, শেষ হলো।
ছল ছল করছে মায়ের মুখ।
তখনই আমি ঝপাং করে মায়ের কোলে। মা ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে আমাকে দেখে। বলে-- 'তুই এখুনি এলি! তোর তো অনেক দেরি আছে। এখন যা, পালিয়ে যা! যেন কেউ দেখতে না পায়। তোর বাবা দেখতে পায়নি তো?'
বলে-- 'তোর আসতে দেরি আছে সোনা... তুই যা।'
-- আচ্ছা, যাবো যাবো। তার আগে আমাকে একটা হামি দাও। আর বলো, তোমার নামটা কী?
-- তুই তো জানিস...
-- তোমার মুখে শুনতে চাই।
-- আমার... আমার নাম মায়া।
(১৭-১০-১৯)
একরাম আলি র দেওয়াল থেকে 🙏

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন