বদলি হয়ে যাওয়া // নির্মল হালদার
সুব্রত স্যার ক্লাস সেভেনের ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন--------তোরা আমাকে স্যার স্যার করবিনা। সবাই দাদা বলবি।
সুব্রত স্যার ক্লাস সেভেনের ক্লাস টিচার। অঙ্ক পড়ান।
এক ছাত্রী বলেছিল-------স্যার
অন্য মাস্টারমশাইদের দাদা বললে
রাগ করবেন না তো?
সুব্রত স্যার উত্তরে বলেছিলেন------রাগ করতেই পারেন।
আবার না করতেও পারেন। আমি শুধু বলছি, আমি রাগ করবো না।
এই সুব্রত স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের বলেছিলেন-------তোরা সবাই একটা খাতায় আমাকে লিখে দিস, কবে কার জন্মদিন।
ছাত্র-ছাত্রীরা একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল-------কেন স্যার?
সঙ্গে সঙ্গে সুব্রত স্যার-------আবার স্যার? দাদা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোদের?
হেসে ফেলে ছিল সবাই। বলেছিল-----
আর হবে না দাদা।
সুব্রত স্যার মনে করেন, তিনি কখনোই
কোনো সরকারি দপ্তরের চেয়ারে বসে নেই। এবং তার অধীনে ছাত্রছাত্রীরা নেই। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা কেন বলবে, স্যার?
বরং ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে দাদা শুনতে মধুর লাগে। সেখানে স্যার শব্দটি শুনলেই মনে হয়, হাতে একটা ছড়ি আছে। যিনি শাসন করতে পছন্দ করেন।
সুব্রত মুখোপাধ্যায় স্যার কোনো ভাবেই নন। তিনি সর্বদাই কাছের মানুষ। তাই টিফিন পিরিয়ডে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গাছপালা চিনতে যান। ছাত্র-ছাত্রীরা যা চেনে, তাদের সুব্রতদা কে চিনিয়ে দেয়। সুব্রতদা যা চেনেন ছাত্র-ছাত্রীদের চিনিয়ে দেন। পারস্পরিক এক লেনদেনের মাধ্যমে
কাছাকাছি চলে আসার একটা সুযোগ। তার সঙ্গে অচেনাকে চিনে নেওয়া।
এই সুব্রতদা প্রতিমাসেই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন। তিনি তো ক্লাস সেভেন থেকে টেন অব্দি পড়ান।তো সব ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদের জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন।
কিছুই না, সুব্রত দা নিজে যেকোনো একটা ফুল ছাত্র বা ছাত্রীর হাতে দিয়ে
একটি চকলেট খাইয়ে দেন। মনে মনে উচ্চারণ করেন, কল্যাণ হোক। জন্মদিন শুভ হোক।
ছাত্র বা ছাত্রী প্রণাম করে।
অঙ্কেও পারদর্শী।
ছাত্র বা ছাত্রী একবার না পারলে,
বারবার বুঝিয়ে দেবেন। তাও না পারলে সুব্রতদা বলেন-------টিফিনে আবার তোর কাছেই তোর জন্যেই আসবো। শেষ অবধি দেখা গেছে, অঙ্কে কাঁচা ছাত্র বা ছাত্রী পাকা হয়ে উঠেছে।
সুব্রতদার জন্যেই সরস্বতী পুজোতে
প্রতিবছর নাটক। সে বছর রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর করেছিল ক্লাস নাইনের ছাত্র ছাত্রীরা। যে ছেলেটি অমল করেছিল, সে পুরস্কার পেয়েছিল অনেক।
আড়াল থেকে সুব্রতদা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছিলেন।
সুব্রতদার জন্যেই পিকনিক। সুব্রতদা যদিও পিকনিক শব্দটি পছন্দ করতেন না।
বলতেন বনভোজন। চেষ্টাও করতেন,
কোনো না কোনো জঙ্গলের দিকে যাওয়া। কারণ, ছাত্রছাত্রীরা তাহলে জঙ্গলের মর্ম বুঝবে।
আর বনভোজন মানেই, শুরু থেকে শেষ অব্দি রবীন্দ্র সংগীত। ছাত্র-ছাত্রীরা না গাইলে সুব্রতদা একা একা গান করবেন ।
এই সুব্রতদাকে হঠাৎ স্কুলে আর দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীরা জানতেই পারছেনা, সুব্রতদা স্কুলে কেন নেই?
ক্লাস টেনের অনিরুদ্ধ সঠিক তথ্যটাও
নিয়ে আসতে পারলোনা। সে জানেনা
সুব্রতদা বাড়ির কাছাকাছি অন্য একটি স্কুলে বদলি নিয়েছেন। যাবতীয় ভালোবাসা ত্যাগ করে অনিরুদ্ধদের স্কুল থেকে চলে গেছেন।
প্রিয় সুব্রতদা চলে গেছেন।
এই সত্যটুকু ছাত্র-ছাত্রীরা যখন জানতে পারলো, তখন ছল ছল করেছিল অনেকের বুক। আর মিত্রার মনে পড়ছিল, সুব্রতদা তাকে উপহার দিয়েছিলেন--------পথের পাঁচালী।
আর গীতাঞ্জলি।
মিত্রা মনে মনে তার প্রিয় মাস্টারমশাই কে একটা চিঠি লিখলো---------
প্রিয় সুব্রতদা
আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ মানুষ।
আমি দেখবো, আপনি আমাদের ছেড়ে থাকেন কি করে! কেননা, আপনার লাগানো আমগাছটা আমাদের সঙ্গেই স্কুলে থাকছে প্রতিদিন ।
-----১২ আশ্বিন ১৪২৮
----২৯----৯----২০২১

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন