চিরাগের কাছে যাই। কথা বলার চেষ্টা করি। সে চুপচাপ থাকে।
সিনেমা শিল্প-সাহিত্য, সমাজ সময় নিয়েও কথা বলার চেষ্টা করি।
সে কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে শূন্যতার দিকে।
একদিন জানতে চাইলাম, শূন্যতার অর্থ আমাকে বলো। সে নীরব থাকে।
তার নীরবতায় আমার রাগ হয়না। বিরক্তি আসে না একদম।
আমি অনেক সময় তাই, একা একা
তার সামনে কথা বলি।
আমার যে কথা আছে।
তাল গাছ অনেক লম্বা হলো। খেজুর গাছ হলো না কেন? অথচ দুটো গাছেরই ফল মিষ্টি। সুস্বাদু।
কুল গাছে অনেক কাঁটা। আম গাছে
কোনো কাঁটা নেই।
কারণ কী?
চিরাগের চোখে ঝিলিক দেখা গেলেও
সে চুপচাপ থাকে।
একদিন তার কাছে চা এনে বললাম,
খাও। সে নিস্তব্ধে চায়ের কাপ উঠিয়ে শুরু করলো খেতে। একটিও কথা বললো না।তার কাছে একটি স্মার্ট ফোন আছে। ফোন আসে। সে ধরে না। কল এলেই কেটে দেয়।
আজ সে শুয়েছিল।
আমি প্রথমেই প্রশ্ন করলাম, কেমন
আছো?
আমি জানি কোনো জবাব আসবেনা।
তবুও অভ্যাসবশত আমার প্রশ্ন, যদি কথা বলে।
আগে এই রকম ছিল না। নর্দমার পোকা নিয়েও কত কথা বলেছে। উইঢিবি নিয়ে কত কথা বলেছে।
ব্যাখ্যা করেছে নারীর শরীর নিয়ে।
শরীরের রহস্য নিয়েও কত রকম
আলো ফেলেছে আমার সামনে।
আজ সেই যুবক স্তব্ধতার দিকে।
কারণটা কী? খুঁজে পাইনা।
একদিন মনে হলো, কোনো বিষয়ে
আঘাত পেয়েছে বুঝি। তার বন্ধুদের কাছেও খোঁজখবর করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারলোনা। কেউ জানেও না,সে কোথাও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিনা। তবে কি অন্য কোনো ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে?
যা বলা যায় না কাউকে।
হাত ধরে টানাটানি করি, চলো ঘুরে আসি কোথাও।
সে কোনো ভাবেই উঠবে না।
একদিন দেখলাম, দেয়ালে
নখ দিয়ে কি সব লিখে চলেছে।
সামনে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম।
কিছুই বুঝতে পারলাম না। হরফ গুলি
হিন্দি না হিব্রু বাংলা না ইংলিশ
বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখেই সে চেয়ারে বসে পড়লো।
চেয়ারের গায়েও দেখলাম, আঁকি-বুকি। সেও পড়বার চেষ্টা করলাম। স্পষ্ট হলো না কিছুই। শুধু
একটি মাত্র শব্দ, আমার কাছে সহজ হয়ে ধরা পড়লো--------আলো।
চিরাগ কী তবে আলো খোঁজার চেষ্টা করছে? আলো কোথায়?
তার চোখে-মুখে কালো ছায়া পড়েছে।
সে ক্রমশ শীর্ণ। তার মা-বাবা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার চেষ্টা করেন। সে যাবে না কোনোভাবেই।
মা-বাবা তাগা তাবিজ এনে বেঁধে দেবার চেষ্টা করেন। সে ছুঁড়ে ফেলে।
মা বাবা তো চাইবেনই, যেকোনোভাবে
ছেলেকে সুস্থ করার। চিরাগ বলবেও না, সে সুস্থ নয়। সে অসুস্থ নয়। সে স্বাভাবিক এ কথাও বলবে না। কেবলই নীরবতা।
চিরাগের ছোটবেলার বন্ধু মৌরি
এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে।
একটাও কথা বলেনি। মৌরি তার মা-বাবাকে বলে গেল, চিরাগ পাগল হয়ে গেছে। চিকিৎসা করান।
কী চিকিৎসা ?
সে তো নিয়মিত স্নান খাওয়া-দাওয়া করে। শুধু কারো সঙ্গে কথা বলে না।
ঘরের বাইরে যায় না একদম।
একে কী পাগলামি বলা যাবে?
কি ভাই কী করছো?
তোমার ঘরে তোমাকে পেলাম না বলে
ছাদে উঠে এলাম।
কোনো উত্তর নেই।
দেখতে পাই, খোলামকুচি দিয়ে
ছাদের মেঝেতে আলপনা এঁকেছে।
আমি বললাম, তোমার হাতে ছবি আছে। আরো আঁকো।
চিরাগ আমার দিকে চেয়ে রইলো।
সে তখন আবার , একটা প্রদীপের ছবি এঁকে আমার দিকে চেয়ে থাকে।
আমি বললাম, আলো আলো।
আলোর সঙ্গেইতো আমাদের সম্পর্ক।
আলোকে ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা।
আমরা সবার কাছ থেকেই আলোর আশা করি।
আলো কই?
প্রদীপ তো আছে। এমনকি প্রতিদিন
সূর্য আছে। কেবল আলো নেই। অন্তরের আলোটা নেই।
চিরাগ, তুমি কি তাই বলতে চাইছো?
চিরাগের রোগ বলতে, ফর্সা জামা কাপড় পরবেনা। তার বাড়ির লোক জামাকাপড় পাল্টাবার কথা বলে।
সে শোনে না।
ব্যবহার করেনা তেল সাবান। অনেকে তাই তার কাছে যেতে চায় না। এখন সবাই আড়ালে আড়ালে বলে, চিরাগ পাগল হয়ে গেছে।
আমি তার কাছাকাছি এসে আমার যে ধারনা হয়েছে তা হলো, সে কোনভাবেই পাগল নয়। তার আলো শব্দটি থেকে, প্রদীপের ছবি থেকে আমি যা বুঝেছি, সে আলোর খোঁজে আছে।
কিন্তু কোথায় আলো?
আলো অর্থে সে কি বোঝে, কিইবা বলতে চায়, আমার জানা নেই। আমি হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবোনা।
আপাতত সে কথা বলছে না। অনেকদিন হলো কথা বলছে না।
আলমারিতে যেটুকু বইপত্র ছিল
ছিঁড়ে ফেলেছে।
চিরাগের মা শুধু কাঁদেন।
আমি একদিন সপ্তর্ষিমণ্ডল নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। ছায়াপথ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সে মুখ নিচু করে যেমন ছিল তেমনি রইলো। মুখ তুলে আমাকে কিছুই বললো না।এবার আমার খুব কষ্ট হলো। তার মাথার চুল ধরে ঝাঁকুনি দেবার চেষ্টা করলাম। সে কেবল উঃ আঃ করে
আমার হাত ছাড়িয়ে দিলো।
কী করবো আর?
মৌরি এসেছিল আরেকদিন। সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি শুনে বললাম, চিরাগ কে একা থাকতে দিলেই ভালো হবে বলে মনে হয়।
কোনোদিন সে কথা বলবেই।
আজ তার কথা নেই।কোনো কথা নেই।তাকে কথা বলানো মানে তাকে বিরক্ত করা। তাকে একা থাকতে দাও।
সে কোনোদিন না কোনোদিন কথা বলতে বলতে কথার আলো আমাদের দেখাবে।
আপাতত সে নীরব থাকুক।
------১৪ কার্তিক ১৪২৮
-----১---১১----২০২১
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন