আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৫৬
-----------------------------------------------------------
ঢেঁকির শব্দ আসছে।
আলতা পরা পা। ফাটা গোড়ালি। ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে। ঢেঁকির গর্ত থেকে গুঁড়ো চাল তুলে নিচ্ছে শীর্ণ একটি হাত।
ঢেঁকির শব্দ আসছে।
আমার ছোটবেলার শব্দ। ঢেঁকির শব্দ। এই পৌষ মাসে। হয়তো বা সারাবছর ঢেঁকিঘরে ঝুল কালি অন্ধকার। পৌষ মাস এলেই, শব্দ আর শব্দ। কথার শব্দ থেকে ঢেঁকির শব্দ।
সেই ঢেঁকি ঘরেই তো গোপন প্রেমের সন্ত্রাস। লুকোচুরি খেলা। সেই ঢেঁকি ঘরেই তো ঢেঁকির দখল কারা আগে পাবে----মা বললো---যা জেনে আসবি।
আমাদের ঢেঁকি ছিল না। দত্তদের ঢেঁকিতে পিঠের চাল গুড়ি করা হবে। পাড়ার প্রায় সব ঘর থেকেই এই দত্তদের ঢেঁকি।
লাইন দাও।
প্রায় সারা বছর ঢেঁকি ঘর আমাদের খেলাঘর। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন জমজমাট মেয়েলি গল্পে। কথায়। হাসিতে। বেদনায়।
এই হাসি-কান্না -বেদনা আজকের বাংলা কবিতায়, তরুণ কবিতায় ধরা পড়লো না।
তরুণ কবিতায় কি এসেছে ঢেঁকির শব্দ? উত্তর আসবে, আজকের তরুণ প্রজন্মের আগেই ঢেঁকি লুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রযুক্তি আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। সময়, নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, প্রেম ভালবাসাও কেড়ে নিয়ে মানুষকে বিধ্বস্ত করে যায়। সেই ধ্বস্ত ছবিও খুঁজে পাই না আজকের কবিতায়।
প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কোথায় আছে?
কত দূরে আছে?
ধারালো কলমের অভাবে শিল্প সাহিত্য রাজনীতিতে মরচে ধরে।
শিরদাঁড়াতেও জং ধরেছে।
মেধা ও মননে দাসত্ব। রাজার চেয়ার মুছে দিচ্ছে কবি। কবিতায় কেমন করে আসবে ঘাসের শুকিয়ে যাওয়া শিকড়। ফ্যাকাসে মাটির হাহাকার?
গজিয়ে ওঠা শপিং মলের সামনের ছোট দোকান মাঝারি দোকান বন্ধ হয়ে যায়। উপোসি হয়ে ওঠে অজস্র নিম্নবিত্ত মানুষ।
সেই দিকে যাবে না আমার কবিতা?
কার জন্য কবিতা? কাদের জন্য কবিতা?
বুকের হাপর ওঠানামা করে।
আগুন নেই।
তরুণ অগ্নি নেই।
কোন্ আগুনে সেঁকে নিতে পারি আমার দুহাত?
ঢেঁকির শব্দ আসছে।
পিঠে পরবের হাওয়া বইছে। টুসু পরবের হাওয়া বইছে। কোন্ টুসু? টুসুও যে বিকৃত হয়ে উঠলো। তার গানে গানে। লোক জীবনের সরলতা, দুঃখকথা পাথরচাপা পড়ে গেছে।
মেশিন এসেছে।
মেশিন আসতেই কাজের গতি এসেছে। দ্রুততা এসেছে। এ যেমন ঠিক তেমনি মানুষকে করে তুলেছে যন্ত্র নির্ভর।
হৃদয় যন্ত্র নির্ভর হয়ে উঠবে?
এ যে আমারই দেশ, ভুলে গেলে চলবে না। এখানে যেমন লাল শালুকের ফুটে ওঠা হৃদয় আছে তেমনি আছে অন্তর বেদনা, দারিদ্র, অসহায়তা, বঞ্চনা প্রতিমুহূর্তে। অশিক্ষা তো আছেই। আছে মানুষের কাছে মানুষের অপমান।
আলো মঞ্চ হাততালি ক্যামেরা ও ঝাঁ-চকচকে মুখের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় কুঁচকে যাওয়া চামড়া।
পিঠের ভিতরে নারকেলের পুর। চাঁছির পুর। যেন বা পিঠের ভিতরে ঠুসে দেওয়া হয়েছে আমারই দেশকে। যত ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে কামড়েকুমড়ে খাও।
ঢেঁকির শব্দ আসছে।
মেশিনের শব্দ আসছে।
ঢুকে পড়ছে আমার গলা। বিনা রক্তপাতে হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে এ সময় এদেশে।
আমার মহাভারতে।
-----২৮ পৌষ ১৪২৯
-----১৩---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৫৭
---------------------------------------------------------
পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন পিঠে গড়ার দিন। ঘরে ঘরে টুসুর জাগরণ। টুসু গান। সেই গানের সৌরভ শীতের হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ঘর থেকে বাইরে।
জেগে ওঠে অন্ধকার থেকে গাছপালা। রাতের বাদুড়। লক্ষ্মী পেঁচা।
পিঠের গন্ধ নারকেল নাড়ু তিল নাড়ুর গন্ধ বাতাস থেকে বাতাসে। রাত্রিবেলায়।
পিঠে গড়া হয়ে গেলে গোয়াল থেকে খড় এনে মা পিঠের হাঁড়িতে বাঁধতো। দরজায় বাঁধতো। খড়ের বেড়া ঠাকুরের কাছেও।
সেই বাঁধন তো আমার অন্তরেও।
সেই বাঁধন খড়ের বাঁধন। কঠিন বাঁধন। সহজে ছিঁড়বে না। মাটি থেকে ধানের জন্ম। আর ধানের অংশ খড়।
খড়ের বাঁধনে বাঁধা হয়ে আমার স্রোত। মাটির স্রোত।
আমি যেন ছুঁয়ে থাকতে পারি।
----২৯ পৌষ ১৪২৯
----১৪---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৫৮
---------------------------------------------------------
অশোকনগর দুবার গেছি। একবার কবি অনির্বাণ দাসের কাছে। সঙ্গে ছিল ইপিল। আরেকবার গেলাম অপূর্ব সাহার কাছে। প্রথমে ছিল উদ্দামতা। পরেরবার অপূর্বর কাছে কবিতা সংগ্রহের কাজে। আমার কবিতা সংগ্রহের দুটি খন্ডের কাজ অপূর্ব করেছে। তৃতীয় খন্ডের ও কাজ অপূর্বর কাছেই।
তার কাছে আমার ঋণ আমি যতই কবিতা লিখি শোধ করা যাবে না। আমার কাছে তো আমার কোনো বই নেই। সে কিন্তু সংগ্রহে রাখে আমার সমস্ত বই। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাও তার নিজের কাছে রাখে। এ বিষয়ে সে আমাকে চমকে দেয়। হাংরিদের কোন্ কোন্ কাগজে আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সে বলে দিতে পারে। তার একটা সাধ আছে ----"ক্ষুধার্ত নির্মল" নামে আমার একটি কবিতা সংকলন করবে।
সত্যি সত্যিই আমি ক্ষুধার্ত।
জল জঙ্গল জমির দিকে আমি হাঁ করে চেয়ে থাকি। মানুষের দিকে চেয়ে থাকি। পলাশ রাঙা ঠোঁটের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার বেলা বয়ে গেল।
অপূর্ব চুপি চুপি হাসে।
সেই কবে আলাপ হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের হোস্টেলে। সে তখন বাংলা পড়ে। তখন তার সঙ্গে আমার নৈকট্য গড়ে ওঠেনি। আমি পুরুলিয়া থেকে গিয়ে বেশিরভাগ দিন হিন্দু হোস্টেলে চিরঞ্জীবের ঘরে। তখন তন্ময়। অচ্যুত। তাদের সঙ্গেও তাদের ঘরে আড্ডা। কবিতা। রাজনীতি। কলেজের ক্লাসের সময় ক্যান্টিন। অদ্রীশ। ব্রাত্য।
মনে পড়ে, একদিন হোস্টেলের দোতলার বারান্দা থেকে চিরঞ্জীব আমাকে দেখিয়ে দিলো--ওই তো অপূর্বদা।
সেদিন কথা বলেছিলাম কিনা আজ আর মনে নেই। মনে নেই, তার সঙ্গে কবে থেকে আত্মীয়তা দীর্ঘায়িত হলো।
এই আত্মীয়তাও দীর্ঘ এক কবিতা। কাব্য নাটকও বলতে পারি। অপূর্ব সারা বছরের বেশিরভাগ দিন আমার সঙ্গে বিরতিতে থাকে। আমি তার বিরতি ভেঙ্গেচুরে তার তৈরি করা নাট্যরূপ ছিঁড়ে ফেলি না। সে অশোকনগর ও বারাসাত এবং ইস্কুল সামলে-সুমলে হাতে পায় না সময়। সম্পর্ক বাঁধনের সময়।
কখনো কখনো দু একদিন বাদে বাদে আমাকে ফোন। আমার মনে প্রফুল্ল জাগে।
আমার এবং আমার পরিবারের আগাগোড়া অপূর্বর চেনা। যেমন সে চিনেছে, বাংলা সাহিত্য। তার সম্পাদনায় মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়ে থাকে " থির বিজুরি "। খুব অন্যরকম পত্রিকা। গদ্য প্রধান। গভীর। অপূর্ব নিজেকে আড়াল রাখতেই ভালোবাসে। ভিড় থেকে দূরেও থাকে। নিজের যেটুকু কাজ করে যায় নিঃশব্দে।
আমার কোনো বই প্রকাশের আগে আমার চিন্তা, উৎসর্গ করবো কাকে! তো আমি অপূর্বর সঙ্গে আলোচনা করি।
কিছুই তো পারলাম না, এর ওপর তার ওপর নির্ভর করে করে আমার এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে তো যেতেই হবে, অপূর্ব যখন আছে। তাকে বলেওছি, প্রকাশিত অপ্রকাশিত আমার খাতা আমার ডাইরি উত্তমের কাছে। সে যেন আমার মৃত্যুর পর খেয়াল রাখে।
আলো বাতাস খেয়াল রাখে আমাদের। অপূর্ব তো রাখবেই, এ জন্যেই সে অপূর্ব। আর আমি অধম নির্মল হালদার।
আজও একটি কবিতাও লিখতে পারেনি।
-----৩০ পৌষ ১৪২৯ মকর সংক্রান্তি
------১৫----১----২০২৩
------নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৫৯
----------------------------------------------------------
১+১=১ হলেই একটি কবিতা।
একজনের সঙ্গে আরেকজনের শরীর ও মন মিলেমিশে গেলেই, একটি কবিতা।
১+১ =২ হয়ে গেলে সৃষ্টির দিকে যাবে না একটি প্রাণও। যে কারণে নদী যায় সাগরের দিকে। মিলনের দিকে। মাটির কাছেও আসতে হয় সবাইকে। মাটি মিলনের ভূমি।
মাটি সবাইকে ধারণ করতেও পারে।
আকাশেও একটি তারার পাশে আরেকটি তারা। মিলনের আকুতিতে জ্বলে ওঠা। আলো হয়ে ওঠা।
মিলনই হলো, মহাপৃথিবীর কবিতা। মিলনের দিকে যেতে হবেই। একের পাশে এক কখনোই দুই নয়। এখানে মিলন শারীরিক সহবাস নয়। এখানে মিলন, বেঁচে থাকার পাশে বেঁচে থাকা। আর বেঁচে থাকা তো একটাই। সমগ্র পৃথিবীতে একই মাটিতে একটাই নিঃশ্বাস।
সকলের নিঃশ্বাসের সঙ্গে সকলের নিঃশ্বাস যোগ হয়ে ওঠে সারাদিন।
পশু পাখি কীট পতঙ্গ গাছপালা নদী পাহাড় সমুদ্রর শ্বাস-প্রশ্বাস একইসঙ্গে বইছে। একইসঙ্গে মানুষের চলাচলের শব্দ এই জলে হাওয়ায়। মাটিতে। ধূলায়। শুধু মিলন লাগি।
শুধু কি ব্যাঙের সঙ্গে ব্যাঙের মিলন, বর্ষাকালে? ব্যাঙের সঙ্গে মেঘের মিলন। বৃষ্টির মিলন। পাখির ডাকেও থাকে গাছপালার কাছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ফুল ফলের কাছে যাওয়ার বাসনা।
যে যেখানেই থাকুক, মিলনের কাছে আগমনের তীব্রতা জেগে আছে চরাচরে। ১+ ১=২ হয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবেই, শিল্প আর হবেনা। আমরা তো শিল্প চাই, শিল্পের প্রাণ চাই।
প্রেম থেকেই তো আমার মা দুপুর গড়িয়ে গেলেই, সলতে পাকাতো। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবে। প্রদীপের শিখা উঠে যাবে উর্ধ্বমুখে।
এই ঊর্ধ্বমুখী শিখা , অনির্বাণ শিখা হয়ে ওঠে প্রাণের কাছে।
প্রাণ প্রতিমার কাছে।
-----১ মাঘ ১৪২৯
-----১৬--১--২০২৩
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬০
----------------------------------------------------------
পাতা ঝরে গেলে বিরহী হয়ে ওঠে গাছ। বিরহ চেয়ে থাকে সকলের দিকে। সকল সুখ দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
জল শুকিয়ে গেলে বিরহী হয়ে ওঠে নদী। বিরহ চেয়ে থাকে সকলের দিকে। সকল সুখ দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
মেঘ না জমলে বিরহী হয়ে ওঠে আকাশ। বিরহ চেয়ে থাকে সকলের দিকে। সকল সুখ দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
পাহাড়ের বিরহ হাজার হাজার বছরের। বিরহ অপেক্ষা করে। অপেক্ষা চেয়ে থাকে সকলের দিকে। সকল সুখ-দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
পাখা থেকে পালক ঝরে গেলে পাখি চেয়ে থাকে চরাচরের দিকে।
চরাচরে শূন্যতা। চরাচরে পূর্ণতা।
দুজনেই কুশীলব। নীরব। চেয়ে থাকে সকলের দিকে।সকলের সুখ-দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
কুশীলব ছাড়াও মঞ্চ একটি চরিত্র। চেয়ে থাকে সকলের দিকে। সকল সুখ-দুঃখের দিকে। সকল আনন্দের দিকে।
কুশীলব ছাড়া মঞ্চে আলো অন্ধকারের খেলা। আলো অন্ধকার জেগে থাকে।
আলো অন্ধকার প্রকৃতির বিরহ।
প্রকৃতি চেয়ে থাকে সকলের দিকে।
------২ মাঘ ১৪২৯
----১৭---১---২০২৩
----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন