মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

মাটিতে রামধনু ওঠে - ২১




২১.
মাটিতে রামধনু ওঠে

পালক আজ মামাবাড়ি।

আমার তো মামা বাড়ি নেই।

মা নেই মানেই মামাবাড়ি নেই। শুধু "মামাবাড়ি" শব্দটা আছে। তবে পালকের মামা আছে। মামা বাড়িও আছে। সে মামা বাড়ি গেলে আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

সকাল-সন্ধে পালককে নিয়ে বাজার দিকে। তার হাত ধরে বেড়াতে যাওয়া বলতে পারি। অথবা এও বলতে পারি, সে আমার হাত ধরে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যায়। কত যে প্রশ্ন তার, কত রকম যে কৌতুহল। যেমন, কুকুররা রাস্তায় থাকে কেন? ওদের বাড়ি নেই কেন? তারপরেই প্রশ্ন করলো, ডোডো দাদু, তোমার কি মা ছিল?

আরেকদিন প্রশ্ন নয় আমাকে আদেশ করলো, তার লাঠি দাদুকে একটা ফোন করে দিতে হবে। অনেকদিন আসেনি।

জল কাকু অনেক দিন আসেনি বলো? আমাকে মোবাইলটা দাও, বাবুভাইকে ফোন করবো।

আজ আমাকে বললো, তাকে অনেকগুলো লজেন্স কিনে দিতে হবে। মামাবাড়ি নিয়ে যাবে সে।

মামা বাড়ি।

আমাকে একলা করে মামা বাড়ি।

আমার তো মামা বাড়ি নেই।

মামা বাড়িতে কত আদর আবদার। পালকের মনেই পড়বে না, তার ডোডো দাদুর একলা দুপুর। একলা জল। যা তেষ্টা পেলেও সামনে আসে না। হাত বাড়িয়ে নিতে হয় জলের বোতল।

হাত বাড়ালেও পালক আসবে না মামাবাড়ি থেকে। এখন। সে মামা বাড়ির খেলনা নিয়ে খেলবে সারা দুপুর সারা বিকেল।

আমার তো খেলনা নেই।

কতগুলো বইপত্র খাতা ডাইরি আছে। খেলা যায় না শুধু দেখা যায়। আর হঠাৎ করে পালক কখনো প্রশ্ন করবে----এক কোটি আর ৫০ লাখ কত হয়? আমি চুপ থাকলে সে আমার কাছে চেয়ে নেয় মোবাইল। অঙ্কের যোগ আমাকে দেখায়।

আমাকে আরো প্রশ্ন করে----রাস্তায় পায়রা কি করছে? ওরা কি দোতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমেছে?

ওর জন্য কাল বেলুন এনে দিয়েছি। বেলুনের প্রতি ওর ঝোঁক আমার বেশ ভালো লাগে। যত সে বেলুন ফোলায় ততো রংবেরঙের বেলুন রঙ ছড়ায়।

আমিও রঙে রঙে উড়ে উড়ে ভেসে যাই। একা হয়ে যাই। রঙ যে আমার রঙ নয়। ও যে পালকের।

পালকের রামধনু যে মাটিতেই ওঠে। তার পায়ে পায়ে। তার ছ বছরের রাস্তায়। তার মামা বাড়িতেও রামধনু।

মন্ডা মিঠাই।

আমার তো মামা বাড়ি নেই। দুধের সর নেই। পালক এলেই, তাকে হামি দিতে দিতে সরের গন্ধ পাবো এই আশায় আজকের দিনটা না হয় একলা হয়ে গেলাম।

পালক তুমি হেসো না।

------৯ বোশেখ ১৪৩০
-----২৩--৪--২০২৩
-----নির্মল হালদার



২২.
মাটিতে রামধনু ওঠে

কাছে দূরে একটাও গাছ নেই। কার সঙ্গে কথা বলবে মাধবীলতা?

চারদিকে বাড়ি আর বাড়ি। ছাদে ছাদে পায়রা ওড়ে। কার্নিশে বসে থাকে কাক। ছাদ থেকে ছাদে কথা হয় মহিলাদের। মাধবীলতার সঙ্গে কথা বলে না কেউ।

মাধবীলতা ফুল ফোটায়। ছড়িয়ে দেয় মৃদু সৌরভ। সে পাশের বাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে কথা বলতে চায়। কিন্তু কথা বলে না কেউ। সবাই ব্যস্ত থাকে নিজের নিজের কাজে।

পাতা ঝরার সময় কেউ একজনও তার দুঃখ বেদনার কাছে এসে দাঁড়ায় না। নতুন পাতারা এলেও দেখা যায় না খুশি খুশি মুখ।

মাধবীলতাকে চিঠি লেখে না কেউ।

আমাকেও চিঠি লিখতে বলেছিল। আমিও গুরুত্ব দিইনি। হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়লেই, অপরাধী লাগে। তাকে কখনোই জিজ্ঞেস করিনি----জল খাবে?

সে যে কোত্থেকে সংগ্রহ করে জল, আমি হদিস পাইনি। আমি দেখিও নি তার অভিমান।

অভিমান কি নেই?

হয়তোবা পাতার আড়ালে লুকানো থাকে। অথবা যা অভিমান যতটুকু অভিমান শিকড়ের দিকে চালান করে দেয়।

অভিমান থেকেই কি মাধবীলতা ফোটায় ফুল?

২০--২২ বছর হয়ে গেল আমার ঘরে এসেছে সে। আমি একটুও যত্ন করিনি। আদর করিনি দিনে বা রাতে। তবে লক্ষ্য করেছি, জোৎস্না রাতে কে যেন আসে তার কাছে। নিঃশব্দ।

একদিন মধ্যরাতে দরজায় শব্দ। আমার ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলতেই আমার লক্ষ্য গেল মাধবীলতার নিকটে। মনে হলো, দাঁড়িয়ে আছে কেউ। অস্পষ্ট হলেও একটা অবয়ব যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পাই। অথচ কাছে যেতে পারি না।

কবেই বা কাছে গেছি?

ক্যামেরাম্যান বন্ধু এলে সবুজ খুঁজতে খুঁজতে মাধবীলতার কাছে এসে দাঁড়ায়।

পাখিরাও তো আসে না।

মাধবীলতা নিশ্চয়ই পাখি খোঁজে।

আমাকে কখনো কি খোঁজে?

ও বোধ হয় আমাকে দেখতে পায়। আমার দরজা জানালা বন্ধ থাকলেও ফাঁক ফোকর থেকে নিশ্চয়ই দেখতে পায়, আমি আলস্য উপভোগ করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি।

মাধবীলতার সারাদিনের কাজ বলতে, চারদিক দেখা। তারই সঙ্গে সে চেষ্টা করে, আকাশটা দেখতে।

বড় বড় বাড়ি উঁচু উঁচু অহংকার ভালবাসাকেও আড়াল করে। রাস্তা দিতে চায় না। কেমন করে আসবে মন?

ঝিলম কি আসে মাধবীলতার কাছে? সেই তো তাকে রেখে গেছে আমার ঘরে।

-----দুপুর-১--৪৮
----১০ বোশেখ ১৪৩০
-----২৪---৪---২০২৩
-----নির্মল হালদার




২৩.
মাটিতে রামধনু ওঠে

ডোবাতে জল নেই। শুকনো খটখটে বাঁধ। নদীতো নেই।

রোদের তাপ বাড়ছে।

পাখিদের জন্য জল কোথায়? পোকামাকড়ের জন্য জল কোথায়?

মাঠে চরতে চরতে গাই-গরু- মোষ, ছাগল-ভেড়া কোথায় পাবে জল? ঘুরে বেড়ানো কুকুর ও শুয়োরের জন্যেও জল নেই।

এই নিরণে শুধু গাছপালা সবুজ।

কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছে ঢেউ উঠছে। হাওয়া এসে রঙ ঝরায়। কোনো কিশোরী এসে ফুল কুড়াবে। বাঁশের মাচায় দুলে উঠছে ঝিঙে। গ্রীষ্ম দিনের রোদ উপেক্ষা করে শসার পাশে শসা ধুলা মাটির আদর মাখছে। উচ্ছে লতায় জড়িয়ে পড়ছে কোকিলের ডাক।

হঠাৎ হঠাৎ কোকিলের ডাক এসে ফুলে পল্লবে ও ফসলে জাগিয়ে তুলছে সুর। শুধু জমি থেকে মাথা তুলছে পাথর।

জল নেই।

মেঘের দেখা না পেয়ে পাথরের ঘুম নেই। জল কাদা মাটি পেলে সে স্বস্তিতে থাকে। কেন না, জল কাদা মাটি থেকেই অঙ্কুরের প্রকাশ। যেন বা পাথরেরও সন্তান। তার কোমলতায় পাথরের শান্তি।

অথচ জল নেই। মাঠ ঘাট শুকনো। রোদ জ্বলতে জ্বলতে খড়ের চালাতে। এক চাষীর দুহাতে তরমুজ। আলপথে হাঁটছে।

ক' জনের পিপাসা নিবারণ হবে?

বাতাস ছুটে যায় মরীচিকার দিকে। এক বাগাল ছা জোড় গাছের তলে শুয়ে আছে গামছা পেতে। তার মাথার তলায় লাঠি।

এই লাঠি তাড়াতে পারে না রোদের তাপ। ঝোপঝাড়ের শীতলতা খুঁজছে পোকামাকড়।

উড়তে উড়তে একটি শিশু বক একটি জমিতে নামলো। জলা জমি হলেও এখন একেবারেই শুকনো জমি।

মাছের আশায় দাঁড়িয়ে পড়েছে শিশু বক। যদি ভাগ্যে থাকে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে মাছ। অন্তত একটি পুঁটি মাছ। সে জানে না, ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে গেছে মাটি। জল নেই। কোনো প্রাণের জন্ম নেই।

বকের খিদে একাকী হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে কে জানে!

-----বেলা-১২--৬
-----১১ বোশেখ ১৪৩০
----২৫--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার



২৪.
মাটিতে রামধনু ওঠে

ওই তো ছাদের তারে ঝুলছে একটা রঙিণ শাড়ি। কার শাড়ি। রাস্তা থেকেও দেখা যায় ছাদের তারে ঝুলছে একটা রঙিণ শাড়ি।

হাওয়া এসে শাড়িটাকে উল্টে পাল্টে দেয়। তবু নিজের জায়গা ছেড়ে শাড়িটা যেতে পারে না কোথাও।

রাস্তা থেকেই দেখা যায় তারে এসে বসলো একটা শালিক। সে এদিক-ওদিক চেয়ে উড়েও গেল।

শাড়িটা দুলছে।

শাড়িটা পুরনো না নতুন রাস্তা থেকে বোঝা যায় না। শাড়িটা কার অল্প বয়সী কোনো মেয়ের? মধ্যবয়সী কোন মহিলার? শাড়িটা উড়তে উড়তে ছুঁতে চাইছে কাকে?

যদি আকাশকে ছুঁতে চাইছে?

শাড়িটা কার?

শাড়ির পাড়ে হেঁটে যায় কে?

ঘরে শিশু আছে? সন্তান?

শাড়ির গায়ে ফুলফল আছে?

রাস্তা থেকে বোঝা যায় না।

শাড়িটা দুলছে।দুলতে দুলতে কারো কাছেই যাবে না। শাড়ির মন আছে কি?

রাস্তা থেকে বোঝা যায় না।

রাস্তা থেকে বোঝা যায় না, ছাদের মেঝে কতটা মসৃণ? ছাদের কার্নিশ কতটা পোক্ত? ছাদে কি টাঙানো যায় মশারি?

ছাদে ওঠার সুযোগ আছে কার?

শাড়িটা দুলছে।

মেঘের ছায়া শাড়িতে পড়লে শাড়ির রঙ কি পাল্টে যাবে?

রাস্তা থেকে কিছু বলা যাচ্ছে না।

রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু শাড়িটা দুলছে।

শাড়িটা একা।

----বেলা ---৩--৪২
---১২ বোশেখ ১৪৩০
----২৬---৪---২০২৩
------নির্মল হালদার




২৫.
মাটিতে রামধনু ওঠে

গরমের দিনে ঘুমে আধো ঘুমে মায়ের হাতে ঘুরতো তালপাতার পাখা। দিনে ও রাত্রে একই রকম।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর শাড়ির আঁচল মেঝেয় পেতে শুয়ে পড়তো মা। আর হাতে ঘুরতো তালপাতার পাখা।

সেই পাখাটা কোথায় গেল?

হাটে বাজারে রঙিণ পাখা। তালপাতার পাখা আড়াল হয়ে গেছে। পাখা যারা বুনতো, সেইসব কুটির শিল্পীরা কোথাও কি হারিয়ে গেল?

আমি যে খুঁজছি।

ঘেমে উঠতে উঠতে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই তালপাতার পাখা।

মায়ের কাছে বসলেই, পাখার ডাঁটিতে আমার পিঠের ঘামাচি মেরে দিতো। সেই পাখাও ছিল গ্রীষ্ম দিনের পরম বন্ধু।

কয়লার উনুনে আঁচ উঠছে না পাখা করো। সেই পাখা কোথায় গেল? আমার শহরে আমি খুঁজে বেড়াই, তালপাতার পাখা।

আমাদের ঘর ছিল মাটির খোলায় ছাওয়া। সেইখানে গোঁজা থাকতো দু তিনটে পাখা। কয়লার ধোঁয়ায় কালো। কিন্তু হাওয়া ছিল আলোর মত সৎ ও সুন্দর। বিশুদ্ধ।

সেই বিশুদ্ধতা খুঁজে বেড়াই ঘরে বাইরে।

ঘরে নতুন জামাই এলে কেউ একজন তার সামনে পাখা নিয়ে হাওয়া ছড়ানো।

পাখার হাওয়াও আপ্যায়নের একদিক। ভুলে যাইনি আজও এবং সেই কারণে নিজেকে আপ্যায়িত করতে খুঁজে বেড়াই তালপাতার পাখা।

ছোটবেলায় কৌতুহল থেকে বড়দের কাছে প্রশ্ন ছিল আমার অথচ প্রশ্ন করিনি----তালগাছ তো অনেক উঁচু। কেমন করে পাড়ে তালপাতা? কে পাড়ে?

আম পাতে জামপাতে পাখা হবেনা?

মনে পড়ে, রাগ হলে ঘরের বড়রা পাখার ডাঁটি দিয়েও মেরেছে। মজাটা হলো, পাখা তো শুধু গরমের দিনে। বাকি দিনগুলিতে হাতের মার।

সেসব দিনের কথা মনে পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায়, তালপাতার পাখা হাতে ঘুরতে ঘুরতে, বিশেষ করে মেয়েদের হাতে ঘুরতে ঘুরতে চুড়ি বেজে উঠতো।

সেই সমস্ত চুড়ি কোথায় বাজছে?

সেই সমস্ত হাত কোথায় গেল?

বাজারে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলাম, একটা ঝুড়িতে প্লাস্টিকের পাখার সঙ্গে দু তিনটে তালপাতার পাখা।

নিঃসঙ্গ।

----১৩ বোশেখ ১৪৩০
-----২৭--৪--২০২৩
------নির্মল হালদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ