১৬.
মাটিতে রামধনু ওঠে
জানলায় মুখ।
কার মুখ? অমলের?
না না অমলের নয়।
কার মুখ? কমলের?
না না কমলের নয়।
কার মুখ? বিমলের?
না না বিমলের নয়।
জানলায় কার মুখ?
মেঘের মুখ?
না না।
বৃষ্টির মুখ?
না না।
ঝড়ের মুখ?
না না।
জানলায় কার মুখ?
সারাদিন খোলা থাকে জানলা। আকাশ দেখা যায় না। আকাশ কি তবে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়?
না না।
জানলা দিয়ে কি পালক ফেলে যায় পাখি? জানলা দিয়ে কি রোদের কণা ফেলে যায় রোদ?
একটাই জানলা।
সারাদিন হাওয়া আসে?
না না।
একটাই জানলা।
সারাদিন পাখির ডাক আসে?
না না।
জানলা থেকে পালিয়ে যাওয়া যাবে? জঙ্গলের কাছে যাওয়া যাবে? রাস্তা সহজ তো? স্পষ্ট?
জানলার কাছে রাস্তা আসবে না?
না না।
রাস্তা দুয়ারে আসে। দুয়ার কই?
দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকবে না সুধা?
না না।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকবে না ঠাকুর দাদা?
না না।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকবে না একটা গান?
না না।
পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়াতো, কোন্ ক্ষ্যাপা সে? সেই যে সেই ক্ষ্যাপা আর আছে কি কোথাও? যদি থাকে দাঁড় করাও দুয়ারে।
আমি আসছি----
----৪ বোশেখ ১৪৩০
----১৮---৪---২০২৩
----নির্মল হালদার
১৭.
মাটিতে রামধনু ওঠে
পত্রপল্লবহীন একটাই গাছ এই মাঠে। চৈত্র চলে গেছে। বৈশাখ এলেও নতুন পাতা নেই। নতুন পাখিরা নেই। বাতাস আসা যাওয়া করলেও বাতাসে নেই নতুন সংবাদ।
বৃষ্টি কি কয়েক হাজার বছর নেই?
মেঘেরাও কি বলেনি, প্রেমিক প্রেমিকারা কোথায় আছে? প্রেম আছে তো নিভৃতে নির্জনে?
একটাই গাছ। গাছে একটি কোটর। কেউ কখনো এই কোটরে রেখে গেছে অভিমান? চোখে পড়ছে না কিছুই, শুধু একটি পাথর ছোট্টপাথর চেয়ে আছে চারদিকে। যেন বা কোনো চোখের মনি।
ঠোঁটে তুলে কোনো পাখি নিয়ে যায়নি। কেন না, পাখিরা তো ভুল করেও এখানে ঝাপটায় না পাখা।
পত্রপল্লবহীন একটাই গাছ।
এদিকে পায়ের শব্দ নেই। কথা নেই। দেশ ও দশের বাইরে একটাই গাছ। ফুল ও ফলের রূপ কল্পনাতে নেই।
একবার এক মৌমাছি মধু ঝরিয়ে শুনতে চেয়েছিল গাছের হৃদস্পন্দন। শুনতে পেয়েছিল একলা থাকার বেদনা।
দূরের এক কাঠুরিয়া ঘুরতে ঘুরতে এই গাছের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। যদি হরণ করা যায় দু' চারটে ডাল। কাঠুরিয়ার হাত থেকে ফসকে গেছে কুড়াল।
কাঠুরিয়া ঘুমিয়ে গেছলো গাছ তলায়। এই গল্প ঘুরে বেড়ায় বাতাস থেকে বাতাসে।
এখানে বাতাস কেমন? কোনোদিন বীজ ছিল? এখানের বাতাস কি আব্রু রক্ষা করে?
পত্রপল্লবহীন একটি গাছ আজও মাটি আঁকড়ে আছে।
-----৫ বোশেখ ১৪৩০
----১৯---৪---২০২৩
----নির্মল হালদার
১৮.
মাটিতে রামধনু ওঠে
গ্রাম ছাড়িয়ে আরো কিছুটা দূরে একটি ইঁদারা। গ্রামের মানুষ এই ইঁদারার জল দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে একসময়। পথচারীও দাঁড়িয়ে গেছে হঠাৎ। কোনো মহিলা জল তুলছে তখন, তার কাছে পেতে দিয়েছে আঁজলা।
তৃষ্ণার্তকে শান্ত করেছে এই ইঁদারা কুয়ো। শোনা যায়, ব্রিটিশ সরকার এই কুয়ো খনন করে গেছে। পথিকদের জন্য। বসত গড়ে উঠেছে অনেক পরে। এই কুয়োর জল সুস্বাদু। ভাত ডাল সেদ্ধ হয়। সাবানে ফেনা হয়। এখানে কুয়োর মাথায় প্রাচীন এক শিরীষ গাছ। তার অনেকটা পিছনে একটি টগর ফুলের গাছ। তার নিচে মানতের হাতি-ঘোড়া। মাটির। গোবর লেপা একটি বেদি। সকালে ধূপ জ্বেলে গেছে কেউ। ছাই পড়ে আছে।
শুকনো টগর ফুলে ভরে আছে চারদিক।
ইঁদারা কুয়ো ভেঙ্গে গেলেও জল আছে। অটুট। জলে ভাসছে শুকনো পাতা। আবর্জনাও।
কুয়োতে আর বালতি ওঠে না। নামে না। দাঁড়ায় না পথচারি। গ্রামের মানুষ টিউকলের জল থেকে সারাদিনের কাজকর্ম। কুয়োটা তাদের কাছে আজ দূর দূর লাগে।
এক সময় এই কুয়োতলা ছিল মহিলাদের সুখ-দুঃখের জায়গা। সারাদিন মুখর।
কুয়োর জল মন দিয়ে শুনতো সবার কথা। এখন শুধু মেঘ আসে কুয়োর ভিতরে। কুয়োর বাইরে আসে বৈশাখ থেকে বসন্ত। নীরবে এসে নীরবে চলেও যায়।
রাত্রি হলে মাটির হাতি ঘোড়া কুয়োর জল পান করতে নামে। এবাদে কুয়ো পরিত্যক্ত। একা।
তার নির্জন একাকীত্বের কাছে প্রেম করতে নামে না চাঁদ। কেবল এক পুরনো দিনের গাধা তার পিঠের বোঝা এখানে নামিয়ে চলে গেছে কোথাও।
----৬ বোশেখ ১৪৩০
----২০--৪--২০২৩
----নির্মল হালদার
১৯.
মাটিতে রামধনু ওঠে
বসন্ত কাকা, তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। কোথায় যে থাকো, খুঁজে পাই না। আমি ছটফট করি। এ ঘর ও ঘর করতে করতে রাস্তাতে যাই। প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজি, খুঁজতে থাকি তোমার মুখ।
বসন্ত কাকা, মাঝেমধ্যেই তোমার মুখও হারিয়ে যায়। তখন আম গাছের দিকে চেয়ে থাকি। সে যদি আমাকে দেখায় তোমার মুখ। এই আশাতে গাছ তলায় সারাদিন।
তুমিও তো আম গাছের ছায়া গায়ে জড়িয়ে ধুলোতে আঁকতে তোমার স্বপ্ন। কল্পনা। একদিন।
বসন্ত কাকা, তোমার স্বপ্নেরা কি খুব রঙিণ ছিল? খুব এলোমেলো? তুমিও কি কবিতাকাতর?
কবে যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে?
আমার ঘুম নেই।
তুমি তো জানো, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের দিনগুলি কেমন থাকে পুরুলিয়া! তুমি তো জানো, লু বইতে থাকে প্রায় সকাল থেকেই। আমার মনে আছে, গরম হাওয়ায় বাবার খুব কষ্ট হতো। তাই একটু বেলা হলেই, বাবা ঢুকে পড়তো জেঠিদের ঘরে।
জেঠিদের ঘরটা ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা অন্ধকার। বাবা ঘুমিয়ে পড়তো।
তুমি এখন কোথায় ঘুমোচ্ছো, কোথায় তোমার খাওয়া-দাওয়া, কে জানে! বসন্ত কাকা, এই দুপুরে আসবে আমার কাছে? দুজনে অনেক গল্প করবো।
আমার কাছে আমাদের পরিবারের বিশেষ কোনো গল্প নেই। বরং তোমার কাছেই অনেক ইতিহাস----- শিবপ্রসাদ থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ তুমি বলতে পারবে।
তুমি যেখানেই আছো চলে এসো।
আমাদের গলির আঁধারে হঠাৎ আমি আর তুমি মুখোমুখি কিংবা তোমার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠবো---বসন্ত কাকা আজ আমাদের ঝিঙে পোস্ত। অনেকটা ভাত খাবো। আমরা দুজন। চলো চলো----ঘরের দিকে যাই।
তুমি বৌদির সঙ্গেও কথা বলবে। পুরনো দিনের কথা। নুপুরের সঙ্গে বলবে, আজকের কথা।
কথার তো শেষ হবে না বসন্ত কাকা। তুমি হয়তো জানতে চাইবে, বোঙাবাড়ির ধান জমি কেমন আছে? আমি অবশ্য তার আগেই জানতে চাইবো, তোমার কপালে একটা দাগ কেমন করে এলো?
ঘরের দেয়ালেও অনেক দাগ।
অনেকে আসে অনেকেই স্পর্শ রেখে যায়। ছোটরাও দেয়াল ধরে ধরে বড় হয়ে ওঠে।
তুমি তো সবাইকে চেনো না। তুমি যে অনেক অনেক দিন আমাদের কাছে নেই। আমি তো খুঁজেই চলেছি, আমার যে একটা কাকা দরকার। জেঠাকেও চাই।
আমি যে চাই, আত্মীয় গ্রাম। আত্মীয় রাস্তা। ভালোবাসার অনেক নাম।
শক্তি সন্ধ্যা পারুল প্রতিমাকে মনে আছে তোমার? নারাণকে মনে আছে? আছে আছে। বলো, আছে। তুমি এখুনি বলবে, আমি এই ঘরের একজন। আমি কি আর ভুলে যেতে পারি, লক্ষীর হাঁড়ি।
লক্ষীর হাঁড়িই তো আমাদের সংসার।
তার আগে তোমার সঙ্গে দেখা তো হোক। তুমি নিশ্চয় বিবড়দা সোনামুখী যাওনি। তুমি তো যাবে না মলিয়ান। হেঁসলা যাবে? দেখা হলেই তুমি খুঁজবে মায়ার মত একটি গ্রাম। মায়াই তো তোমাকে ছেলের মত মানুষ করেছে। আমি তো মায়ের কাছে শুনেছি, তুমি ডাল সেদ্ধ দিয়ে মুড়ি খেতে ভালোবাসো।
আমিও।
আমি যে মায়ার সন্তান।
বসন্ত কাকা, আমরা সবাই মায়ার সন্তান। এ কথা ভুলে যাই আর এ কারণেই ভুলে যাই, তিনটে পাতা নিয়ে বেল পাতা।
একসঙ্গে থাকার একটা ছবি।
গাছপালা পাখি পাহাড় নদী পোকামাকড় সবাই আমরা একসঙ্গে। ওরা জল হাওয়া পেলে আমরাও পাবো।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার জল তেষ্টা। বৈশাখ মাসের এই এক স্বভাব, সে সব সময় কাছে এনে দেবে পিপাসা।
শুধু কি জলের পিপাসা?
বৈশাখের দীর্ঘ বেলা একে তাকে খুঁজতে হয়। ভালবাসতে হয়, বট-অশ্বত্থের ঝলমলে রূপ।
তুমি এলেই দেখতে পাবে, আমাদের ঘরের দুয়ারে, এখনো আছে অশ্বত্থ গাছটা। মায়ের চেষ্টাতে একটা জলের হাঁড়ি একটা ডালে ঝোলানো। হাঁড়ির তলায় একটা ছেঁদা। সারাদিন পড়বে ফোঁটা ফোঁটা জল।
বাবা বলে, পিতৃ পুরুষের মুখে জল পড়ছে।
বসন্ত কাকা, তোমার কি জল তেষ্টা পায়? আমার খুব মনে আছে, গরমের রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জল তেষ্টা আমার। মাকে ঠেলা দিয়ে বলতাম---আমার জল তেষ্টা পাচ্ছে খুব। মা বলতো, যা খেয়ে নিবি যা।
আমি খুঁজে পেতাম না জলের কলসি।
আজও খুঁজে পাই না সেই কলসি।
তোমাকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছো কোথাও। তুমি কি একা হয়ে গেছো?
বসন্ত কাকা তুমি তো আমার চেয়ে বড়, তুমি বলতে পারবে, যেকোনো মৃত ব্যক্তি কি একা?
-----বেলা--৩--৫২
----৭ বৈশাখ ১৪৩০
----২১---৪--২০২৩
----নির্মল হালদার
২০.
মাটিতে রামধনু ওঠে
একটা মেঘ এসে চলে গেলে কে একা হবে? একটা বৃষ্টি এসে চলে গেলে কে একা হবে?
মেঘ একা হতেই পারে। বৃষ্টি একা হতেই পারে। কেন না, বৃষ্টি ছুঁয়ে গেল না তোকে। মেঘ ছুঁয়ে গেল না তোকে। ওরা দাঁড়াবে তোর কাছে, এরকম আশা করতেই পারি।
তুই হতাশ হয়ে গেলি। একা হয়ে গেলি। এই একাকীত্ব তোর প্রাপ্য ছিল না।
বৃষ্টি এসে দেখলো না তোকে। মেঘ এসে দেখলো না তোকে। তুই মনমরা হয়ে পড়লি।
অবিন কথা দিয়েও এলো না। অনিকেত ব্যস্ততার অজুহাতে কখনোই আসছে না।
অঙ্গনা সেও তো বন্দী।
তুই একা হয়ে গেলি। তোর কাছে মেঘের ছায়াও থাকলো না। বাপি এসেও চলে গেছে অনেকক্ষণ।
আমি তোর জন্য খুঁজতে বেরিয়েছি একটা ব্যাঙ। সে তোকে বৃষ্টির গল্প শোনাবে।
অনেককাল আগে বৃষ্টি এলেই সবার দুঃখ বেদনা ধুয়ে মুছে সবাইকে সঙ্গ। এই ছিল বৃষ্টির চরিত্র।
বৃষ্টিরা রঙিণ হয়ে দেখাতো প্রজাপতির ফোয়ারা। ঝর ঝর ঝর।
আমি তোর জন্য খুঁজছি একটা কলকে ফুলের গাছ। হলুদ রঙা ফুলগুলি ভালোবাসতে বাসতে তোকে দেখাবে, গায়ে হলুদ।
তুই শাঁখ বাজাবি।
আর থাকবে না একাকীত্ব। আর থাকবে না মন খারাপ।
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, মন খারাপ শুধু ওর কাছেই আসবে? সত্যি করে বলবেন, মন খারাপের আর কোনো জায়গা নেই? হঠাৎ হঠাৎ এসে, কলসিতে ঢুকে থাকবে? এক গ্লাস জল গড়াতে গেলে, শুধু মন খারাপ?
একাকীত্বকে দূরে সরিয়ে রাখলেও মন খারাপ চলে আসে মোষের পিঠে। তখন তাকে মনে হয়, একলা রাখাল। যে সারাদিন রোদের কামড় খেয়েও পায়নি এক ফোঁটা বৃষ্টি।
রাখালকে তুই চিনিস, ওদের কাঁসাই পারের গ্রামে তোকে খাইয়েছিল কচি শশা। মনে পড়ছে? ঘরে ফেরার সময় তোর হাতে দিয়েছিল একটা তালপাতার পাখা। রাখালের তৈরি ওই পাখা তোর কাছে অনেকদিন ছিল। তোকে সঙ্গ দিয়েছে অনেক অনেক রাত। নিদ্রাহীন রাত।
আমি তোকে ঘুমের কথা বলেছি সকালবেলায়। তুই রাজি না হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিস ঘুমের মতো উপহার।
তোকে তো হতেই হবে একা।
এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে আমার, তুই সন্ধ্যা প্রদীপের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলি অনেকক্ষণ তুলসি থানে। আমি সামনে যেতেই তুই ঘরের দিকে চলে গেলি। আমি পেলাম ধূপের সৌরভ।
ধূপের গন্ধ একা। সব সময়। আমি একাকিত্বের ছাই জড়ো করে নীরব হয়ে থাকি।
-----৮ বোশেখ ১৪৩০
-----২২---৪---২০২৩
------নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন