একটা কাপ / নির্মল হালদার
আমি সারাদিনে তিন কাপ চা খাই। যদিও আমার আছে ৫০ টা কাপ। বিভিন্ন রকমের কাপ। নানান জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছি। কিন্তু সব কাপে চা খাওয়া হয় না। সকালের কাপ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। বিকেলেও তাই। বেলা ১১টার পরে আরেক কাপ চা খেলেও কাপের অদল বদল ঘটে না। আখরের এই গল্প শুনে আমার দেখতে ইচ্ছে করলো, কাপের চেহারা। কেননা, আমি আখরের কাছে মাঝে মধ্যেই চলে আসি। আমারও মনে হয়, নানা রকমের কাপের সঙ্গে আমার পরিচয় হোক। যখন আখর চা আনতে যায়, তখন সাধ হয়, আমি কাপটাকে পছন্দ করে পাঠাই। আমি বলার আগে দেখার আগে কাপ চলে যায় নিচে। চায়ের কাছে।
আমি মনে মনে হতাশ হয়ে কাপের রূপ আঁকতে থাকি। সোমবার থেকে রোববার , সপ্তাহের ৭টা দিন একেকটা কাপে একেক দিন চা খাই। কোনোদিন এক কাপ চায়ে মেঘ ভাসতে থাকে। আমি মেঘের গন্ধে
বুঁদ হয়ে ঢলে পড়ি।এত নেশা যে উঠতে পারিনা। কোনোদিন চায়ের কাপে কেবল আকাশ। নির্মল আকাশ। আমাকে ডাকে। আমি কাছে যাই না। শুধু আকাশের দেয়ালে ছবি টাঙাই।
একেকদিন কাপের গায়ে প্রজাপতির রঙ ছড়াই। যদি
প্রজাপতি আসে আরো , আমি সারা ঘরে প্রজাপতির সঙ্গে উড়বো।
একদিন এক কাপ চায়ে লবঙ্গের গাছ দেখতে পেলাম। লবঙ্গের গন্ধে আমি ছুটোছুটি করলাম লবঙ্গ জঙ্গলে। তারপরেই দেখতে পেয়েছি এলাচের গাছ। আমি চা বাগানেও ছুটে গেছি।
আখর আমাকে আনমনা দেখে জানতে চায়----- আমার কি হলো? কারণ, আমি চায়ে চুমুক দেবার সময় একদম চুপচাপ থাকি। আজ একটা কাপ দেখেছি আখরের আলমারিতে। আমার মন খুব টানছিল কাপটার দিকে। তাকে বলার ইচ্ছে হয়েছিল, ওই কাপে আমার চা চাই। বলতে পারিনি।
কীই বা বলতে পারি ? ফাটা কাপে চা দিলেও তো আমি খাই। স্টিলের গ্লাসে চা দিলেও তো আমি খাই।
আমার পছন্দ কি , কি নয় বাকিদের জানবার কথা কি? আমি তো শাল পাতায় ভাত চাই। কে দেবে?
অথবা পদ্মপাতায় মুড়ে কেউ খাবার দিলে আমার খুব ভালো লাগবে। আখর বলছিল, সে এক সেট তামার কাপ প্লেট নিয়ে আসবে। আমার খুব খুশি খুশি লাগছিল। একদিন না একদিন ওই তামার কাপে আমি চা খাবো।
আমারতো কেনার ক্ষমতা নেই। কেবল দেখার শক্তিটুকু আছে। দেখার মন টুকু আছে। অহল্যাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে কোনো কিছু উপহার দিলে বই অথবা কাপ। যদিও সে আজ অব্দি কোনো উপহার দেয় নি। একবার শুধু ক্যাডবেরি খাইয়েছিল।
সেদিন রাস্তার ধারে একটা দোকানের সামনে থমকে গেলাম। কাঁচের শো--কেসে সাজানো আছে বিভিন্ন রকমের কাপ। একজোড়া আমার পছন্দ হলো।
কেনার টাকা নেই। আখর কে বললাম-----সে যদি কিনে ফেলে আমি কাপটাকে দেখতে পাবো। কাপটাতে চা পেতেও পারি।
আপাতত আখরেরও টাকা নেই। সে কিনতে পারবে না।
আমার এই কাপ বিলাসিতার মধ্যে আমার চরিত্র
ধরা পড়ে। কত কত মানুষের ভাঙাচোরা থালা। তাদের দিকে আমি কী তাকাই?
আখর ও আমি প্রায় একই মেজাজের বলে, আমরা একইসঙ্গে প্রতিদিন আড্ডা দিয়ে থাকি। আমরা দুজনেই চায়ের দোকান দিকে না --যাওয়ার চেষ্টা করি।
চায়ের দোকানের গ্লাস কিম্বা কাপ আমাদের পছন্দের বাইরে। নোংরাও হয়। আখর বলছিল, সে ঢোকরার দুর্গা সংগ্রহ করবে। আর আমি মনে মনে বলছিলাম, কাপ সংগ্রহ করবো। কাপেই তো ঠোঁট ছোঁয়ানো রায়।
এক কাপ চায়ে দুজনের ঠোঁট। দুই দিক থেকে। আহা! কি মধুর দৃশ্য। এই দৃশ্য আমি রচনা করতে চাই।
আসলে,কোনো দৃশ্য আমি লিখতে পারি না। একবার ভেবেছিলাম টাকা আঁকতে পারলে টাকা আসবে। অনেক অনেক টাকা। তখন যা ইচ্ছে কিনতে পারবো।
পরে জেনেছি, টাকার ছবি সবচেয়ে কঠিন। টাকা জটিল ও কঠিন বলেই, টাকা আঁকতে যাওয়া বোকামি।
খুব ক্লান্ত লাগছে এখন। জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুর। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে নেয়ে গেছি।
আখর আমার সঙ্গে ছিল। সে অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। অহল্যাকে ডেকেছিলাম। সে বাড়ির বাইরে এই গরমে কোথাও যাবেনা। আমাদের পাগলামির সঙ্গে সে নেই।
চারদিকে বাড়িঘর দোকানপাট। গাছতলা কোথায় গাছতলা? দেখতে পেলাম হাড় জিরজিরে একটা গাছের নিচে এক ভিখারি পরিবার। দোমড়ানো মোচড়ানো থালা বাটিতে ভাত খাচ্ছে।
এই ভাতের গন্ধের কাছে আমি একটু জিরোবো।
-----১৩ শ্রাবণ ১৪২৮
----৩০----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন