ছবি : আলোকচিত্রী সন্দীপ কুমার
মডেল : কবি নির্মল হালদার
আমি যখন মডেল / নির্মল হালদার
আমি যখন মডেল হয়ে উঠলাম ফটোগ্রাফার সন্দীপ কুমারের কাছে তখন আমিও একজন শিল্পী। অথবা সৃজনশীল একজন হয়ে উঠেছি। হয়েওছি। কেননা, সৃজনশীল না হলে আলোকচিত্রীর মনকে বুঝে উঠতে পারবোনা। আলোকচিত্রী যেহেতু ক্যামেরা দিয়ে একটি ছবি আঁকবেন, তখন আমাকে আমার মেধা ও মনন থেকে স্থির হতে হবে। আমার হৃদয় দিয়ে বুঝতে হবে, তিনি কি চাইছেন। পারস্পরিক ভালোবাসা থেকেই, একটি যৌথ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও আমি যখন মডেল আমাকে সচেতন হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আলোকচিত্রীকে সহযোগিতা করে যেতে হবে। তাই সন্দীপ যখন চাইলেন, শালুক ভরা দীঘিতে আমাকে নামাতে। আমি গামছা পরে নেমে গেলাম। তারপর লাল শালুকের মাঝে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সন্দীপের ক্যামেরা ছবি এঁকে চললো একটার পর একটা ।
আলোকচিত্রী চাইছেন, আমাকে বিরাট এক ওজন দাঁড়িতে বসিয়ে ছবি তুলবেন। এখানে আমি যদি
কিন্তু কিন্তু করি, তাহলে আলোকচিত্রী তার লক্ষ্যের ছবিটি পাবেননা। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ,
আমি মডেল। আমিও একজন সৃজনশীল।
আলোকচিত্রীও মডেলের যৌথতার ফসল হয়ে উঠবে একটি ছবি। কিংবা ফটোগ্রাফ। এ কথা বা ভাবনা দুজনের মাথাতেই রাখতে হবে। তবেই প্রকৃত একটি ছবি। সৃষ্টি হবে।
সন্দীপ যখন বললেন, নদীর উপরে যে পাথর সেখানে আমাকে শুয়ে পড়তে হবে। আমি শুয়ে পড়লাম। তার মানে আমার মনকে আমি শুইয়ে দিলাম ক্যামেরার সামনে। ক্যামেরা তার চোখ দিয়ে যেমন ইচ্ছে যেদিক দিয়ে ইচ্ছে ছবি তুলে যাবে।
আমি বলতে চাই, আলোকচিত্রীর সঙ্গে মডেলের বোঝাপড়া থাকা চাই। আমাদের ক্ষেত্রেও মুখে মুখে বোঝাপড়া ছিল না বটে, তবে মনে মনে ছিল। আর ছিল বলেই, সন্দীপ যখন যা বলেছেন, আমি চুপ করে শুনেছি।
একবার এক পাহাড়ের কাছে গিয়ে আমাকে বললেন, ছোট ছোট পাথরে উঠে যেতে। শুয়ে পড়তেও বললেন। আমি কোনো ভাবেই "না" করিনি। আমাকে আরো বললেন, অবিনের কাঁধে উঠে পড়তে। অবিন কাঁধে নিয়ে হেঁটেও যাবে। আমি ভয়ে অস্থির। কিন্তু ভয় করলে চলবে না। আমি জয় মা বলে অবিনের কাঁধে উঠে পড়লাম। অবিন হেঁটে চলেছে। আমার বুক দুরু দুরু। সন্দীপের ক্যামেরা চলছে। না চললে, আমার সৃজনশীলতা ভেঙ্গে পড়বে। আমাকে তাই সৃষ্টিশীল মন নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করছি। কেবল আমার মুখে সংলাপ নেই। পরিচালক যা চাইছেন, আমাকে করে যেতে হচ্ছে।
মুখটা এদিকে হবে না ওদিকে,মাথা কতটা ঝুঁকে থাকবে, আমাকে শুনে যেতে হচ্ছে। কোনো নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। ভুল করলেই দর্শকরা ঢিল ছুঁড়বে।
ওই ভাঙ্গা ঘরটাতে ঢুকে পড়ুন-----সন্দীপ আমাকে নির্দেশ করলেন। রাস্তার ধারে ঘর। ভেঙ্গে পড়া ঘর। ঝুলকালিতে ভর্তি। ঘরের মেঝেতে গোবর। কাদামাটি। সেই ঘরের জানালা থেকে আমাকে মুখ বাড়াতে হবে। সন্দীপ বাইরে থেকে ছবিটা তুলবেন। আমি রাজি। একবারও বললাম না, আর পারছি না ভাই।
আলোকচিত্রী অথবা নির্দেশক যখন ক্লান্তির কথা বলছেন না, আমাকেও বলা চলবে না। আমি মডেল হলেও আমিও শিল্পী।
আমাকে ক্যানভাসে রেখে চিত্রকর রঙ ঢালছেন। আমাকে নড়াচড়া করা চলবে না। কেন না, আমাকে নিয়ে চিত্রকর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করছেন।
আমাকেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। হেরে গেলে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। তো একটি ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে যদি ফটোগ্রাফার মডেল নিয়ে কাজ করেন, মডেলকে অবশ্যই ক্যামেরার সামনে স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে। ভালোবেসে।
একটা জায়গায় অনেক মদের বোতল। মদের বোতল গুলি মাটিতে ছড়িয়ে সন্দীপ আমাকে নির্দেশ দিলেন, তার মাঝে শুয়ে পড়তে। আমি কোনো দ্বিধা না করে শুয়ে পড়েছি।
যে ছবি দেখে পরে অনেকে নাক উঁচু করেছেন। যদিও আমার কোনো শুচিবাই ছিল না। মদ্যপান করবো আর ছবি তুলতে আপত্তি? এরকম মধ্যবিত্ত সুলভ আমার মন নয়। এই কারণেই সন্দীপের ক্যামেরার সামনে মডেল হতে পেরেছি।
আমার মনে হয়েছে, মডেল কোনো পুতুল নয়। মডেল, একজন সৃজনশীল মানুষ। ক্যামেরাম্যান ও মডেলের যৌথ ভাবনা থেকেই ছবি উঠে আসে। সৌন্দর্যের কাছে। মানুষের কাছে।
আমি যে মডেল হতে পেরেছি, এ আমার প্রাপ্তি। আমি যে ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে, ভয় না করে, সংকোচ না করে,জড়তা না রেখে সন্দীপকে একটার পর একটা ছবি দিয়েছি, এ আমার এক জীবনের আলোক প্রাপ্তি। এখানে তাই সন্দীপকেও বলতে চাই, আমার কুর্নিশ গ্রহণ করুণ।
অনেক ছবি। অনেক ঘটনা। অজস্র অভিজ্ঞতা। শেষে একটা গল্প বলতেই হবে, বর্ষা চলছে। সন্দীপ আমাকে নিয়ে মানবাজার। ছবি তুলতে। তো ঘুরতে ঘুরতে
একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। সন্দীপ দেখতে পেয়েছেন একটি বড়ো কচু পাতায় একটি নিঃশব্দ শামুক। আমাকে নির্দেশ করলেন, কচু পাতার উপরে শামুকের কাছে আমার মুখটিকে হাঁ করতে হবে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে তার কথা মান্য করলাম। শামুকের প্রাণের সঙ্গে আমার জীবন এক হয়ে একটি ছবি হয়ে উঠলো। শাদাকালো।
এই ভাবে চলতে চলতে সন্দীপ আমার বন্ধু। আমিও বন্ধু হতে পেরেছি তার কাছে।
একবার এক জায়গায় আমার মুখে সিগারেট। তখন সন্দীপের সঙ্গে আলাপ ছিল না। সিগারেটে টান দিতে দিতেই পরিচয় । তিনি ততক্ষণে ছবি তুলে চলেছেন।
আমার সিগারেট শেষ। সন্দীপ একটার পর একটা সিগারেট আমাকে দিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে আমার মুখ তিনি চাইছেন।
সেই প্রথম আলাপেও আমি সন্দীপের সৃষ্টিশীল মন পড়তে পেরেছিলাম।
----১৮ শ্রাবণ ১৪২৮
-----৪---৮----২০২১
-----নির্মল হালদার





















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন