বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ২০২১

জন্মদিনের গন্ধ / নির্মল হালদার

জন্মদিনের গন্ধ / নির্মল হালদার



অনেকদিন পর বাবা ঘরে ফিরেছে। মায়ের জন্য নিয়ে এসেছে একটা ফুলন পাড় শাড়ি। মা আরও চেয়েছিল, একটা টিনের বাক্স। ফুল আঁকা। সেও নিয়ে এসেছে বাবা। মায়ের জন্য গন্ধতেলও নিয়ে এসেছে। সবকিছু দেখেও মা গদগজ করছিল, ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা কিছুই আনেনি।

ছেলেমেয়েরা বাবার পোঁটলা পুঁটলি খুলে খুলে দেখছিল। তবে আমার জন্য নিয়ে এসেছে একটা চাকা। কাঠের। হাতে পেয়েই আমি চাকাটা চালিয়ে নিয়েছি। বেশ সুন্দর। ধুলা কেটে কেটে এগিয়ে যায়।

বাবা বলছিল, ও দেশে আবার গেলে আমার জন্য নতুন একটা জামা এনে দেবে। আর দিদিদের জন্য শাড়ি। কাজ ফুরিয়ে গেছলো বলে,তেমন কিছু টাকা পায়নি। নইলে, ও দেশের মন্ডা নিয়ে আসতো।পাপড়ি নিয়ে আসতো। খুব ভালো খেতে।

যা পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। দিদিরা অবশ্য মুখভার করছিল। তাদের কপালে কিছুই জুটলো না। বাবা হাসতে হাসতে বলে, দাঁড়া এখান থেকেই তোদের জন্য নতুন কাপড় এনে দেবো।

অনেকদিন পর আমি বাবাকে পেয়েছি বলে, বাবার পিছু ছাড়ছি না। বাবা যেখানেই যায় সঙ্গে আমি। মা বারণ করে। বলে----তোর বাবা কাজে যাচ্ছে। কাজ খুঁজতে ও যাচ্ছে। তুই সঙ্গে যাবি কেন? তুই ঘরে আয়।
আমি শুনি না। বাবার সঙ্গে থাকলে, বাবা এটা সেটা কিনে দেয়। সেদিন তো দু' পয়সার কুল কিনে দিলো। তারপরেই দু পয়সার নিমকি--বোঁদে।

বোঁদে খেয়ে বোঁদের রস বাবার কামিজে মুছে দিলাম। বাবা হাসলো। বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে আমাকে চা-ও দিয়েছিল। যদিও আমি চা খেতে খুব একটা অভ্যস্ত নই। কিন্তু খেয়ে দিলাম। বাবা ও বললো, খেয়ে নিতে।

বাবা অনেকদিন পর এসেছে বলে, আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়া লাটে উঠেছে। বাড়িতে সব সময় খুশি খুশি ভাব। কাল বাড়িতে মাছ হয়েছিল। পোরশু ডিম হয়েছিল। আমি আধটা ডিম পেয়েই অনেকটা ভাত খেয়ে ফেলেছিলাম। কাল মাছের কাঁটা বেছে দিয়েছিল মেজদি। কাঁটাতে আমার খুব ভয়। একবার গলায় লেগে বিপদ হয়েছিল। আরেকবার মায়ের কোলে থাকতে-থাকতে চোখ উল্টে দিয়েছিলাম। সবার কান্নাকাটি। ভাবছিল, আমি মরে গেছি।

আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। পাড়ার স্কুলে যাই। বারো মাস সকালে স্কুল। আমি আঁধার থাকতেই উঠে পড়ি। আর উঠেই কাঁদতে থাকি। মাকে বলি, স্কুলে যাবো না। মা-ও বলে, ঠিক আছে যেতে হবে না। তুই এখন ঘুমো। আমি আবার ঘুমোবো না। স্কুলেই যাবো।

বাবা এসেছে বলে, সত্যি সত্যি আমি এখন স্কুলে যাচ্ছি না।

বাবা ভোরে ওঠে। মা বলছিল, গ্রাম থেকে যে সমস্ত ঝুড়ি ঝুড়ি চাল আসে , বাবা লোকের জন্য কিনে দেয়। এজন্য পয়সা পেয়ে থাকে। ও দেশ থেকে বাবা তেমন কোনো টাকা পয়সা আনতে পারেনি। তাই বাড়িতে এসে কিছু কাজকর্ম করার চেষ্টা। নইলে যে সংসার চলবে না।

দিদিরা ঠোঙা করলেও চাল ডালের দাম ওঠে না। ভাবে অভাবেও বাবার মুখে হাসি থাকে। কখনোই আমাদের ভাইবোনদের ধমক দেয় না। বিশেষ করে আমি ভাইবোনদের মধ্যে ছোট বলে, মা-বাবার কাছ থেকে আস্কারা পেয়ে থাকি। সবার কাছ থেকেই আদর  পেয়ে থাকি। এ কারণেই, চোর-পুলিশ খেলতে আমার বাধা নেই। এবং খেলতে খেলতে সন্ধে হয়ে যায়।

খেলা শেষে ঘরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ি। বাবা ও মা আমাকে ঘুম থেকে তুলে খেতে বলে। আজ বলছিল, কাল বাদে পোরশু আমার জন্মদিন। ন'টা তরকারি পায়েস করার মতো সামর্থ্য নেই। শুধু কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে আসবে মা।

তারপরেই, মায়ের চোখে জল। দুধ কিনতেও পয়সা লাগবে। বাবা বললো, দুঃখ করোনা। একদিন
ভগবান মুখ তুলে চাইবে। দেখো। হাসি ফুটবে সবার মুখে। আমার মেয়েদের ঠোঙা করতেও হবে না।

আমি ঘুম চোখেই শুনে ফেলেছি আমার জন্মদিনের কথা। গেল বার মা আমাকে কপালে চন্দন দিয়ে খেতে দিয়েছিল। বাবা ছিলনা। তবে চিঠি লিখেছিল একটা মাকে। মা পড়তে পারে না বলে বড়দা পড়ে শুনিয়ে ছিল। চিঠিটা ছিল এই রকম---------ছোট বউ এই শ্রাবণ মাসে ঘর যেতে পারলাম না। এদিকে বর্ষা খুব।
পুরুলিয়াতে জল হচ্ছে কী?

দত্তবাবু বলছিলেন, একেবারে পুজোর সময় যেতে। তাই হয়তো যাবো। ততদিন তোমরা ভালো থেকো। আর এমাসে গোরার জন্মদিনটা পালন করবে। তার জন্য আমার আশীর্বাদ রইলো।

চিঠিটা শুনতে শুনতে মা কেঁদেছিলো খুব। বলছিল, গোরা বাপের সঙ্গ পেলো না তেমন।

এ বছর তো বাবাকে পেয়েছি। মাকে বলবো, জন্মদিনে
বাবা আর আমি একসঙ্গে খাবো।

মা বলছিল, কিছু করি বা না করি পায়েস একটু রাঁধতেই হবে। জন্মদিনে পায়েসটা শুভ। বাবা বললো, তুমি চিন্তা করোনা আমি এক পুয়া আতপ চাল এনে
দেবো।

আমি আজ থেকেই পায়েসের গন্ধ পাচ্ছি।



-----১৯ শ্রাবণ ১৪২৮
-----৫---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ