মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব



৫৩.
ছেঁড়া শাড়ির পাড় থেকে সুতো টেনে
ছুঁচের ফাঁকে সুতো পার করে সন্ধ্যা পারুল।
বুনন করবে চটের আসন।

কুটুম এলে বসতে দিবে।

তুলিন--বেগুনকোঁদর থেকে বরপক্ষ আসবে
মেয়ে দেখতেও। দু বোন সাবধানী তাই,
আঙুলে যেন না--ফোটে ছুঁচ।


৫৪.
গ্রাম থেকে এসেছে চাল

মহাজনের জন্য মেপে দিলে
মজুরি পাবে দু চার আনা পয়সা।
ছেলেরও আবদার মেটাবে
ময়রা দোকানে দু পয়সার নিমকি--বোঁদে।


-----১৬ ভাদ্র ১৪২৮
----২---৯---২০২১


৫৫.
পুকুরঘাটে নেমেছে মেয়েরা স্নান করতে

ফুটে ওঠা লাল শালুক লাজুক বৌয়ের মত
কথা বলছে মেয়েদের সঙ্গে।
মেয়েরা সাত জন্মের ননদিনী, হাসাহাসিও করে।

হাসি ও কথার ফাঁকে সাবান পিছলে পিছলে যায়।

হাঁসগুলি করে জলকেলি।



৫৬.
গাঁ থেকে শহরে এসেছে গরুর গাড়ি।
দোকানদারের মাল যাবে গাড়িতে। এখন
গরু দুটি খড় চিবোয়।বিড়ি টানে গাড়োয়ান।


আশ্বিনের আকাশ।

নির্মল বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ।
অপরাজিতার রঙ টলমল করে। শালুক ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন।

দোকানের মালপত্তর কেনার ফাঁকে
দোকানদার বৌয়ের জন্য কিনে ফেলে
আলতা সিঁদুর শাড়ি।


-----১৭ ভাদ্র ১৪২৮
-----৩----৯----২০২১


৫৭.
ক টা সিঁড়ি উঠে এলাম
মনে নেই রে ভাই।
মনে আছে, কতটা বয়স
পার হয়ে এলাম। এবার
কাঁধের হাল কাঁধে থাকবে তো?

সংসার তো চলছেই না।

রান্নার তেলটা পেলেও
লম্ফ জ্বালতে তেল নাই, গমটা পেলেও
চাল নাই। জলের হাঁড়ি
শুধু ছেঁদা হয়ে যায়। এবার
কাঁধটাও যে ভারি লাগছে ভাই।

কার ভরসায় কাঁধের ভার মাটিতে নামাই?



৫৮.
ভাদরের রোদে
গাছেই সেদ্ধ হয়ে যায়
জনারের দানা।
রোদের যা তেজ
ধানের গোড়াও ফেটে যায়।

বাঈদ জমিতে জল ছিটতে হয়

পোকা লাগে ধান গাছে
আগাছার জন্ম হয়
ঘরে চালের অভাব
ঘাস বিকতে চলে যায় বউ।


-----১৮ ভাদ্র ১৪২৮
-----৪---৯---২০২১


৫৯.
বর্ষা আসছে বউ
ঘুঁটে--কয়লা তুলে রাখ।
দেখেছিস তো, আমাদের ঘরে জল
বাইরে জল, জলে জলে জলময় হয়ে ওঠে
আমাদের ঘর উঠান।

ঘুঁটে --কয়লা তুলে রাখ
আগুনটা তো জ্বালতে হবে
ছেলেপিলেদের নিয়ে বাঁচতে হবে।

মাথায় তো আর কড়িকাঠ নেই যে
গুঁজে দিবি উনানে।ৄ্



৬০.
তুই আর আয়না দেখিস না
তোর রূপের কাছে দাঁড়ালে রোদ ঝলকায়।
তোর মুখের কাছে দাঁড়ালে
প্রজাপতি মুখ দেখে।

আমাকে দেখ তুই, আমি কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেলাম, যে দড়ি
বাঁধতে পারেনা পিরিতির ছলাকলা,যে দড়ি
বিনা আগুনেই জ্বলে উঠবে

তারপরেই তো অন্ধকার।


-----২০ ভাদ্র ১৪২৮
-----৬---৯---২০২১


৬১.
সংসার তো আর দুধ জলের নয় যে
জলটাকে বাদ দিয়ে দেবো! সংসার ভাসছে শুধু
জলে জলে। থালাটাও নেই যে ভিক্ষে করবো,
থালাটাও ভাসছে জলে জলে।

বাটিটাও ডুবে গেছে।

ঋণ ধারে আমিও ডুবে আছি। ডুবতে ডুবতে
আকাশের তারা আর দেখতে পাবো না।



৬২.
মহুলের রস কপালে আর নাই

দেনার দায়ে গাছটাকে বিকতে হয়েছে।
মনে হয়, গাঁইতি--কোদালও ওজন দরে
বিক্রি করতে হবে। কাজও নাই
শহরে বাজারে।

ফুল ফলের আশায়, যদি পায়ের তলার মাটিতে
গাছ লাগাই, আমি দাঁড়াবো কোথায়?


-----২১ ভাদ্র ১৪২৮
-----৭----৯---২০২১



৬৩.
সূর্য গেল পাটে

গাছে গাছে গোধূলির আলো
মায়াবী নির্জনতা
ঘরে ফিরছে পাখিরা।

পাকা ফসলের গন্ধ
ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি
ঘাসে ঘাসে হাওয়া

মাঠের পরে মাঠ
তাল খেজুরের গাছ
গরুর গাড়ির মন্থরতা।

বাবার কাঁধে ছেলে মেলা থেকে ফিরছে
বাবার কাঁধে ছেলে ঝুমঝুমি বাজায়।



৬৪.
আমি যতই ছোটখাটো হই শরীরে তাকত আছে।
আমি কাম--কাজেও দড়।

একদিনেই দশ চৌকা মাটি কাটতে পারি।

আমাকে কাজ দিয়ে দেখো, আমার শরীরের ঘাম
কথা বলবে।


-----২২ ভাদ্র ১৪২৮
----৮----৯----২০২১



৬৫.
শিল--নোড়ার শব্দ হলে
হলুদ মশলার গন্ধ পাই।
বঁটিতে সবজি কাটার শব্দ হলে
বঁটির ধার দেখতে পাই।

যে যার কাজ করতে করতে ঘরের রোশনাই।

ও বউ, হাতা খুন্তিও আমাদের আত্মীয়।



৬৬.
বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে।

আকাশ মন মরা
মাটিও ধূসর
হাওয়া নেই কোথাও

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

আবছা গাছপালা
পাখিদের আসা-যাওয়া নেই
আবছা রোদের আলো

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

ফুল ফলের রঙ ফিকে হয়ে আসছে
ধুলোবালির স্তব্ধতা
নদীও থেমে পড়ছে কোথাও

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

বাবা ও মেয়ে
মেয়ে ও বাবা

একা।

বটের ঝুরি নামছে।


-----২৪ ভাদ্র ১৪২৮
-----১০---৯---২০২১



৬৭.
কিসের মাগো তুই
ছ মাসের শিশুকে মাড় দিচ্ছিস?
বুকে যদি দুধ নাই, যদি গরুর দুধ কেনার
পয়সা নাই, ছাগল মাকে খুঁজে দেখ,
দাঁড়িয়ে আছে কোথাও

দাঁড়িয়ে আছে তোর ছানাকে দুধ দেবে।



৬৮.
সন্ধ্যা হলো গো প্রদীপটা জ্বালাও।
পূর্বপুরুষকে আলো দেখাও।
আলোর পথ ধরেই,
পিতৃ কুল মাতৃ কুল এসে দাঁড়াবে।

কেউ এক আঁজলা জল চাইলে দাও।
কেউ শিশির জল চাইলে দিও।
তৃষ্ণার কাছে আলো জ্বালালে
শান্ত হয়ে ওঠে এই জন্ম গত জন্ম।

দুধের মত আলো মাটিতেও বইবে।


-----২৭ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৩----৯----২০২১



৬৯.
তুই চাইলে,
ছেঁদা কলসিতে জল আসবে।
তুই চাইলে,
আগুন ছাড়াই রান্না।

তুই আয়লো

আমাকে দুমুঠো না -দে
হাঁস--মুরগিকে দে।
সারাদিন ওরা লাফালাফি করছে।
সারাদিন ওরা আমাদের কাছেই।

তুই আয়লো

তোর দু হাতেই তো আমার বেড়।



৭০.
গরুটাকে জল দেখালে?

আমি না হয় খুঁজে খাবো
গরুটাতো আর খুঁজবেনা।
না চাইলেও
ঘরের গাছটাকে যেমন জল দাও
তেমনি
ঘরের গরুটাকেও জল দেখাও

জলের জীবনেইতো যোগ হয়
আরো অনেক জীবন। জলের জীবনেই,

প্রাণের স্পন্দন।


-----২৮ ভাদ্র ১৪২৮
----১৪----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ