সুবোধ বাঁধ ধারে যেতে ভয় পাচ্ছে। যদি পুলিশ ধরে।
যে গাঁয়ে কোনো কালেই পুলিশ দেখা যেত না, সেখানে এখন
পুলিশ এসে ঘোষণা করে যাচ্ছে,
বাড়ির বাইরে কেউ ঘোরাফেরা করবেন না। অন্যথায় জরিমানা হতে পারে।
বাঁধতো যেতেই হবে।
সকাল সন্ধ্যা দুবার। তাদের তো আর পায়খানা নেই। এখন পায়খানা করতে বসলে, পুলিশ যদি ধরে? এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সুবোধ বাঁধের দিকে হাঁটতে থাকে।
নতুন করে এসেছে, করোনা ভাইরাস।ই বার ত গাঁয়ে গাঁয়ে
নিউমোনিয়া। টাইফয়েড। ইনফ্লুয়েঞ্জা। একদম গেবে গেছে।
হেলথ সেন্টারে ডাক্তার নেই। নার্স নেই। এমন কি ওষুধ পর্যন্ত নেই।
বড় বিপদে পড়েছে গাঁয়ের মানুষ।
শহরেও নাকি ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। কি করবে সুবোধরা?
১৫ দিনের লকডাউন। কামকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে যেটুকু চাল আছে, সেদ্ধ করে দুবেলা। কালকে শেষ হয়ে গেছে আলু। আজ অনিলের ঘর থেকে ভেন্ডি এসেছিল। তাই ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে খাওয়া হয়েছে।
কাল যদি নুনের পয়সা না থাকে?
লকডাউন যদি বাড়ে ধুলা মাটি খেয়ে থাকতে হবে। দিন মজুরদের কথা কে আর চিন্তা করে! ভোটের সময় বাবুরা সব বড় বড় কথা বলে যায়। তারপর পাঁচ বছর আর দেখা নাই।
ইবার মনে হয় ঘাসের বিচ খেতে হবে। ত মাঠে ত ঘাস নাই। জুটছে নাই গরু ছাগলের।
বাবুদের এত বড় বড় কথা, তারা কি পারে নাই, ভাইরাস আটকাতে?
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অস্বস্তি নিয়ে ভয় নিয়ে সুবোধ বাঁধে পৌঁছে দেখে, গাছে গাছে আঁধার। অস্পষ্ট হয়ে গেছে বাঁধের জল। পায়খানা করে জলের কাছে যাওয়া যাবে তো? সুবোধের ভয়ডর থেকে
আকাশে দেখা গেল একটি দুটি তারা।
-----১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৬----৫-----২০২১
----নির্মল হালদার
লকডাউন// দুই
ছড়রা স্টেশনেই থাকে এই কয়েকটি পরিবার। ভিখারি পরিবার। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে
একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে
এদের বসবাস।
প্যাসেঞ্জারদের কাছেই এই ভিখারির দল হাত পাতে। আর
দু মুঠো চাল ভিক্ষা করতে ছড়রা
গাঁয়ের ভিতর দিকে যয়।
কোনো কোনো ঘর থেকে
চালের সঙ্গে আলুও দিয়ে থাকে।
ওরা খুশি হয়।
একদিন বলরাম ওর বউকে বলছিল ফিসফিস করে, হ্যাঁগো
নুন চাইলে হয় না? বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বলরামের মুখ বন্ধ করে।
এই বলরামের পরিবার আরেক গাঁ থেকে ভাগ্য অন্বেষণে গ্রাম শহর ঘুরতে ঘুরতে এই ছড়রা স্টেশনেই শেষ অব্দি গেড়ে বসেছে।
মাথায় ছাদ নেই। শুধু গাছতলা।
শুধু বলরামের পরিবার নয়, আরো কয়েকটি পরিবার। ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে যেদিন যেটুকু পায়, চলে যায় এদের।
এরা সুখ জানে না। দুঃখ জানেনা।
এদের কাছে কেবল অভাব। এরা
ভোটাধিকারের বাইরে। তাই, রাজনৈতিক দলগুলি এদের কাছে এসে দাঁড়ায় না।
এদের কাছে স্বেচ্ছাসেবী দল নেই।
এদের মাথায় তেল নেই। পরনের জামা কাপড় ছেঁড়া। ময়লা।
এরা কখনো কখনো এক মালগাড়ির ড্রাইভার এর কাছ থেকে 50 টাকা করে পায়। সেই
ড্রাইভার একবার এদের দিয়েছিল
কয়েকটা কম্বল।
বলরামের দল দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল।
ভাগ্যিস কেউ বলেনি, ভিখারির আবার আশীর্বাদ!
এই ভিখারির দল হঠাৎ শুনলো,
নতুন করে শুনলো, ট্রেন আর আসবেনা। দু-একটা প্যাসেঞ্জার চললেও দাঁড়াবে না এই স্টেশনে।
কারণ, লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেছে। ভিখারিদের মনে হলো,
তাদের মাথায় বাজ পড়লো আরেকবার। গতবছর লকডাউনের সময় কি কষ্টে যে কেটেছে। অনেকদিন তেঁতুল পাতা
চিবিয়ে দিন কাটিয়েছে। মনে আছে তাদের, ছড়রার এক ঘরে
সজনে পাতা খুঁজতে গিয়ে ছিল।
সেদ্ধ করে খাবে। কিন্তু ওদের শুনতে হয়েছিল, ধুর ধুর---------।
ওরা অপমানে , লজ্জায় ফিরে এসেছিল গাছ তলায়।
ভিখারিদের ও অপমান লাগে।
লাগেনা?
এবারে কি হবে? কারা দেবে পয়সা? ছড়রার মানুষ ভিক্ষা
দেবে তো?
ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের ওঠানামা থাকবে না। কি করবে বলরামরা?
দু-তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পর
বলরাম তার বউকে নিয়ে পুরুলিয়া শহরে এসেছে। বউয়ের কোলে ছোট্ট শিশু।
শিশু কি ভিখারী হয়?
কোলের শিশু কি ভিখারী হয়?
শহরের এক গলিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের কাছে বলরামের বউ হাত পাতে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলে, এখন আবার কিসের ভিক্ষা---------
লকডাউন চলছে তো----------
----২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৭---৫---২০২১
-----নির্মল হালদার
লক ডাউন// তিন
সকাল ৭ টা থেকে ১০টা। বেলা ১০টা থেকে বিকেল ৫টা।কোনো কোনো দোকান বেলা ১২টা থেকে
বেলা ৩টে।
খিদের তো নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। হোটেল তো সব সময়ের জন্য বন্ধ। কি করবে রাস্তার গরু? রাস্তার কুকুর?
হোটেলের এঁঠো কচি শাল পাতা
চিবানোর সুযোগ নেই গরুদের।
শাল পাতা চেটে খাওয়ার সুযোগ নেই কুকুরদের।কি করবে এই সব
প্রাণীরা?
মন্দিরের চাতালে বসে এক বৃদ্ধা মহিলা মাস্ক সেলাই করছে।
ছুঁচ- সুতো পেলো কোথায়? মাস্ক
কেনার জন্য পয়সা নেই যখন, তখন ছুঁচ--সুতো পেলো কোথায়?
এই বৃদ্ধা মহিলার আহার জুটছে কী?
যেটুকু বাজার খোলা আছে এখন
শুধু ছুটোছুটি। গায়ে গা ধাক্কা। যেনবা বাজার হাট বন্ধ হয়ে গেলে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে!
কিন্তু গরু কুকুর শুয়োর এরা খাবে কোথায়? এরা যাবে কোথায়?
একটি পঙ্গু লোক হাতে ভর দিয়ে চলেছে রাস্তায়। দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। সারা শরীরে জীর্ণতা।
কোথাও কোথাও থেমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বাজারিদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
এই মানুষটি থাকে কোথায়?
এই মানুষটির কেউ আছে?
ঘর আছে?
কে দেয় দু মুঠো?
মানুষটার হাতে একটি কালচে স্টিলের গ্লাস। মাঝেমাঝেই গ্লাস ঠুকে ঠুকে রাস্তায় চলেছে।
কারোর কাছে কিছু চাইছে না।
মানুষটি কি জানে, লকডাউন কাকে বলে?
দশটা বেজে পার হয়ে গেছে, মিষ্টির দোকানের শাটার খুলছে এবার। মানুষটি এক মিষ্টির দোকানের কাছে এসে, গ্লাস দেখিয়ে বলে, একটু জল দিবে বাবু জল?
দোকানের মালিক মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, এই দোকান খুলছি,
তুই কে রে লাট সাহেব জল খুঁজতে চলে এলি? যা ভাগ------
ভাগ্-----------।
-----৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----২১---৫----২০২১
-----নির্মল হালদার
লকডাউন// চার
পুলিশ আসছে-----পুলিশ আসছে
একটা রব উঠলো বাজারে।
তড়িঘড়ি সবজি বিক্রেতারা গোছাতে শুরু করলো। পুলিশ এসে পড়লে, পিঠে পড়বে লাঠি।
যেটুকু সবজি আছে ফেলেও দেবে।
রাধি মাহাতান কমলা মুদি এসেছে দূর গাঁ থেকে। ভোরবেলা। জলদি জলদি বিক্রি করে ফিরে যাবে ঘরে।
৫ কিমি রাস্তা হেঁটে এসেছে। যাওয়ার সময় টোটো তে যাওয়া।
সেও ভাগ্য ভালো থাকলে পাওয়া যায়। বেলা নটার মধ্যে বেচাকেনা
হয়ে গেলে ভালো। কিন্তু আজ
খদ্দের নেই। কমলার দুটো কুমড়ার বিক্রি হয়েছে একটা। আরেকটা কাটা অবস্থায় পড়ে আছে। বিক্রি না হলে, ঘরে নিয়ে যাওয়া মানে ইঁদুরে খাবে। রাধি
বুড়ি নিয়ে এসেছিল এক কেজি বেগুন। যদি ১০টা টাকাও হয়। সেও পড়ে আছে২৫০র মত। আর আছে গাঁয়ের জমি থেকে তুলে নিয়ে আসা গিমা শাক। কেউ
ভুলেও দেখছে না।
রাধি বুড়ি ও কমলার চোখেমুখে
চিন্তার রেখা।
খদ্দেররা ছুটছে।
একজন তো একটা লাউ ------দু কেজির মত হবে------১০ টাকায়
এক খদ্দের কে দিয়ে দিলো। অথবা বলা যায়, দিয়ে দিতে বাধ্য হলো।
পুলিশ এলেই সব লুটপাট হয়ে যাবে।
এক জেলেনি ১কে জি মাছ অর্ধেক দামে বিক্রি করে ঝুড়ি মাথায় ঘরের দিকে। সে মনে মনে
হায় হায় করছে। মনে মনে বলছে,
ই লকডাউন কবকে শেষ হবেক?
কবকে? কম দামে বিনা লাভে ই ভাবে বিকলে পুঁজি পাটা শেষাবেক।
পুলিশ পুলিশ
রব উঠছে আবার।
দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকলো। চা-ওয়ালা কোনভাবে
সমস্ত গুটিয়ে দৌড়াচ্ছে।
পুলিশ এসে পড়লে কোনো কিছুই আস্ত থাকবে না।
মুখে মাস্ক হাতে বাজারের ব্যাগ
একটা লোক এ সময় এসে বলে,
পালা পালা------পুলিশ চলে এসেছে।
কে যে বললো মুখে মাস্ক থাকার জন্য কাউকেই চেনা যাচ্ছে না।
রাস্তায় শুয়ে থাকা গাই গরু এবং কুকুর নির্বিকার। তাদের ছুঁতে পাচ্ছে না কোনো ভাইরাস। যে ভাইরাসের কারণে আইনকানুন।
খিদে কী আইন-কানুন মানবে?
নাকি মানা যায়?
তেলেভাজার দোকানে এক খদ্দের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চপে কামড় দেয়। তখনই পুলিশ এসে
তার পিছনে মৃদু আঘাত করে। লাঠিতে। বলে----বাড়িতে গিয়ে খেতে পারিস না? দোকানিকে বলে, উনানে কী জল ঢালবো?
কটা বাজছে দেখেছো?
পুলিশকে দেখে মুহুর্তের মধ্যে বাজার ফাঁকা। কমলা ও রাধি বুড়ি ঝুড়িতে সাজাচ্ছে বাকি সবজি। পুলিশ এসে রাধি বুড়ির
গিমা শাক যেটুকু ছিল লাঠিতে উঠিয়ে রাস্তাতে ফেলে দেয়।
বুড়ির বুক কাঁপতে থাকে।
ভোরের আঁধার থাকতে-থাকতে
তুলেছিল শাক। যদি কটা পয়সা হয়, ঘরের কাম কাজে লাগবে।
সেও গেল।
সে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, হ্যাঁ বাবারা ই কটা শাগ
ফেলে দিয়ে কি লাভ হলো তোদের?
-----১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৫---৫---২০২১
----নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন