শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১

১লা আষাঢ় / নির্মল হালদার

১লা আষাঢ় / নির্মল হালদার



মা অনেকবার বলেছিল, বাড়ি যাওয়ার জন্য। মৃত্তিকা বলেছিল, বাড়ি যাওয়ার জন্য।

ফোনের পর ফোন এসেছে। কাল রাতেও মা ফোন করেছিল। যেন সকালের বাসে চলে যায় পালং।

সে গেল না।

কলেজে পরীক্ষা আছে। তারপর
নিজেই সে ঠিক করেছে, কোপাইয়ের দিকে একা একা গাছ লাগাবে। রাতের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া। বাড়ি চলে গেলে কথার খেলাপ হবে।

গাছেরাও কী মনে করবে?

মাটিও কী মনে করবে?

পালং যে নিজের কাছেও কথা দিয়েছে, আজ গাছ লাগাবে। গাছ না লাগালে, বৃথা যাবে দিন।

রাত থেকেই বৃষ্টি চলছে। সকালেও বৃষ্টি। অবিরত।

কোপাইয়ের দিকে যাবে কি করে?
বৃষ্টি আটকাবে না ছাতায়। হেঁটে গেলে বা সাইকেলে গেলেও ভিজতে হবে।

সঙ্গে থাকবে গাছের চারা।

আম আর জাম।
কাল একটা নার্সারি থেকে
কেনা হয়েছে। বন্ধুরা বলছিল
বট অশথ কেনার জন্য। ফরেস্ট থেকে পাওয়া যায়।
পালং বলে, বট অশথ থেকে ছায়া পাওয়া যায়। আর আম জাম থেকে শুধু ছায়া নয়------
ফল পাবে মানুষ।

বন্ধুরাও বলেছিল, তার সঙ্গে যাবে গাছ লাগাতে। কিন্তু এত বৃষ্টি ।কেউ ফোন ধরছেনা। সবাই বোধ হয় ঘুমোচ্ছে।
পৃথা ফোন করেছিল। সে এই বৃষ্টির মধ্যেই যেতে রাজি। পালং তাকে নিয়ে যাবে না।

একবার বৃষ্টির মধ্যে খোয়াইয়ের দিকে পালংকে জড়িয়ে ধরেছিল।
পালং উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁপ দিয়েছিল খোয়াইয়ের জলে। বৃষ্টির জলে।
সে তাই খানিক ভয় করে পৃথাকে।

মনেপ্রাণে জড়িয়ে গেলে, মৃত্তিকাকে প্রতারণা করা হবে।

দূরে দূরেই থাকতে চায় পালং।

মেসবাড়ির বাকি তিন বন্ধু ঘুমোচ্ছে। সে হিটার জ্বালিয়ে
নিজের জন্য চা বানালো। চা খাওয়ার আগে মনে মনে প্রণাম জানালো মাকে। প্রতিদিনের মতোই। এইটে তার অভ্যেস। এই অভ্যেস থেকে পালং কোথাও যেতে চায় না।
সারাদিন তো আর মাকে মনে পড়ে না। অন্তত সকালবেলায় একবার। যে মা তাকে মানুষ করেছে একা একা।

বাবা চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলেন। মাকে বহন করতে হয় সংসারের বাকি কাজ কর্ম। এমনকি পালংকে টাকা পাঠায় মা। বাবা দশেমাসে ফোন করেন।

বেলা হয়ে গেল।

পালং একটা ব্যাগের মধ্যে গাছের চারা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

শান্তিনিকেতন এমনিতেই নিরিবিলি খুব। শান্ত। এই বৃষ্টির মধ্যে আর লোকজন দেখা যাচ্ছে না। কেবল কোপারেটিভ মোড়ে একটা টি স্টল খোলা আছে।
খবরের কাগজ বৃষ্টির জলে ভিজছে।

পালঙংয়ের ইচ্ছে হলো আরেক কাপ চা। ইচ্ছেটাকে দমন করে সাইকেলে জোর লাগালো।বাঁ হাতে ছাতা। ডান হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল।

বৃষ্টির হাওয়া এসে উড়িয়ে দিতে চায় সবকিছু। আকাশেও ঘন মেঘ। বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টিকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।

শ্যামবাটিতে এসে পালংয়ের মনে হলো, এখানেও কিছু গাছ লাগালে ছায়া হবে। ভাবতে হবে ভবিষ্যতের জন্য।
ভবিষ্যৎ?

নিজের কি ভবিষ্যৎ আছে? মাঝেমধ্যেই পালং নিরাশ হয়ে ওঠে। মুষড়ে যায়।

যদিও সে স্বপ্ন দেখে শান্তিনিকেতনেই থেকে যাবে।
কোনো চাকরি না পেলে আদিবাসী গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে।

একটা ঝুপড়ি ঘর কি ভাড়া পাবেনা সে? টিউশন করবে। সেইসঙ্গে আদিবাসী গ্রাম।

এই শান্তিনিকেতন থেকেই তো কত মানুষ কতকিছু হয়েছেন। কত কিছু করেছেন। সেও পারবে নিশ্চয়ই।


কোপাইয়ের কাছে এসে পালং দেখে পুরোটাই সে ভিজে গেছে।
সে মনে করলো, আজকের ভিজে যাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের।

কোপাইয়ের চায়ের ঝুপড়ি খোলা আছে। এক বুড়ো বাউল একা একা একমনে গান গাইছে। পাশে এক যুবক টান মারছে গাঁজায়।
পালং এক কাপ চা খেয়ে
শুরু করলো কাজ করতে।

কোপাই ব্রীজের এদিকে ৫টা আম
৫টা জাম। ওদিকেও একইরকম ভাবে লাগিয়ে ফেললো গাছের চারা। এবং কাজটা করতে করতে
বেলা হয়ে গেছে। মেঘ ছেঁড়া আলো তার মুখে এসে পড়ছে।খিদেও পেয়ে গেছে তার।

পালং কোপাইয়ের জলে হাত--মুখ ধুয়ে ব্রিজে উঠে দেখতে পায় দূরের এক গাছ তলায় এক বৃদ্ধা উনুন জ্বালিয়েছে। নিশ্চয়ই রান্না করবে।
তার মনে হলো, আজ সে যদি ওই
বৃদ্ধার কাছে দুটি ভাত চেয়ে নেয়?
কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না নিশ্চয়ই। বরং সে মনে করবে, আজ এখানেই তার জন্মদিন উদযাপন করা হলো। মাকেও বলতে পারবে গল্পটা। বলতে পারবে বন্ধুদের, জানিস-----,
আজ আমার এই জন্মদিনে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে এসেছি।

বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় পালংয়ের শুকনো মুখে হাসির রেখা।

-----১ আষাঢ় ১৪২৮
----১৬---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ