জানলা
---------------------------
একটা জানলা চাই।
দরজা যেমন আছে থাক। দরজা বন্ধ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু একটা জানলা চাই।
জানলা ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না। রোদ্দুর যে আসছে, জানলা ছাড়া কে দেখাবে! বৃষ্টি যে আসছে
জানলা ছাড়া কে দেখাবে!
বিহু বলে, ওই যে ছাদে নানা রঙের
জামাকাপড় মেলা আছে, জানলাই তো আমাকে দেখায়।
জানলাই তো দেখিয়েছিল, সেই মেয়েটিকে যে পুতুল নিয়ে খেলা করে। বিকেলবেলা।
বিহু বলে, যে ঘরে জানলা নেই
আমার মনে হয় সেই ঘরে হৃদয়টা নেই।
আমি একবার এক আত্মীয়র বাড়িতে গেছি, আমাকে থাকতে হবে একটা রাত। কিন্তু সেই আত্মীয়দের বলতে পারছিনা,
আমার ঘরে জানলা চাই।
বিহু যখন জানলার কথা বলে
তখন তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে হয়, জানালা দিয়েই সে পৃথিবীর সমস্ত কিছু দেখবে।
শীতের দিনেও বিহুর ঘরের জানলা বন্ধ থাকে না। সে সব সময় জানলা দিয়ে আলো-বাতাস অন্ধকার দেখে। দেখে, অনেক দূর থেকে এক পথিক আসছে। যার পায়ে লেগে আছে প্রাচীনকালের ধুলো। দূর থেকেও বিহু বলে দিতে পারে ধুলোর রঙ কি। দূর থেকেও
বিহু বলে দিতে পারে, মেয়েটির চোখে কেন জল।
বিহুর বন্ধুনী শালিক তাকে রসিকতার সঙ্গে বলেছিল, ফুলসজ্জার দিন জানলা খুলে রাখবি তুই। কি মজা।
বিহু ধ্যাৎ বলে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বলেছিল, জানলাটা আছে বলেই, হেমন্ত শীত বসন্ত টের পাই। আমরা থাকি তো ঘিঞ্জি শহরে। কোলাহল ছাড়া যার কোন প্রকৃতি নেই। তাই
জানলাটা আছে বলে, দেখতে পাই, রাস্তার ধুলোয় খেলছে এক ন্যাংটো শিশু।
সেই সেদিন বিহু ন্যাংটো শিশুর কাছে পৌছে গেছলো। কিনে দিয়েছিল একটা পাউরুটি। কোলেও নিয়েছিল।
এই বিহু জানলা থেকে রাস্তা দেখতে দেখতে বর্ষা দেখতে পায়।
গুন গুন করে ওঠে তার মন। তার ইচ্ছে করে তার বন্ধুনীরা কেউ একজন এসে তাকে রবীন্দ্রনাথের গান শোনাবে।
কেউ আসে না।
সেই মুহূর্তের মধ্যে চলে যায় এক জঙ্গলে। যেখানে এক হরিণ শাবক খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মাকে।
বিহু হরিণ শাবককে কোলে নিয়ে
খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মাকে। তখন মনে হয়, সত্যি সত্যি জানলা আমাকে কতকিছু দেয়।
বিহুর ঘর দোতলায়।
জানলা দিয়েই
মেঘ ধরতে পারে। তার মনে হয়,
মেঘ মানেইতো চিঠি। তার মা তাকে লিখেছে। মা কেন যে দূর দেশে চাকরি করতে গেল।
বিহুর খুব মন খারাপ করে। বাবাও চাকরি করে দূর এক গ্রামে।
মা-বাবা দুজনেই মাসে একবার বাড়িতে আসে। সারা মাস বিহু আর দিনুদা বাড়িতে।
বিহুর কলেজ শেষ হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেও
সে নিয়মিত ক্লাস করে না। সে
জানলা থেকে দেখে , দূরে এক কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার সঙ্গে কথা বলছে।
কী কথা?
বিহু কান পাতে। শুনতে পায়,
রাধাচূড়া বলছে, গতরাত্রে ঘুম হয়নি তার। কৃষ্ণচূড়া বলছে, এসো আমার কাঁধে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে যাও।
বিহু দেখতে পায়, আবর্জনার স্তূপ থেকে কুকুর ও শুয়োর একইসঙ্গে আহার খুঁজছে।
সে কি ডাকতে পারে না তাদের?
বিহুর বাবা বলেছিলেন, বাড়িতে
নতুন রঙ করাবেন। বিহু জানিয়েছিল, তার ঘরে রঙ করলে করতে পারো------জানলায় রঙ করা চলবে না। তার বাবাকে কারণটা জানায়নি। কারণ শুধু তার কাছে,
রঙ করলে, যদি কিছুই না দেখা যায়।
মা বিহু কে চিঠি না লিখলেও
মেঘ এলেই মায়ের চিঠি পড়ে।
মা লেখে-------
বিহু
আশা করি তুমি ভালো আছো।
আমি এই রবিবার বাড়ি যাচ্ছি না।
অফিসের কাজে আটকে যাব।
তোমার বাবা যাবেন। তিনি তোমাকে দিয়ে আসবেন টাকা।
তুমি দিনুদার কথা শুনবে। খাওয়া-দাওয়া করবে নিয়ম মত।
মা কিন্তু কেমন আছে কোনো চিঠিতেই লেখেনা। বিহু জানে,
মায়েরা ভালো থাকে সবসময়।
তাই বোধ হয়, মা তাকে জানলা সহ একটা ঘর দিয়েছে।
এই জানলা--চোখ বিহু পেয়েছে হাসপাতাল থেকে। সে যখন
ক্লাস টেনে পড়ে তার হয়েছিল কঠিন অসুখ। দিনের পর দিন
চলছে চিকিৎসা, অথচ সুস্থ হয়ে উঠছে না। তখন এক সিস্টার
তার বেড সরিয়ে জানলার কাছে করে দিয়েছিলেন। কি আশ্চর্য, কয়েকদিন পর থেকেই বিহু সুস্থতার দিকে যায়। সে প্রথম হাসপাতালের জানলা থেকে দেখে
হাতির পিঠে উঠে আসছে এক বন্ধু। যে বিহুর সঙ্গে কথা বলতেই আসছে। যে জানে, বিহু এই এক মাস ধরে কারো সঙ্গেই কথা বলতে পারেনি।
হাসপাতালের জানলা থেকেই সে দেখেছিল, বট চারার কিরণ। সে দেখেছিল, ফুলের রেণু। সে পেয়েছিল পাকা কুসুমের গন্ধ। সে পেয়েছিল, পায়ের শব্দ।
হ্যাঁ হ্যাঁ-------পায়ের শব্দ। যে শব্দগুলি বিহুর সঙ্গে কথা বলতে আসে। যে শব্দগুলি বিহুর কুশল রচনা করে।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে বিহু
মায়ের কাছে আবদার করেছিল,
একটা জানলা।
সেই আবদারের জানলা এখন দিকে দিকে। সর্বত্র। বিহু দেখতে পায়, তার বন্ধুনী শালিক হাতের পাতায় গমের দানা রেখে পায়রাকে খাওয়াচ্ছে।সেও পায়রাদের সঙ্গে একটি একটি করে গম খুঁটছে।
আহারে--------
-----২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৪---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন