বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

চাল-বুড়ি / নির্মল হালদার

চাল- বুড়ি//

ভোরের আঁধার থাকতে থাকতেই
চলে আসে। বাজারে যে সমস্ত দোকানপাট আছে, তার বাইরেটা ঝাঁট দিতে থাকে বুড়ি।

দোকান তো খুলবে বেলা আটটার পর। তার আগে সাফ-- সুতরো করে রাখে। দোকানি যেন এসেই দেখতে পায়, তার দোকান দুয়ারটা
পরিষ্কার হয়ে আছে। দোকানির
মন ভালো হয়ে যাবেই। এই মন
ভালো করার কাজটা বুড়ি করে। প্রতিদিন।

বুড়ির স্বামী অকালে মারা গেছে।
ছেলেপুলে নেই। আত্মীয়রাও দেখভাল করে না। অল্প বয়সে লোকের বাড়িতে কাজ করতো।
এখন আর পেরে ওঠেনা। শুধুমাত্র
ঝাঁট দেবার কাজ করতে পারে।
এ কারণেই, বাজারের দিকে।

ভোরের আঁধারে।

চাল দোকানের বাইরে অনেক চাল পড়ে থাকে। গোটা চাল ভাঙ্গা চাল। ধুলো চাল। ময়লা চাল।
ঝাঁট দিয়ে দিয়ে বুড়ি আঁচলে বাঁধে। এ জন্যই অন্ধকার থাকতে-থাকতে চলে আসা। যেটুকু চাল পাওয়া যায়, সেটুকুই লাভ।

সমস্ত চাল জড়ো করে বুড়ি
একটা থলিতে রাখে। তারপর সেই থলি শিব মন্দিরে লুকিয়ে রাখে।
ঘরে ফেরার সময় নিয়ে যাওয়া।

দোকানিরা জানে, দোকান দুয়ার
কে ঝাঁট দেয়। তাই তারা বুড়িকে
দু চার পয়সা দিতে কার্পণ্য করেনা।
তাকে সবাই চাল--বুড়ি বললেও
সে মিষ্টি দোকানেও ঝাঁট দিয়ে থাকে। কিন্তু মিষ্টি দোকান থেকে কোনোদিনই মিষ্টি নেয় না।
কে মিষ্টি খাবে!
পয়সা নিলে নুন-তেলটা হবে।

একদিন বন্ধ মনোহারী দোকানের বাইরে দু-তিন প্যাকেট সাবান পেয়ে যায় বুড়ি। দোকান খুলতেই
দোকানিকে ফেরত দেয় । দোকানি তাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিল।
আরেকদিন দেখে একটা ছিঁচকে চোর একটা চাল দোকানের তালা ভাঙছে। বুড়ি এমন চিৎকার করে
কুকুরের দল তেড়ে আসে। চোর পালিয়ে যায়।
বুড়ি দোকানির ঘরে গিয়ে তালা ভাঙার গল্প বলে আসে। তৎক্ষণাৎ তারা দোকানে এসে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়।
সেই চালদোকানি সেদিন বুড়িকে দিয়েছিল দু কেজি চাল।

এই বুড়ি বেলার দিকে ঘরে যায়। চান করার আগে
চাল বাছে। ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে। কাঠকুটো জ্বালিয়ে উনুন ধরায়। রান্না করে।
এই বুড়ির আজ চালের থলি মন্দির থেকে উধাও।
কে নিয়ে গেল? কে নিয়ে গেল?

থলি রেখে সে গিয়েছিল চাল দোকানেই। যদি দু চার মুঠো চাল পরিষ্কার চাল দোকানি দেয়।

চাল দেবে কিন্তু বেলা হলে।
দোকানি বলে, আগে ভালো করে বৈনি--বাটা করতে দে। পরে আসবি------

বুড়ি মন্দিরে যায়।

আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাবে।
শরীরটা ভালো লাগছেনা। কিন্তু চালের থলিটা নেই। বুড়ি চিৎকার করে। কোথাও খুঁজে পায়না। সে চিৎকার করতে করতে কাঁদে।
কে আমার মত হতভাগির চাল
চুরি করে নিয়ে গেলি রে-----
কে?

লোক জড়ো হয়। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে। কিন্তু কেউই বুড়িকে এক কেজি চাল কিনে দেবার জন্য তৎপর হয় না। বুড়ি
কেঁদেই চলে। ইনিয়ে বিনিয়ে
কেঁদে চলে।

শিব মন্দিরের চাতালে মাথা ঠুকতে থাকে। বলে, ও বাবা শিব আমি আজ কি খাব বলো?
তুমি খুঁজে দাও আমার চালের থলি। খুঁজে দাও বাবা------
তোমার পূজা করবো আমি।
খুঁজে দাও। তোমার কাছেই তো প্রতিদিন থলি রেখে কত কাজ করি। কোনোদিন চুরি হলো না।
আজ কে নিয়ে গেল?
কোন্ চোর আমার কপাল ভাঙলো?
বাবাগো-------কি হবে আমার?

কাঁদতে কাঁদতে বুড়ির চোখ ফুলে যাচ্ছে। সে এই অবস্থায় দেখতে পেলো, শিব মন্দিরের সিঁড়িতে
তার চালের থলিটা পড়ে আছে।
ফাঁকা।

বুড়ির কাছে আজ পৃথিবীটা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে, এক কালে সব গেছে তার। এ কালেও কী সব যাবে?

গতর খাটিয়েও লোক কী তাকে বাঁচতে দেবে না?
বুড়ি জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।



----২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৭---৬---২০২১
----নির্মল হালদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ