তুলসী গাছ / নির্মল হালদার
স্কুলের জন্য যখন জমিটা পাওয়া গেল তখন দেখা গেছলো, একটা বেল গাছ, আরেকটা আমড়া গাছ আছে। স্কুল যারা তৈরি করেছিলেন , তাদের মধ্যে মনি বাবু বললেন, গাছ কেটে দিতে হবে। আরেকজন
ঘোষ বাবু রাজি হলেন না। উনি বললেন------ গাছগুলো আমাদের ক্ষতি করছে না। বরং স্কুলের ছেলেমেয়েরা এসে গাছে ওঠার অভ্যেস করবে। বেল খাবে। আমড়া খাবে। সেও ছোটদের কাছে আনন্দের বৈকি। তারপর থেকে গাছ দুটো থেকেই গেছে।ডালপালাও বেড়েছে তাদের। পাখিরাও আসে।
পাখিদের কলরবের সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কলরব মিলেমিশে এক সুর তৈরি করে।
মনি বাবু এবং ঘোষ বাবুর প্রচেষ্টায় এই গ্রামে প্রথম প্রাইমারি স্কুল। প্রাইভেট। স্কুলের ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে যেটুকু বেতন পাওয়া যায়, মনি বাবুরা ভাগ করে নেন।
আস্তে আস্তে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। যেহেতু কাছাকাছি কোনো স্কুল নেই। স্কুলে নিয়োগ করতে হয়েছে আরো একজন দিদিমণিকে। দিদিমণি- আমলকি দত্ত।
দিদিমণি স্কুলটাকে নিজের মতো করে সাজাতে চান।
এরইমধ্যে স্কুল বাউন্ডারিতে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ফুল ফল গাছ পাতা আঁকিয়েছেন। সুযোগ সময় পেলে, দিদিমণি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গান করতে বসে যান। যদি ছাত্র-ছাত্রীরা গান করতে পারে, যদি শেখে তারা সমৃদ্ধ হবে। স্কুলেও ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতে পারবে।
দিদিমণি মনি বাবুকে বলছিলেন, যদি স্কুলে আর্ট টিচার নিয়োগ করা যায়। গানের টিচার নিয়োগ করা যায়। মনি বাবু না করে দিয়েছেন। নতুন টিচার নিয়োগ করলেই, টাকা লাগবে। স্কুল ফান্ডে টাকা নেই। এই গ্রামে বেশিরভাগ মানুষ গরিব। বেতন বাড়ানো যাবে না। বাইরে থেকেও তেমন কোনো সাহায্য আসে না।
হতাশ হয়ে দিদিমণি একা একা চেষ্টা করে যান, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নান্দনিক বোধ তৈরি করতে।
খেলাধুলো তো আছেই। সেইসঙ্গে গাছপালা চেনানো।তার নিজেরও গাছ চেনা হয়ে যায়। তিনি বুয়ান গাছ চিনতেন না। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা দিদিমণিকে বুয়ান গাছ চিনিয়ে দিয়েছে। জেনেছে এও,বুয়ান পাতা জ্বালিয়ে দিলে তার ধোঁয়ায় মশারা পালিয়ে যায়।
দিদিমণি টিফিনের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নিজেও
এক্কাদোক্কা খেলেন। মনি বাবু ও ঘোষ বাবু হাসাহাসি করলেও দিদিমণি গ্রাহ্য করেন না।
দিদিমণির বাড়িতে শুধু বাবা আর মা। তিনি তাই কখনো কখনো একজন বা দু'জন ছাত্রছাত্রীকে ঘরে নিয়ে আসেন। যারা খুবই দরিদ্র। স্কুলের বাইরে আর পড়াশোনা করতে পারে না। নিজের ঘরে নিয়ে এসে লেখাপড়া শেখান।
একেক হপ্তায় একেকজন। প্রতি হপ্তায় নতুন কেউ। সাধারণত একজনই থাকে। কখনো দু'জন। শনিবার আসে। সোমবার ছাত্র বা ছাত্রীকে নিয়ে দিদিমণি আবার স্কুলে।
দিদিমণির মা-বাবাও মেয়ের জন্য নিত্যনতুন ছেলে মেয়ে দেখতে পান। মনে করেন, তারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠছেন। কচিকাঁচাদের মুখের আলোতে।
স্কুলে ২৬ জানুয়ারি পতাকা উঠলেও পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা। গান। এবং বাইশে শ্রাবণ গাছ লাগানো হবেই।
এবারেও গাছ লাগানোর জন্য মনি বাবু কিছু চারা বিশেষ করে ফুলের চারা লাগাবেন, স্কুলে বলেছেন। ঘোষ বাবুর খুব ইচ্ছে একটা আম গাছের। আর দিদিমনির? তিনি কিছু বলছেন না।
এরই মধ্যে একজন আঁকার টিচার পাওয়া গেছে। তিনি শুধু শনিবার এসে ছাত্রীদের আঁকা শেখাবেন।
বিনিময়ে কোনো দাবি নেই। মনি বাবুরা সবাই খুশি। এবার একজন নাচের শিক্ষক পেলে, ফুলে ফলে
ভরে উঠবে ।
বাইশে শ্রাবণের সকালবেলা ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়ি থেকে
নানান গাছের চারা নিয়ে এসেছে। বেশিরভাগ গাছ বট--অশথ। কেউ কেউ আম জাম।
স্কুলের বাউন্ডারি তো বেশি বড় নয়। কত গাছ আর লাগানো যাবে। তাই মনি বাবুরা বললেন, গাছের চারা কেউ যেন না ফেলে। আমরা পাশের গ্রামের স্কুলে গাছ লাগিয়ে আসবো। কিছু কিছু গাছ রাস্তায় লাগানো হবে।
দিদিমণিকে দেখা গেল, একটি টব নিয়ে আসতে। ঘোষ বাবু মনি বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন-----দিদিমণি টবে কি গাছ নিয়ে আসছে বলুন তো? মনি বাবু বলেন, দেখুন কোনো ফুল গাছ হবে হয়তো।
দিদিমণি স্কুলে ঢুকতে দেখা গেল, একটি তুলসী গাছ। মনি বাবু ঘোষ বাবু এবং আঁকার মাস্টারমশাই উত্তম বাবু দেখে তো অবাক। একইসঙ্গে সবাই প্রশ্ন করেন------তুলসী গাছে কি হবে?
দিদিমণি বলেন, স্কুল বাউন্ডারির এক কোণে পড়ে থাকবে। সেদিন এক ছাত্র তুলসী গাছ চিনতে পারেনি। সেদিন থেকেই মনে হয়েছিল আমার, একটা তুলসী গাছ দরকার।
দিদিমণি হাসতে হাসতে আরো বলেন------তুলসীর হাওয়া ছোট ছোট হলেও খুব বিশুদ্ধ হাওয়া। তুলসী পাতাও খুব বিশুদ্ধ। সবাই জানেন।
মনি বাবুরা হাসতে হাসতে বলেন, আপনার যখন শখ হয়েছে, তুলসী গাছটাও আজ থেকে থাকুক আমাদের সঙ্গে।
দিদিমণি বলেন-----তুলসী গাছ ছোট হলেও একটা গাছ। আমাদের দিকে চেয়ে থাকবে সেও।
----২০আষাঢ়১৪২৮
----৫----৭----২০২১
----নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন