আঙিনা / নির্মল হালদার
আঙিনা বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখতে পায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। সকালের দিকে কালী মন্দিরের কাছে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল। কত আর বয়স হবে। খুব জোর ১২/১৩। কিশোর বলা যায়। ছেলেটা ভিখিরি নয়, চেহারা দেখলে বোঝা যায়। চোখেমুখে উজ্জ্বলতাও আছে। শুধু কাপড় জামা মলিন।
ছেলেটা তাদের বাড়ির সামনে কেন? প্রশ্নটা মনে আসতেই, আঙিনা ছেলেটাকে কাছে ডাকে। জিজ্ঞেস করে------কি নাম তোর? বাড়ি কোথায়? ছেলেটা চুপচাপ থাকে। আঙিনা আবার জানতে চায় ------ তোর নামটা বল? কোথায় থাকিস? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছেলেটা বলে-------আমার খিদে পেয়েছে।
আঙিনা এবার কি করবে কোথায় নিয়ে যাবে ? সে বেশি কিছু চিন্তাভাবনা না করে একটা মিষ্টির দোকানে ছেলেটাকে নিয়ে যায়। বলে------কি খাবি বল? যা খুশি খেতে পারিস। ছেলেটা বলে----- আমি মিষ্টি খাবো না। তাহলে কি খাবি? আমি ভাত খাবো, ভাত।
বিকেল হয়ে আসছে। হোটলে কি ভাত পাওয়া যাবে?
আঙিনা ছেলেটার হাত ধরে বলে ----- চল্ দেখি ভাত পাবো কিনা।
না ভাত নেই। আঙিনা এবার ছেলেটাকে বলে----রুটি খেতে তোর অসুবিধে হবে? ছেলেটা ঘাড় হেলিয়ে হ্যাঁ করে। আঙিনা সমস্যায় পড়লো। বাড়িতে গিয়ে দুটি ভাত ফুটিয়ে দিলেই হয়। এই কাজটা করতে হলে, আজ আর টিউশনি হবে না।
আঙিনার রোজগার বলতে টিউশনির টাকা। তার বাবা যেটুকু পেনশন পেয়ে থাকেন, সংসার চলে না। ভাই বেকার। মা অসুস্থ।
না হোক টিউশন। ছেলেটাকে আজ ভাত খাওয়াতেই হবে। আঙিনার মাথায় চেপে গেছে জেদ। আঙিনা বলে-----আচ্ছা চল তবে, আমাদের বাড়িতেই তোকে ভাত খাওয়াবো। তার আগে তোকে বলতে হবে তোর নাম? কোথায় থাকিস? পড়াশোনা করিস?
ছেলেটা কিছুই বলে না। ছেলেটার মনে পড়ে শুধু, তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অন্য এক লোকের সঙ্গে। মা চলে যাওয়ার পর বাবাও চলে গেছে অন্য এক মহিলাকে নিয়ে। সে স্কুলেও যেতো। মা বাবা চলে যাওয়ার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাদের ঝুপড়ি ঘরে অন্য একটা পরিবার ঢুকে পড়েছে। তারা বলছিল তাকে, ভিক্ষা করতে।
ছেলেটা হাত পাততেই পারে না। মা বাবা চলে যাওয়ার পর ছেলেটা প্রায় বোবা হয়ে গেছে।
খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে, মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে, ছেলেটাকে ভিখারি ভেবে, কেউ কেউ তার হাতে খাবার দিয়ে যায়। আজ কি জানি কেন, ছেলেটা আঙিনাকে দেখে মনে করেছে , এই মাসিটার কাছে ভাত পাবেই পাবে। তাই সে কালী মন্দির থেকে অনুসরণ করে দেখে গেছে আঙিনাদের বাড়ি।
আঙিনা ভাতের সঙ্গে আলু সেদ্ধ করে দিয়েছিল। ছেলেটা তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। খাওয়ার আগে আঙিনা তাকে স্নান করতে বলেছিল। ছেলেটাও লক্ষ্মী ছেলের মত স্নান করেছে। আঙিনা চাইছিল, পরিষ্কার কাপড় জামা পরাতে। কিন্তু পাবে কোথায়? আরেকটা চিন্তা মাথায় এসেছে তার, ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে কোথায় যাবে? কিছুই যে বলছে না।
সন্ধে হয়ে গেছে। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে এখনো। তার মুখের দিকে চেয়ে আঙিনার মনে মায়া জাগলো। সে কি করে বলবে ----- তুই ভাত চাইছিলি, ভাত খাইয়েছি ------এবার চলে যা তুই। কি করে বলবে?
আঙিনা জানলাটা খুলে দেয়। অন্ধকারেও পাহাড়টা যেন তাকে বলছে ------ ভয় করিসনে ------ তোর সঙ্গে আমি আছি।
ছেলেটা ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে------মা মা আমাকে মেরো না। আমি ইস্কুল যাবো ঠিক। দেখবে, আমি এবার পাশ করবো।
আঙিনা ছেলেটার কণ্ঠস্বর পেয়েই, বিছানার কাছে এসে তাকে ডেকে ওঠায়। জানতে চায় কি হলো ? ছেলেটা ঘুম চোখে উঠে আঙিনাকে জড়িয়ে বলে -----
আমাকে তাড়িয়ে দিও না।
------২৯আষাঢ়১৪২৮
------১৪---৭----২০২১
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন