কথা / নির্মল হালদার
আজ একটা চেয়ার কে সামনে নিয়ে এসে বললাম ----- তুমি চুপচাপ থাকো। আমি যা বলবো তুমি শুনবে শুধু।
কি বলবো বলো তো?
এখুনি বলবো,শাদা অপরাজিতা আমার ভালো লাগে না। লাল জবা ছাড়া হলুদ জবা আমার ভালো লাগে না। হলুদ পলাশ ভালো লাগেনা।
চেয়ারটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, বলতে চাইছে কিছু। সে যদি বলে-----আমার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কারোর কোনো যায় আসে না। তাহলে? তাহলে আর কি-----আমি আমার কথা বলে যাবো। শীতের গাঁদা ফুল এখন বারো মাস পাওয়া যায়। আমার ভালো লাগেনা। গাঁদা ছিল শীতের ফুল। তাকে যদি বৈশাখেও দেখতে পাই, আকর্ষণ বোধ করি না। তো কি হয়েছে? চেয়ারে বসে আমার বড়দা বলে।আরে দাদা হঠাৎ? আমিতো ডাকিনি। কখন এলো কোত্থেকে এলো? এই দাদাকে আমার ভয় করে। মাথা তুলে কথা বলতেই পারবো না। দাদা বলে ------যা বলবি আমাকে বল----চেয়ারকে বলতে বলতে তুই নিজে কাঠ হয়ে যাবি। আবেগটা থাকবে না। আরে বাবা, সামনে মানুষ না থাকলে, আবেগ থাকে? কথা আসবেই না। আমি না হয়, তোর কাছে জানতে চাইবো, আজ তুই কি খেয়েছিস? মাছ এসেছিল বাড়িতে? না আসেনি ---- আমি উত্তর দিই। তাহলে কি দিয়ে ভাত খেলি?
আমি এবার কিছু না বলে, চলে গেলাম নিচে। একতলায়। ফাঁকা ঘর। অন্ধকার। একটা কাঠের চৌকি পড়ে আছে শুধু। তাকেই বললাম, একটু শান্ত হয়ে শোনো আমি কি বলতে চাই। মাথার পাখা দুলে উঠলো। মনে হচ্ছে, আমার সব কথা সে শুনবে।
প্রথম কথা, অপরাজিতা নীল না হলে আমি গ্রহণ করতে অক্ষম। অপরাজিতার সঙ্গে শরতের নীল আকাশের একটা সম্পর্ক আছে। শাদা হলে সেই সম্পর্কটা খুঁজে পাই না।আর জবা রক্ত জবা না হলে, নিবেদন করবো কি? গাঁদা শীতের শিশিরে ভেজা না হলে, অনুভব কেমন করে করবো শীতের তীব্রতা?
ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। বড়দা এসে ঢুকে পড়েছে নিচের তলায়। এখন কোনো কথা বলছে না। কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার।
কি ব্যাপার? দাদা এখানেও কেন এলো? কি ব্যাপার? কথাই বা বলছে না কেন? আমি আরো বেশী ভয় পেয়ে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় যাবো? চিন্তা ভাবনা করতে করতে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে এসে দাঁড়ালো ফুল্লরা। সে বলে---চলো যাই এই বর্ষাতে মাছ ধরবো।
ফুল্লরা কেন? সে তো কবেই হারিয়ে গেছে। নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন, বিশ্বাস অর্জন আর কি হবে? সে অবশ্য পরে ভাবা যাবে। এখন তার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। তাকে বলতেই পারি, কলকে ফুলের রঙ নীল হলে আমরা কি আকর্ষণ বোধ করবো? অথবা জারুল লাল হলে কেমন লাগবে? পদ্ম ফুল কালো হলেও ভালো লাগবে না।
ফুল্লরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে জেনে গেছে, মাছ ধরা কাজে আমার উৎসাহ নেই। সে অতনুকে বলতে পারে। অতনু টিকিট কেটে মাছ ধরতে যায়। সে প্রকৃত নেশাড়ু। আমার নেশা কথা বলা। অথচ কথা বলার লোক নেই। মনে হচ্ছে, ফুল্লরা আমার কোনো কথা শুনবে না। সে চলে গেল। আমি আবার উপর তলার ঘরে গেলাম। চেয়ারটা নেই, দেখে আমি অবাক। কোথায় গেল?
আমি এবার একটা টেবিল নিয়ে এলাম। তাকেও একই কথা, আমি যা বলবো তুমি শুনবে। কোনো প্রশ্ন চলবে না। টেবিলটাও নড়েচড়ে উঠলো। তা একটু নড়াচড়া করুক। আমার কথা হলো, মানুষ যদি বোবা হয়ে যায়? আমিও বোবা হয়ে যাবো? হাঁফিয়ে উঠবো নিশ্চয়ই। কেননা, কথাই তো থাকে। কেবলমাত্র কথাই তো রয়ে যায়। মানুষকে তো ভাব প্রকাশ করতেই হবে। গান করতেই হবে। বোবা হলে কালা হয়ে যাবে। তখন শুনতে পাবে না মেঘের ডাক। মেঘের ডাক যে খুবই মধুর।
নূপুরের ধ্বনিও খুবই মধুর। সেই সমস্ত মধুর ডাক শুনতে মানুষকে বোবা হলে চলবে না।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিবাদও করতে হয়। কণ্ঠস্বর উঁচু করতে হয়। মানুষকে বোবা হলে চলবে না।
দাদা আবার চলে এসেছে উপরে। কিরে তোর কথা শেষ হলো? আমি এবার জড়োসড়ো । কি বলবো কি বলবো না, ভেবে অস্থির।
দেখলাম, টেবিলটা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে ঘরের বাইরে। আমার কথা ফুরোয়নি। দাদা বসে পড়েছে
ঘরের মেঝেতে। আমার কাছে জানতে চায়-----আমি উপস্থিত কি করছি? চাকরি-বাকরি হলো না হবে? বিয়ে করবো কি করবো না? সবই সাংসারিক কথা। আমি শুনে গেলাম। একটারও উত্তর না দিয়ে আমি ছাদে। দাদা পিছন থেকে ডাকছে-----গোরা গোরা শুনে যা আজ রাত্রে আসছি আবার। তুই ঘরে থাকবি।
আমি ছাদে পায়চারি করতে করতে একটা ঘুড়িকে ধরেছি। সে ভোকাট্টা হয়ে গেছে। আমি এবার ঘুড়ির সঙ্গে উড়বো।
উড়ছি। কার হাতে লাটাই আছে জানি না। উড়ছি।উড়তে উড়তে ঢুকে পড়েছি নিচের তলার ঘরে। দেখছি,চৌকিতে শুয়ে আছে দাদা।
কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমাকে ছাড়বে না আজ? আমি যে দাদার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবোনা।
আমার যে কোনো কথা নেই দাদার সঙ্গে। দাদা তিন বছর হলো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
----২৫ আষাঢ় ১৪২৮
----১০----৭---২০২১
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন