ঘুঙুর / নির্মল হালদার
গোপাল মোড় থেকে এগিয়ে গেলে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে সোজা বেদিয়াদের গ্রাম। অনেকেই সাপুড়েদের গ্রাম বলে থাকে। প্রকৃত নাম-----লোহার সোল। এই
গ্রামের প্রায় সবাই সাপ ধরে। শহরে গিয়ে সাপ খেলা দেখিয়ে রুজি রোজগার করে। এরাও ভোটাধিকার পেয়েছে। এদেরও আছে আধার কার্ড। রেশন কার্ড।
এদের জমি জায়গা বলতে কিছু নেই। অধিকাংশ পুরুষ সাপ ধরে বেড়ায়। যদিও বর্তমানে সাপ খেলা দেখানো চলবে না আইন করে করা হচ্ছে। এ সমস্ত খুঁটিনাটি ফাঁকফোকর জানতে ইচ্ছে করে না যোশিয়োর। সে আজ একা একা হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পর গ্রাম যাবে।
কী আছে গ্রামে? মুক্ত বাতাস নীল আকাশ? আর?আর কি আছে? সরল মানুষ আছে বৈকি। চাষবাস আছে বৈকি। এই তো আষাঢ়। ধান জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছে চাষী। কোনো কোনো জমিতে বীজ ফেলা হচ্ছে। কোথাও দেওয়া হচ্ছে গোবরের সার।
বুয়ান গাছের সারি জমির উপরে। তার পিছনে একটা তাল গাছ। এখন তো তাল পাকবে না। তাল শাঁস খাওয়ার জন্য ছেলেরা তাল পেড়ে গেছে। চিহ্ন পড়ে আছে তার।
এইবার চাকিরবন। একটার পর একটা গ্রাম। গা লাগালাগি গ্রাম। পিঠে পিঠ ঠেকে আছে। যোশিয়োর পিঠেও কী কারো পিঠ লেগে আছে? যোশিয়োর ইচ্ছে ছিল পাহাড়ে পিঠ দিয়ে অপেক্ষা করবে কারোর জন্য। অথবা পাহাড়ের কাছে শিক্ষা চাইবে, অপেক্ষা কাকে বলে।
সেই সময়টা যোশিয়ো এক পাহাড়ি গ্রামে দিনের পর দিন কাটিয়েছে। চার্চ থেকে তাকে পাঠানো হয়েছিল আদিবাসীদের গ্রামে যীশুর ধর্ম প্রচার করতে। সে কিন্তু ধর্ম প্রচার করেনি। বরং তার মনে হয়েছে, কোনো ধর্ম কাউকে রক্ষা করে না। মানুষ তার নিজের মতো করে বাঁচবে। মানুষের ধর্ম একমাত্র ধর্ম বেঁচে থাকা। সেই বেঁচে থাকার কাছে কোনো ধর্মগুরু নেই। ঈশ্বর নেই। যোশিয়ো তাই, ধর্ম প্রচার না করে শুধু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতো। আর ঘরে এসে শুয়ে শুয়ে বই পড়তো। বইয়ের মত নিঃস্বার্থ বন্ধু আর কেউ নেই। সে তাই শহরে গিয়ে বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসতো।
চার্চের ফাদার সেই গ্রামে গিয়ে যোশিয়োকে খুঁজে পাননি। পরে জানতে পেরেছিলেন, সে নাকি এক আদিবাসী ঘরের উঠোনে ঘুমিয়ে আছে। আগের দিন আদিবাসীদের কোনো উৎসব ছিল। সে নিজের ঘরে না ফিরে রাত জেগে উৎসব দেখেছিল। পরের দিন তাই ঘুম। এ সমস্ত জেনে ফাদার যোশিয়োকে চার্চ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
চাকিরবনের রাস্তার ধারে খাটিয়ায় শুয়ে আছে এক শিশু। যোশিয়োর মনে হলো, এখানেই দাঁড়ানো যাক। এই বাড়ি থেকেই এক গ্লাস জল চাইলে হয়। তার সঙ্গে কোনো জলের বোতল নেই।
চাকিরবন মূলতঃ মাহাতদের গ্রাম। জীবিকা : প্রধানত চাষবাস। এখন অনেকেই শাকসবজির চাষ করছে। যেহেতু কাছেই নদী। কাঁসাই। পাশের গ্রাম-----পিঁড়রা। কাঁসাই নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে নদীর জলের অভাব নেই বলে, বারো মাস শাকসবজি হয়ে থাকে। চাষীরা শহরে যায় সবজি বিক্রি করতে।
যোশিয়োর ইচ্ছে হলো, নদীর দিকে যাবে। যেতে যেতে আলাপ হয়ে গেল মিলনের সঙ্গে। সে মনে করে মিলন নাই বা থাকুক, মিলনের সঙ্গে দেখা হবেই। মিলন যাচ্ছে নদীতে স্নান করতে। সেও কি স্নান করবে?
স্নান তো নয় নদীতে অবগাহন। ডুব দিতে দিতে পেয়ে যাবে সোনা। তার আগেই সে পেয়ে গেল,একটি ঘুঙুর।কার পা থেকে খুলে গেছে? কে সে? সে কি বালিকা না কোনো যুবতী? নাচ করে?
যোশিয়ো শুনেছে, নাচনিদের কথা। নাচনিদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা। সেই আদিবাসী গ্রামে একবার দেখেছিল নাচনি নাচ।
ঘুঙুরটি নিয়ে খোঁজ করতে ইচ্ছে করছে যোশিয়োর।যার ঘুঙুর তাকে ফেরত দিলে ভালো লাগবে তার। নদীর কাছে এসে তার মনে হলো, জলের উপরে নাচছে এক নর্তকী। জলে শব্দ করে করে তাল দিচ্ছে যোশিয়ো। এবং তাল দিতে দিতে সে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। সঙ্গে নর্তকীও।
যার নাম পিঁড়রা চাকিরবন লোহার সোল। যারা এই বর্ষায় সবুজে সবুজ হয়ে আছে।
----১৬আষাঢ়১৪২৮
----১---৭---২০২১
---- নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন