আয়না / নির্মল হালদার
আয়না একটা আছে। মুখ দেখে না।
চুল আঁচড়ায় না রোরো।
অনেকেই আছে সময়ে অসময়ে
আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মুখ দেখে। মুখের খুঁটিনাটি দেখে।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে।
রোরো আয়নার কাছে যায় না।
সে বলে----মুখ দেখার কি আছে।
মুখতো মুখেই আছে। আমার মুখে তো নেই কোনো মুখোশ।
আমার মুখ আমারই।
এক একদিন শর্বরী বলে, আয়নাতে মুখটা দেখবি যা। কি হয়েছে দেখবি যা।
রোরো বলে, তুই তো আমার আয়না। তুই সামনে থাকলেই আমার মুখ দেখা হয়ে যায়। আমার আনন্দ আমার বিষাদ সব দেখা হয়ে যায়। আয়নার কোনো প্রয়োজন নেই।
---তাহলে ঘর থেকে আয়নাটা ফেলে দিবি।
---কেন ফেলবো কেন?
কতজন আসা-যাওয়া করে।
তারা মুখ দেখবে।
তুই কোনোদিন বলতেই পারিস,
ঘরটা ফেলে দে। সেদিন বলবো,
তুই প্রকৃত বন্ধু আমার। কেননা তুই বুঝেছিস, সম্পত্তি থাকে না।
----কি থাকে?
----প্রেম থাকে।
ভালবাসাবাসির চেয়ে অন্য কিছু আর বড় নয়। সম্পত্তি আজ আছে কাল নেই। প্রেম প্রতি মুহূর্তে। শিরায় শিরায়।
----তোর দার্শনিক কথাবার্তা শুনতে আজকাল আর ভালো লাগে না। তোর বয়েসটা কি বেড়ে গেল?
----বয়স তো মনে বাড়ে।
তোকেও তো বলেছি, তুই আমার সম্পত্তি না। তুই তোর মতো থাকবি। আমাকে ভালোবাসতে বাসতে অন্য কাউকেও ভালবাসতে পারিস। আমার কোনো আপত্তি নেই। বাধা নেই।
----আচ্ছা দেখি তাহলে
কাল থেকে একটা কাঠবিড়ালিকে
ভালোবাসবো। দেখবো তোর ভূমিকা।
রোরো চুপচাপ থাকে।
দুজন দু'দিকে চলে যায়।
আজ এই বিকেলে রোরোর ইচ্ছে করলো আয়নার সামনে দাঁড়াতে।
দেখলো, তার মুখের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গালে একটা ব্রণ হয়েছে শুধু। এইখানে আয়না চমৎকার। সে দেখায়। নিজেকে দেখে না। আয়নার এই ভূমিকা
অসামান্য। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। তার কোনো ক্লান্তি নেই। যে আসবে সামনে তাকেই দেখাবে তার রূপ। তার রাগ অনুরাগ,তার মান অভিমান সব দেখাবে। মুখে যে ছাপ পড়ে।
বিরহের ছাপও মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং আয়না তা দেখিয়ে দেয়।
আজ এ সবই মনে হলো রোরোর। সে আয়নার ধুলোবালি ঝেড়েমুছে তার জায়গায় রেখে দেয়।
তার বোন দয়িতা ডাকে-------দাদা তোর ফোন
এসেছে।
রোরোর কোনো মোবাইল নেই। তার ফোন এলে মায়ের ফোনে আসে। সে একদিন শর্বরীর সামনে পুকুরের জলে ছুড়ে ফেলে ছিল মোবাইলটা। কারণ,রোরো নাকি কোনো মেসেজের উত্তর দেয় না। এমনকি ফোন ধরে না পর্যন্ত।
রোরো মনে করে, মেসেজের উত্তর দেওয়া যায় না। লেখা যায় না সবকিছু মোবাইলে। মুখোমুখি হলেই বলা যাবে সব। ফোন ধরে না, তার কারণ------ফোনে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার।
খুব জরুরী কিছু না হলে, রোরো
ফোন ধরে না।
ফোন রাখার তো দরকার নেই তোর। ফোনটা তবে ফেলেই দে।
শর্বরীর এই কথায় রোরো যে সত্যি সত্যি ফোনটা ফেলে দেবে ভাবতে পারেনি কেউ।
রোরোকে এই মোবাইলটা তার মা
জন্মদিনে দিয়েছিল।
কবে গেল তার জন্মদিন?
আষাঢ়ের ৬ তারিখ কি?
রোরো শুধু ভুলে যায়।
শর্বরী একবার জিজ্ঞেস করেছিল বল তো এটা কোন্ ঋতু?রোরো বলতে পারেনি। অথচ সে পরেছিল একটা সোয়েটার। শর্বরী হাসতে হাসতে বলেছিল, তোর মত পাগল কে নিয়ে পথ চলা দায়। তোর সঙ্গে সংসার করলে কি হবে আমার!
রোরো বলেছিল, আমার সঙ্গে সংসার করার কথা একদম ভাববিনা। ডুবে যাবি। তোকে বললে বিশ্বাস করবি না, আমি এক এক সময় আমার শরীরটাকে ভুলে যাই।
শর্বরী রোরোর মাথার চুল টেনে ধরেছিল। মুখটাকে দু'হাতে ধরে চুমু খেয়েছিল।
দু'জনের এই বন্ধুতা অন্যান্য বন্ধুদের কাছে ঈর্ষণীয়। কেননা শর্বরী ও রোরোর মধ্যে কোনো
ন্যাকামো নেই। দেখানেপনা নেই।
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েও আজও দুজনে সমান অন্তরঙ্গ। এই অন্তরঙ্গতা আসলে হৃদয় থেকে। তাই একদিন রোরো শর্বরীকে বললো------চল্ তোকে আজ একটা গিফট দেবো।
আমার তো আজ জন্মদিন নয়,
শর্বরী বলে। রোরো বলে, গিফট দেওয়ার জন্য জন্মদিন লাগে না।
উপহার ভালোবাসার প্রতীক। যে কোন সময় দেওয়া যায়। চল্-----
রোরো খুব আধুনিক দুটো আয়না
কিনে ফেলে। আর শর্বরীর হাতে তুলে দেয়। বলে-----প্রতিদিন সকালে মুখ দেখবি তুই। আমাকে সামনে পেয়ে তুই তো মুখ দেখতে পাস না। তাই,এই উপহার। প্রতিদিনের জন্য।
শর্বরী রাগে-দুঃখে অভিমানে
আয়না দুটো নিয়ে দু'জনের পায়ের তলে ভেঙে ফেলে।
-----১৪ আষাঢ় ১৪২৮
----২৯---৬---২০২১
----নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন