জ্যান্ত / নির্মল হালদার
তোমাকে আমার চিঠিটাই লেখা ছিল বাকি। অনেক কিছুই দিইনি তোমাকে। যেমন, মেঘ বৃষ্টি। যেমন রৌদ্র ছায়া। যেমন শরতের ধানক্ষেত। হ্যাঁ, এটাও ঠিক তোমাকে কোনো সন্তান দিতে পারিনি। আবার এটাও ঠিক, তোমাকে দিয়েছি একটা বাড়ি।
বাড়িটা আগলে আগলে তুমি থাকো। সম্পত্তি নাইবা ভাবলে। ভাবো, বাড়িটাই তোমার একমাত্র সন্তান। যে তোমাকে দেখবে।
তোমাকে দিতে পারিনি কাশবনের ছোটাছুটি। তোমাকে দিতে পারিনি অপরাজিতার রঙ। লাজুক শালুক ফুল। তবে আমি তোমাকে দিয়েছি একটা বাড়ি।
আমরা ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। মাত্র দুটো ঘর। সব সময় অন্ধকার। ঝকঝকে বাথরুম ছিলনা। একটা কল তলা ছিল। একটা পায়খানা। তুমি সব সময় মুখ কুঁচকে থাকতে। তুমি সব সময় আমাকে বলেছো, আমি অকর্মণ্য। কলম ছাড়া আমার নাকি কিচ্ছু নেই। আমার রোজগার করার ক্ষমতা নেই। একটা বাড়ি পর্যন্ত আমি করতে পারিনি। আমার মুরোদ নেই।
তুমি আমাকে উঠতে বসতে অপমান করতে। আমি কোনোদিন কোনো অপমানের জবাব দিতে যাইনি।
আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, আমার মুখের হাসি থেকে তোমাকে ভালো রাখতে। কিন্তু তুমি বুঝতে না। তুমি বলতে, আমার লেখালেখি থেকে এক পয়সা উপার্জন করি না। আমার আবার কিসের অহংকার। আমার নাকি হাসিও মানায় না।
যেদিন খবর পেলাম আমার বাবার জমানো টাকা আমি পাচ্ছি। তা প্রায় পনেরো লাখ টাকার মতো। বাবা নাকি কাউকে কিছু না বলে, আমার নামেই ফিক্সড করে গেছলেন। আমি যখন জানলাম, প্রথমেই তোমাকে বলেছি, তোমাকে বাড়ি করে দেবো। আর চিন্তা করতে হবে না। তুমি মহা খুশি হয়ে সেদিন আমাকে মাংস ভাত খাইয়েছিলে। বলেছিলে এটাও, আমি যেন দোকানের খাতা লেখার কাজ ছেড়ে দিই। অথচ কোনোদিন জানলে না, ওই খাতা লেখার কাজ থেকেই আমাদের সংসার চলে। এবং ওই খাতাতে আমার যাবতীয় লেখালেখি। সেও আমার মালিক জানতেন। তিনি সহৃদয় ব্যক্তি। আমার লেখালেখির কাজে তার মৌন সমর্থন ছিল। তাই সরস্বতী প্রকাশন থেকে আমার এক একটা বই প্রকাশ হয়ে চলেছে। প্রকাশক টাকা না দিলেও বইটা যে প্রকাশ পাচ্ছে, এও তুমি কোনোদিন জানার চেষ্টা করলে না। কেবলই
আমাকে লোকজনের কাছেও ছোট করে গেছো। মন্দ কথা বলে গেছো।
তোমাকে দিতে পারিনি একটা নদী। তোমাকে দিতে পারিনি সবুজের আলো। তোমাকে দিতে পারিনি পাখির উড়াল। একটা জঙ্গল দিতে পারলে তুমি বুঝতে পশুপাখিদের সংসার। এখন তুমি নতুন বাড়িটা নিয়ে সুখী হয়ে থাকো।
যেদিন ১ কাঠা জমি দেখাতে তোমাকে নিয়ে গেলাম শহর শেষের সীমানায়। সেদিন তুমি আমার কপালে রেখেছিলে একটা চুম্বন।
আমাকে খুঁজে দেখতে হবে চুম্বনের দাগটা আছে কিনা। সেই তো তোমার প্রথম ভালোবাসা। আমার মনে হয়। কেন না তুমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতেই পারোনি। আজ আমার মুক্তি। বাড়িটা করে দিতে পেরেছি। তোমার নামেই করে দিতে পেরেছি। আর আমি নিজে পাহাড়ি এক গ্রামের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছি। অনেক দূর। আর কোনোদিন ফিরে না আসার চেষ্টা করবো। তুমি থাকো। ভালো থাকো।
তোমাকে দিতে পারিনি ঘন বৃষ্টির রাত্রি। তোমাকে দিতে পারিনি গ্রীষ্মের আমবাগান। তোমাকে দিতে পারিনি হেমন্তের গোধূলি। এই এতদিন পর তোমাকে দিতে পারলাম একটা জ্যান্ত বাড়ি। তাকে সন্তান মনে করে লালন করবে। এই আশা করতেই পারি।
একটা বাড়িও এক সন্তান।
তোমাকে আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। পড়ে নিয়ে কুচি কুচি করবে। আমি মনে করি, আমার এই কথা রাখবে।
----১ ভাদ্র ১৪২৮
----১৮---৮---২০২১
----নির্মল হালদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন