ছাতিম পাতা
----------------------
উৎসর্গ: আমার সকল বন্ধুদের জন্য।
একটাও পলাশ ফোটেনি।
এখনো শীত আছে।
পলাশ গাছের সব পাতা ঝরে যাওয়ার পর ডালে ডালে পলাশ ফুটবে।
চারদিক চেয়ে রঞ্জন খুঁজে পায়না
অন্য কোনো ফুল।
আজ ক্লাস নেই।
সে সঙ্গীত ভবনের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে শুধু পাখি দেখতে পায়।
ভোর হয়েছে অনেক আগেই। তবুও কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
সে আশা করেছিল, গাছ জুড়ে
ফাগুন বউ । তার হলুদ শাড়ি থেকে রঙের কিরণ ঝরাবে।
সেও তো নেই।
কাঞ্চন ফুল কই?
ফাগুন তো শুরু হয়েছে। শুধু
আম মুকুলের গন্ধ।
রঞ্জনের মন গুন গুন করে উঠলো----
ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ডালে ডালে ফুলে ফলে--পাতায় পাতায়
পাতায় পাতায় এসে রঞ্জনের সুর থেমে যায়।
কোথাওতো ফাল্গুন নেই। যদিও
বাতাসে বিষণ্ণতা।
সে রামকিঙ্করের সুজাতার কাছে
এসে দাঁড়ায়। দেখে সুজাতার পায়েসের বাটিতে ধুলো-ময়লা।
শুকনো পাতা।
রঞ্জনের মনে পড়ে গেল-------
বসন্ত কি শুধু ফোটা ফুলের মেলা রে।
দেখিস নে কি শুকনো পাতা ঝরাফুলের খেলা রে।।
তার ইচ্ছে করলো, হোস্টেলের কোনো ঘরে শব্দ করে ঢুকবে।
এক কাপ চায়ের জন্য সে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে।
একটা শাদা শাড়ি এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, কলাভবনের কোন ছাত্রী। তার হাতে এক তাল মাটি।
রঞ্জন মেয়েটিকে আগে দেখেনি।
আলাপ করবে?
না, প্রয়োজন নেই।
সে একটা আম গাছের তলায়
ছায়া দেখতে লাগলো। কুড়িয়ে নেয় আম মুকুল। যেনবা আজকের এই উপহার তাকে কেউ পাঠিয়েছে।
আজকের ঘন্টাও স্তব্ধ হয়ে আছে।
কেউ কি জেগে উঠবে না?
ঘন্টা ঘরের তলায় একটা কাক।
কাকে যেন খুঁজছে।
হঠাৎ তার পাশ দিয়ে চলে গেল একটা সাইকেল। পিছনে বসে আছে একটি মেয়ে।
তার শাড়ির আঁচল উড়ছে বাতাসে।
সকালের রোদে স্নিগ্ধতা থাকলেও
রঞ্জনের হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
তার মনে জেগে উঠছে------
ওগো দখিন হাওয়া,ও পথিক হাওয়া---
গানটা সম্পূর্ণ করার আগেই একটা ডাক ভেসে উঠছে-------
পার্থ---পার্থ------
কে ডাকছে?
আমার একটা ডাক----
শেরনা----শেরনা--------
কে শেরনা?
কে পার্থ?
একটা ছোট পলাশ গাছের পাতা
কেঁপে কেঁপে উঠলো। তার শুকনো ডালে মনে হচ্ছে, কেউ যেন নোখ
দিয়ে লিখে গেছে-------দেখা হবে।
রঞ্জন বিড়বিড় করে------দেখা তো হয়না। কারো সঙ্গেই দেখা হয়না। কেবল বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
বাচ্চু দির বাড়ির দিকে গেলে হয়।
সকালটা যদি গানে গানে পাওয়া যায়?
বাচ্চুদির গান মানেই, বুক ভরা বাতাস। রঞ্জনের কান্নাও আসে।
যে কান্নাকে দু হাতে আগলে রাখা যায়। ভালোবাসা যায়।
সে দেখতে পায় কালো বাড়ির কাছে কারা যেন এসে বসলো।
তার ঘরে তার বন্ধুতো ঘুমোচ্ছে।
সে রাতভর কী যে পড়ে কে জানে। গান শুনতেও পছন্দ করেনা।
একটা গানের সুর ঘুরে বেড়াচ্ছে
চারদিক। কে গাইছে কোথায়?
আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী-----
সে চেয়ে চেয়ে খুঁজছে, গানের মুখ। খুঁজে পায়না। সে মাটি থেকে তুলে নেয় শিশির ভেজা ধুলো।
বুদ্ধদেবের মূর্তির কাছে এসে দাঁড়ায় রঞ্জন। তার খালি পায়ে লেগেছে শিশির। ঘাস ফুলের রেণু। সে উপর দিকে তাকিয়ে দেখে সূর্য অনেকটাই উঠে এসেছে ওপরে।
হোস্টেলের দিকে যাবে নাকি?
রঞ্জন স্থির করতে পারে না। তার মনের মাঝে গান থেমেছে, সুর আর লাগেনা।
নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়না আজকাল। শুনেছে, নন্দিনী নাকি
সাঁওতাল গ্রামের দিকে মাঝে মাঝে যায় বাচ্চাদের পড়াতে।
তাদের হোস্টেল ঘরের দিকেও
রঞ্জন ঘুরঘুর করেও নন্দিনীকে দেখতে পায় না ইদানিং। তার মনে হলো আজ, নন্দিনীর সঙ্গে দেখা করবেই।
রঞ্জন কি পারবে নন্দিনীর হাতে
ছাতিম পাতা তুলে দিতে?
------১লা ফাগুন১৪২৮
-----১৪-----২----২০২২
-----নির্মল হালদার
২.
ঘন্টাতলা
--------------
পাঠভবন থেকে শুরু হয়েছিল।
আজ স্নাতকোত্তর। বিষয় বাংলা।
অনিকেতের আজ মনে হয়, সেই পাঠভবনের বয়সটা কি চমৎকার ছিল। তাদের এক মাস্টারমশাই ছিলেন যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃতিপাঠ দিতেন। কিভাবে শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি, সেই মাস্টার মশাই দেখিয়েছিলেন।
দেখিয়েছিলেন, কল্কে ফুলের হলুদ আর ফাগুন বউয়ের হলুদ রঙ এক নয়।
তিনি এও দেখিয়েছিলেন, কাঠবিড়ালির চলাফেরা। এবং কাঠবিড়ালি ফল ছাড়াও আর কি কি খায়।
একদিন দুপুরবেলা খাবার খেতে গিয়ে অনিকেতের এক বন্ধু ইঁদুর দেখে মারতে গিয়েছিল। সেই মাস্টার মশাই অম্বুজ বাবু ছেলেটির হাত ধরে বলেছিলেন,
কোনো প্রাণীকে মারতে নেই। বরং দেখতে হয়, তাদের জীবন আচরণ।
কত সুখের ছিল পাঠভবনের দিনগুলি। অনিকেত তো নাচের দলেও ছিল। বসন্ত উৎসবে
খোল দ্বার খোল------গানের সঙ্গে
নাচতে নাচতে পরিক্রমা করেছে
মাঠ।
অনিকেতের অভ্যেস তার নিজের হোস্টেল থেকে এসে প্রতিদিন একবার পাঠভবনের দিকে যাবে।
একবার ঘন্টা তলায় দাঁড়াবে।
প্রতিদিন।
এখনো সে ঘন্টা শুনলেই দেখতে পায়, পাঠভবনের দিকে ছুটে যাচ্ছে অনেক শাদা পায়জামা।
হলুদ পাঞ্জাবি।
যেনবা ছুটে যাচ্ছে সমস্ত গাছপালা। এতোটাই সজীব। সুন্দর।
ঘন্টা শুনলেই মনে হয়, মা-বাবা বোধহয় এবার আসবে দেখা করতে।
অনিকেতের বাড়ি রাজনগর অনেক দূর।
পাঠভবনে ভর্তির পর অনিকেতের মন ছটফট করতো। তার মন বসতো না হোস্টেল ঘরে। ক্লাসে যাওয়ার জন্য ভোরে উঠতে পারতো না সে। তার এক বন্ধু ছিল
অনন্ত। সেই অনিকেতকে ঠেলে ঠেলে ঘুম থেকে তুলতো।
তারপর তো গাছ তলায় ক্লাস।
পাঠভবনে আসবার আগে স্কুল বিষয়ে মনে মনে তার একটা ছবি ছিল। এখানে এসে পাল্টে গেল সব।
একদিন দেখে একটা লোক
পাথর কুঁদে কুঁদে কি একটা বানাচ্ছে। সামনে যেতেই লোকটা
অনিকেতের মাথার চুল নেড়ে দিয়ে জানতে চায়, কি নাম গো তোমার?
অনিকেত চুপচাপ থাকে। লোকটাও আর কিছু বলে না।
জোর গলায় গাইতে শুরু করে,
আকাশ আমায় ভরলো আলোয়---+
অনিকেতের খিদে পেয়েছিল। কিন্তু গানের টানে দাঁড়িয়ে গেল সে অনেকক্ষণ।
পাঠভবন থেকে পাশ করে
যখন আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে
অনিকেত, তখন জেনেছিল
ছোটবেলার সেই বুড়ো লোকটি
শিল্পী রামকিঙ্কর।
এক পূর্ণিমার রাত্রে পলাশ গাছের নিচে রামকিঙ্করের কাছ থেকে
অনিকেত শুনেছিল আরো রবীন্দ্রনাথের গান।
বিশু পাগলের অভিনয়ে রামকিঙ্কর একবার অনিকেতকে মুগ্ধ করেছিল।
সেদিন সঙ্গে মৃত্তিকাও ছিল।
মৃত্তিকা শান্তিনিকেতন ছেড়ে
বর্তমানে দিল্লি নিবাসী। চাকরি করে।
এই মৃত্তিকাই বলেছিল একবার,
অনিকেত , তুই আর আমি
কোপাইয়ের কাছাকাছি একটা মাটির ঘর করে থাকবো।
অনিকেত উত্তরে বলেছিল, হ্যাঁরে
শান্তিনিকেতনের জলবাতাস আর
লালমাটি আমাদের জড়িয়ে ধরেছে।
তবে এটাও ঠিক রাত হলেই
গুরুদেবের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই।
মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলে, মাঝে মাঝে মন খারাপ করে আমারও। ফাগুন দিনের পাতাঝরা বিষণ্ণতা আমাকে পেয়ে বসে। তারপরও এই মাটি ছেড়ে
অন্য কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারিনা।
অনিকেতের উত্তর ছিল , ছাতিম গাছগুলো আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন। আমাদের বন্ধু।
সবাইকে ছেড়ে কী করে চলে যাবো, জানিনা ।
গাছ তো অনেক আছে , বিশেষ করে ছাতিম গাছকে খুব কাছের মনে হয়।
অনিকেতের আজ মনে হয়, তার
অন্তরের আবেগ, উন্মাদনা শুকিয়ে উঠছে।
সে বিস্মিত হয়ে ওঠে,এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে ওঠার কথা তো নয়।
তবে কী শান্তিনিকেতনের আকাশ ও মাটি শুকিয়ে উঠছে?
কিন্তু আজকেই দেখেছে সে, পলাশের ডালে ডালে কুঁড়ি আসছে।
আবছা শীতের হাওয়া ক্রমশ
বিদায়ের দিকে।
ঘন্টা বেজে উঠলো।
সন্ধের অন্ধকার।
অনিকেত কী বৈতালিকে যাবে আজ?
-----৬ ফাগুন ১৪২৮
----১৯----২----২০২২
------নির্মল হালদার
ছবি : দীপাংশু মাহাত























